প্রধানমন্ত্রীর সব অনুষ্ঠানেই কেন সাংবাদিকদের থাকতে হবে

শওগাত আলী সাগর
Published : 20 March 2015, 07:08 PM
Updated : 20 Oct 2012, 01:16 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অধিকাংশ বেসরকারি সংবাদমাধ্যমকে খবর সংগ্রহ করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে খবর প্রকাশের সূত্র ধরে এক ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যে। প্রতিদিনই এ নিয়ে আলাদা করে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। দু একটি পত্রিকা 'টক শো নিষিদ্ধ হচ্ছে'- বলে আগাম খবরও দিয়ে দিয়েছে। তবে তথ্যমন্ত্রী এরকম খবর নাকচও করে দিয়েছেন। এই আলোচনা যে শেষ পর্যন্ত রাজনীতির ইস্যু হবে তা বলেই দেওয়া যায়। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের 'আনুষ্ঠানিক' বাস্তবায়নের কোনো বিশ্লেষণ এখন পর্যন্ত কোনো মিডিয়ায় চোখে পড়েনি।

আমাদের প্রায় প্রতিটি মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নামে আলাদা বিট আছে এবং কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সংগ্রহের জন্য এক বা একাধিক রিপোর্টার/ফটোগ্রাফার সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকেন। এই বিটের রিপোর্টারদের কাজ মোটা দাগে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনে এসে তা লিখে দেওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে ডাক পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই বিটের রিপোর্টাররা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনে লিখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন। এর বাইরে মিডিয়ার কি তেমন কোনো ক্ষতি হয়েছে? মোটেও হয়নি। তবে পাঠক হিসেবে আমি বলতে চাই এতে পাঠকদের অনেক উপকার হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে লাভবান হবেন কি না সেটি অবশ্য ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া, এমনকি অন্যান্য নেতা নেত্রীরা যখন বক্তৃতা করেন, তারা কি কেবল প্রতিপক্ষকে গালিগালাজই করেন? নিজ দলের সাফল্যের কথা, পরিকল্পনার কথা কিছুই বলেন না? অবশ্যই তারা বলেন। হয়তো তাদের বক্তৃতার সিংহভাগই থাকে প্রতিপক্ষের সমালোচনা কিন্তু মিডিয়ার রিপোর্টে কেবল গালাগালিই স্থান পায়। নেতা নেত্রীরা ইতিবাচক যে সব কথাবার্তা বলেন সেগুলো খুব একটা মিডিয়ায় আসে না। ফলে আমাদের রাজনীতিকদের একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে পাঠকদের কাছে। আমি বলবো না, মিডিয়া একাই কেবল এই নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। অবশ্যই রাজনীতিকদেরও দায়ভাগ এতে কম না। কিন্তু মিডিয়া নেত্রীদের পারষ্পরিক গালাগালি যতো পছন্দ করে, অন্য কিছু সম্ভবত করেন না। খালেদা জিয়া অনেকদিন ধরেই রাজনীতিতে একটু চুপ মেরে আছেন, ফলে এই সময়ে মিডিয়ায় তার তেমন একটা উপস্থিতি নেই। কিন্তু গত একমাসে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত শেখ হাসিনার বক্তৃতার শিরোনামগুলো সামনে নিয়ে বসলে দেখা যাবে শেখ হাসিনা এই সময়ে কেবল আপত্তিকর ভাষায় প্রতিপক্ষকে গালাগালিই করেছেন, আর কিছুই করেন নি। শেখ হাসিনার গালাগালি যেমন খবর, শেখ হাসিনার নিজ কর্মকাণ্ড কিংবা পরিকল্পনা নিয়ে বলা কথাগুলোও তো খবর। মাসের ত্রিশ দিনই তো আর গালাগালি প্রধান শিরোনাম হতে পারে না। আর হলেও রিপোর্টে তো পরিকল্পনার কথাগুলোও থাকতে হবে। সেটি না থাকলে অবশ্যই রিপোর্টারদের, মিডিয়াকে আমরা মতলবি সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত করবো।

মূল কথায় আসি। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোনো দেশে কি মিডিয়া প্রধানমন্ত্রীর পেছনে সার্বক্ষণিক লেগে থাকে? কানাডার কথাই বলি। তেমন কোন ডিসক্লোজার না থাকলে কানাডার মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর খবর কানাডার মিডিয়াতে খুজেঁ পাওয়া যায় না। গত ৭/৮ বছর ধরে এমনটিই দেখে আসছি। তবু বিষয়টি জানার জন্য যোগাযোগ করেছিলাম কানাডার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস ডিপার্টমেন্ট-এর সঙ্গে। গত বৃহ্ষ্পতিবার সকালে টেলিফোনে কথা হয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস ডিপার্টমেন্ট-এর একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি খানিকটা বিস্ময় প্রকাশ করেন। ওই কর্মকর্তাটি জানান, প্রধানমন্ত্রীর 'পাবলিক ইভেন্ট' না থাকলে সেখানে মিডিয়া আসবে কেন? ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনায় জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর দৈনন্দিন কার্যাবলীর খবরাখবর তারা প্রেস ডিপার্টমেন্ট-এর ওয়েবসাইটে দিয়ে রাখেন। সেখানে প্রয়োজনীয় ছবি প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার কপি, প্রেস বিজ্ঞপ্তির কপি সবই আপলোড করা থাকে। মিডিয়া তার প্রয়োজনমতো সেখান থেকে নিয়ে নেয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর খবরাখবর কাভার করেন এমন সাংবাদিকদের প্রায় সবাই ওই ওয়েবসাইটের সাবস্ক্রাইভার। ফলে কোন হালনাগাদ তথ্য ওয়েবসাইটে আপলোড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টারদের ইমেইলে সেটি চলে যায়।

প্রধানমন্ত্রীর কোন অনুষ্ঠানে কি সাংবাদিকদের ডাকা হয় না? অবশ্যই ডাকা হয়। কেবল 'পাবলিক ইভেন্ট' থাকলেই রিপোর্টারদের প্রবেশাধিকার মিলে ওই সব অনুষ্ঠানে। তাও আবার সব অনুষ্ঠানেই রিপোর্টারদের প্রবেশাধিকার থাকে না। কোন কোন অনুষ্ঠান থাকে কেবল ফটোগ্রাফারদের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে ফটোগ্রাফাররা গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের ছবি তুলে নিয়ে আসেন। ওই সব অনুষ্ঠানে রিপোর্টারদের প্রবেশাধিকার থাকে না। যে সব অনুষ্ঠান 'মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত' সেই অনুষ্ঠানগুলোতেই কেবল রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার সবাই যেতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রীর পাবলিক ইভেন্টগুলোর তথ্যও ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া হয় আগের দিন। 'মিডিয়া এডভাইজরী' নামে প্রধানমন্ত্রীর পাবলিক ইভেন্টের তথ্য প্রকাশ করা হয় ওয়েবসাইটে। সেখানে লেখা থাকে অনুষ্ঠানটি মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত কি না। উদাহরন দেওয়া যাক। ১৯ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর পাবলিক ইভেন্টের যে মিডিয়া এডভাইজরীটি প্রকাশ করা হয় সেটিতে বলা হয়েছে,
Public event for October 19, 2012
18 October 2012
Ottawa, Ontario
Public event for Prime Minister Stephen Harper for Friday, October 19th is:
Ottawa, Ontario
2:30 p.m. – Prime Minister Stephen Harper will deliver remarks at the Ukrainian Observer Mission Training Session.
Museum of Civilization
(The Future Canadian Museum of History)
100 Rue Laurier
Gatineau, Quebec
K1A 0M8
*Open to media
NOTES:
• Media are required to present proper identification for accreditation.
• Media should arrive no later than 1:50 p.m.

লক্ষণীয় এই নির্দেশনাটিতে বলে দেওয়া হয়েছে অনুষ্ঠানটি মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত। তবে আড়াইটার অনুষ্ঠানে মিডিয়াকে যেতে বলা হয়েছে দুপুর ১.৫০ এ। এর আগের এডভাইজরীটি ছিলো ৯ অক্টোবর। অর্থ্যাৎ মাঝের ৮ দিনে প্রধানমন্ত্রীর কোন পাবলিক ইভেন্ট ছিলো না। এই ৮দিনে প্রধানমন্ত্রীর কোন কার্যক্রমেই মিডিয়ার প্রবেশাধিকার ছিলো না। এবার নজর দেই ৯ অক্টোবেরর এডভাইজরীটিতে।
Public event for October 10, 2012
9 October 2012
Ottawa, Ontario
Public event for Prime Minister Stephen Harper for Wednesday, October 10th is:
Ottawa
8:50 a.m. – Prime Minister Stephen Harper will depart for Dakar, Republic of Senegal and Kinshasa, Democratic Republic of Congo.
Canada Reception Centre
Hangar 11
190 Convair Private
Ottawa, Ontario
*Photo opportunity only (Cameras and photographers only)
NOTES:
• Media are required to present proper identification for accreditation.
• Non-traveling media should arrive no later than 8:15 a.m.

লক্ষণীয়, এই অনুষ্ঠানটিতে কেবলমাত্র ফটোগ্রাফারদের প্রবেশাধিকার ছিলো, সেখানে রিপোর্টাররা ছিলো অনাহূত। বছরের পর বছর ধরে এইভাবেই চলে আসছে। কিন্তু কানাডার মিডিয়া এসব নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন তোলে নি। এটা ঠিক, কানাডা আর বাংলাদেশকে এক কাতারে ফেলে মাপা ঠিক না। কিন্তু পৃথিবীতো বদলাচ্ছে, সেই পরিবর্তনের ধাক্কা লাগছে বাংলাদেশেও। তাহলে বাংলাদেশ বহির্বিশ্ব দ্বারা অনুপ্রানিত হবে না কেন?

বাংলাদেশের মিডিয়া রাজনীতির সংস্কার নিয়ে গলা ফাটায়, তারা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের চিন্তা করবে না কেন? বাংলাদেশের মিডিয়ারও উচিত নেতানেত্রীদের বক্তৃতার পেছনে ছুটাছুটি না করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় সময় ব্যয় করা। আর প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া কাভারেজ নিয়েও একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা দৈননন্দিন কাজ করে যাবেন, এটাই তাদের দায়িত্ব। সবকিছুই মিডিয়াতেই আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের খবরাখবর নিয়মিতভাবে মিডিয়ায় সরবরাহের উদ্যোগটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরই নেওয়া উচিত। মাসে ২/৩টা অনুষ্ঠান থাকতে পারে যেখানে মিডিয়ার প্রবেশাধিকার থাকবে, কোন অনুষ্ঠানে মিডিয়ার প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। কিন্তু সারাক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর, মন্ত্রীদের পেছনে ঝাঁক বেধে মিডিয়া ছুটোছুটি করবে- এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা জরুরী।