কওমী শিশুদের রক্ষা করুন হে ‘কওমী জননী’

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 5 Dec 2020, 12:37 PM
Updated : 5 Dec 2020, 12:37 PM

কখনও খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, প্রতিমাসে আপনার দরজায় কড়া নাড়ে একজন মাদ্রাসা ছাত্র। এদের বয়স গড়ে ৮ থেকে ১২ বছর। ধুলামলিন বেশ, অনাহারি চেহারা নিয়ে বাড়িয়ে দেয় একটা হলুদ রঙা রশিদ। সাহায্যের আবেদন। জিজ্ঞাসা করলে জানবেন, তার মতো আরো শ খানেক শিশু-কিশোর সকাল ৮টায় বের হয়ে ছড়িয়ে পরে শহরজুড়ে। সকালে একলোকমা ডালভাত মুখে দিয়ে বের হয়, বিকালে মাদ্রাসায় ফিরে। সারাদিনে ভাগ্য খুব ভালো হলে তারা ২০-৩০ টাকা পায়। ভিখেরিদের বরাদ্দ ২টাকাই গৃহিনীরা দেন। ইদানিং  অ্যাপার্টমেন্টগুলা ভিখিরিপ্রুফ। তাই শিশুগুলোর কষ্ট হয় কালেকশনে। তারপরও তারা পায়ে হেঁটে আধপেটা শরীরে হাত পেতে যায় দুয়ারে দুয়ারে। এই টাকা আনার উপর নির্ভর করছে তার পরের বেলার মেন্যু, হুজুরের বেত। ১৮৩৮ সালে চার্লস ডিকেন্সের লেখা অলিভার টুইস্টের এই বাংলাদেশি রূপ মঞ্চায়িত হয় প্রতিদিন, উদয়াস্ত, ঢাকার প্রতিটি অলিতে গলিতে। আজ এখানে, কাল ওখানে- পায়ে হেঁটে হেঁটে তারা মুখস্ত করে মানচিত্র ভিক্ষার রশিদ নিয়ে।

২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের মহাসমাবেশের শতকরা ৫০ভাগই ছিল মাদ্রাসার শিশু-কিশোর, যাদের গড় বয়স ১২। বড় হুজুরের নির্দেশ- তাই তারা এসেছে। এই শিশুরা ভালো করে ইসলামই বোঝে না, নাস্তিক চেনে না, ব্লগার তো দূরের কথা। ৫ টাকার মুড়ি ভাগ করে খেতে দেখেছি চার কিশোরকে। হুজুর বলেছেন- 'গেলে সোয়াব হবে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে জিহাদের সোয়াব।' সে ঠিক মতো খেয়েছে কিনা, তার কচি শরীরে হুজুরের 'ঈমানি জোশ' ধারণ করার সামর্থ্য আছে কিনা কে দেখে! রোদে পুড়ে, তৃষ্ণাকে ঢোকে গিলে সে জিহাদ করে যায় সোয়াবের আশায়!

যেই শিশুটি দিনভর হুজুরের জন্য টাকা কালেক্ট করে, হুজুরের নির্দেশ মানতে অবোধ্য যুদ্ধে নামে, সেই শিশুটিই রাতে আবার যৌন নির্যাতিত হয়। 'গেলমান' বিষয়ক আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সোয়াবের প্রলোভনে তাকে বলাৎকার করা হয়, এদের কেউ হুজুরের কথা মেনে নেয়। কেউ বা ফুপিয়ে কাঁদে! তার বাবা মা জানে না তার সঙ্গে কী হচ্ছে। কিংবা সে হয়তো এতিম, তার যাওয়ার জায়গা নেই। সে ইসলামের খেদমতে এসেছে, ইসলামের দীক্ষায় দিক্ষিত হতে এসেছে। এসে দেখে ইসলাম এখানে বড় হুজুর যা বলে তাই- 'খাওয়ার জন্য ভিক্ষা করো, ভুখাপেটে ইসলামরক্ষার মিথ্যে মিছিল করো, রাতে নির্যাতিত হও।'

মাসদুয়েক আগে দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন যখন সোচ্চার। তখন কেউ কেউ মাদ্রাসার এই নির্যাতিত শিশুদের কথাও আলোচনায় এনেছিলেন। সুবাদেই গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে লাগলো একের পর এক নির্যাতনের আখ্যান। তখনই হেফাজত নেতারা ভাস্কর্য বিরোধী গরম গরম বক্তৃতা দেওয়া শুরু করে দিল। কাকতালীয়? নাকি মাদ্রাসাগুলোয় এই বালক নির্যাতনের অপরাধ ঢাকতে, ধিকৃত চর্চার হেফাজত করতে নতুন জিহাদের ডাক দিলো ভাস্কর্যবিরোধিতার আদলে? বাস্তবতা হচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে হেফাজত নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেই যৌন নিপীড়ণের অভিযোগ বেরিয়ে আসছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি 'কওমী জননী' উপাধী পেয়েছেন। সেই হিসেবে এই কওমী শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব আপনার। এদের যেন ভিক্ষাবৃত্তিতে পাঠানো না হয়, এদের মিছিলে সমাবেশে পাঠানো না হয়, সর্বোপরি এরা যাতে বিকৃতমানসিকতার হুজুরদের যৌনতার উপকরণ না হয় সেটা নিশ্চিত করা জরুরী। নিশ্চিত করুন। পাপ বৃক্ষে পূণ্য ফলে না, সে কারণেই তা উপড়ে ফেলা জরুরী। সাংবিধানিকভাবে একমাত্র আপনারই সে ক্ষমতা আছে…