ল্যানসেটে চীনা প্রি-প্রিন্ট: উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে

মামুন আল মাহতাব এবং শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর
Published : 3 Dec 2020, 09:05 AM
Updated : 3 Dec 2020, 09:05 AM

কোভিড প্যানডেমিকে রোগী আর বিভ্রান্তি যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অতিমারির মতো কোভিডের কল্যাণে আমাদের শব্দ ভাণ্ডারে যে নতুন-নতুন সংযোজন তার অন্যতম একটি হলো 'ইনফোডেমিক'। কোভিড-১৯ নিয়ে যে চলমান বিভ্রান্তি তাতে সর্বশেষ সংযোজন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে চাইনিজ একাডেমি অব সাইন্সের একদল গবেষকের একটি প্রি-প্রিন্ট। এটি অনলাইন হয়েছে গত ১৭ নভেম্বর। তারপর বিষয়টি গড়িয়েছে বহুদূর। এ নিয়ে সংবাদ ছেপেছে বিলেতের নামজাদা ডেইলি মেইল আর বক্তব্য এসেছে এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকেও। গবেষণাপত্রটিতে দাবি করা হয়েছে সার্স-কোভ-২'র উৎপত্তি উহানে নয় বরং এটি চীনে ঢুকেছে ইউরোপ হয়ে। কোভিডের সম্ভাব্য জন্মস্থান হিসাবে এতে ৮টি দেশকে দায়ী করা হয়েছে। তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশ, সাথে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, ইতালি ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর নামও। চীনা গবেষকদের 'তত্ত্ব' অনুযায়ী গত মে-জুন মাসে যখন উত্তর-মধ্য ভারত ও পাকিস্তান তীব্র দাবদাহে আক্রান্ত ছিল তখন এ অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। এ সময় নাকি মানুষের সাথে বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে বানরের খাবার পানি নিয়ে সংঘাত শুরু হয়। এবং তারই এক পর্যায়ে বানর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের শরীরে চলে আসে সার্স-কোভ-২। অতঃপর এই দুই দেশ থেকে বিমানে চেপে ইউরোপ হয়ে চীনে পৌছায় ভাইরাসটি।

এ প্রবন্ধটি নিয়ে মন্তব্য করেছেন নানা দেশের বিদগ্ধজনেরা। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক মার্ক সাচার্ড সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে চীনা গবেষণাটির মেথডোলজির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। আর গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির ডেভিড রবার্টসন তো ব্রিটেনের ডেইলি মেইলকে দেয়া বক্তব্যে এই গবেষণাটিকে উড়িয়েই দিয়েছেন। সবশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি বিভাগের শীর্ষ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মাইকেল রায়ান গত ২৭ নভেম্বর এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে এ গবেষণাটিকে একেবারেই অনুমান নির্ভর বলে মন্তব্য করেছেন।

হঠাৎ করে কোভিডের জন্মের সাথে বাংলাদেশের নাম জুড়ে দেয়ায় সঙ্গত কারণেই বিষয়টি নিয়ে আমরা আগ্রহী হই। প্রথমেই দেখা যাক প্রি-প্রিন্টের অর্থ কী? ল্যানসেটই বলছে এর অর্থ এই বৈজ্ঞানিক নিবন্ধটির একেবারেই চীনা গবেষকদের নিজস্ব বিষয়। ল্যানসেটের বিজ্ঞ রিভিউয়াররা এটি পিয়ার রিভিউ করেননি। কাজেই এই গবেষণা বিষয়ক কোনো তথ্য সাধারণ মানুষের সাথে শেয়ার করা যাবে না। অথচ কার্যতঃ তাই করা হচ্ছে এবং মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে যে কোভিডের উৎপত্তিটা চীনের বাইরে।

বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করলেও চীনা গবেষণাটির নানা দুর্বলতা দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে। ২০১৯-এর গ্রীষ্মে বাংলাদেশের কোথাও পানি নিয়ে বানরের সাথে মানুষের সংঘর্ষ হয়েছে এমন কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। আর উত্তর-মধ্য ভারত এবং পাকিস্তানে যদি সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেও থাকে তবে সেসব বানর হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কেন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সার্স-কোভ-২ ইনফেকশন ছড়াতে আসলো সেটিও নিশ্চয়ই একটি বড় প্রশ্ন। তেমনি আরেকটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে বানরে-মানুষে পানি নিয়ে কাড়াকাড়ি হলো ভারত আর পাকিস্তানে অথচ, চীনা গবেষকদের দেয়া কোভিড জন্মভূমির সম্ভাব্য ৮ দেশের তালিকায় কোথাও পাকিস্তানের নাম নেই। গবেষকরা তাদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন যে সার্স-কোভ-২'র সত্যিকারের ন্যাচারাল হোস্টটি শনাক্ত করা জরুরি। তাদের এই পর্যবেক্ষণের সাথে আমরা পুরোপুরি একমত, কারণ তা না করা গেলে এই চলমান প্যানডেমিকটিকে যেমন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে তেমনি অসম্ভব হয়ে পড়বে ভবিষ্যতে এ ধরনের নতুন কোনো প্যানডেমিকের বিস্তার ঠেকানোও। কাজেই এ ধরনের ভ্রান্ত বিজ্ঞান যে ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা বলাই বাহুল্য।

চীনা গবেষকরা দাবি করছেন বাংলাদেশ এবং ভারতে সার্স-কোভ-২'র জেনোমে মিউটেশন হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। কাজেই তাদের যুক্তিতে এখানকার সার্স-কোভ-২কে'ই অন্যান্য দেশের সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ফাইলোজেনেটিক শিকড় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এটি প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান যে ভাইরাসের মিউটেশন হওয়া বা না হওয়া ইমিউনিটি এবং পাশপাশি এনভায়রনমেন্টাল অনেক ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে। কাজেই কোনো ভাইরাসের কম বা বেশি সংখ্যায় মিউটেশন দেখে এর উৎপত্তি নির্ধারণ করা সম্ভব নয় বরং যেখানে ভাইরাসের উৎপত্তি সেখানে ইমিউন স্ট্রেসজনিত কারণে ভাইরাসের মিউটেশন বেশি হবে এমন পাল্টা হাইপোথিসিসও কেউ-কেউ প্রস্তাব করতেই পারেন।

ভাইরাসের ব্যাপারে আরেকটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে এই যে, যেকোনো ভাইরাসের বেলাতেই মিউটেশন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা আর তা যদি হয় সার্স-কোভ-২'র মতো আরএনএ ভাইরাস হলে তো কথাই নাই। তবে সাধারণত দেখা যায় যে মিউটেটেড ভাইরাসের ভিরুলেন্স কম থাকে অর্থাৎ মিউটেটেড ভাইরাসজনিত রোগের তীব্রতা কম হয়। ফলে মিউটেটেড ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর খারাপ হবার ঝুকিও কম থাকে। তবে ভাইরাস কোনো ফর্মুলা মেনে চলে না। অনেক সময়ই দেখা যায় যে মিউটেটেড ভাইরাসই কিলার ভাইরাসে পরিণত হয়। আর 'কিলার' সার্স-কোভ-২'র জন্ম যে চীনের মূল ভূখণ্ডে তা নিয়ে কিন্তু সন্দেহের ন্যূনতম সুযোগ নেই। কারণ এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ইউরোপে কোভিডের শুরুটা ইতালি থেকে আর ইতালিতে কোভিড ছড়িয়েছিল সে দেশে কর্মরত চীনা নাগরিকদের মাধ্যমে। একইভাবে ইরানেও কোভিডের আমদানি চীনা নাগরিকদের দিয়েই। আর এর পরেরটুকু তো সবারই জানা। এই ক'মাস আগেই কোভিডে মৃত্যুর মিছিলে লাশজট দেখা দিয়েছিল ইরান, ইতালি আর ইতালি থেকে ইউরোপের দেশে-দেশে ছড়িয়ে পরা 'চীনা সার্স-কোভ-২'র তাণ্ডবে।

চায়না থেকে কোভিড বিষয়ক কোনো গবেষণাপত্র কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ করতে হলে তার জন্য অবশ্যই সেদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। সরকারি অনুমোদন ছাড়া চীনা গবেষকরা কোথাও কোনো কোভিড বিষয়ক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারেন না। কাজেই প্রশ্ন জাগে যে এ ধরনের একটি অবৈজ্ঞানিক প্রি-প্রিন্ট প্রকাশের পেছনে বৈজ্ঞানিক চেতনার চেয়ে অবৈজ্ঞানিক তাড়না বেশি কাজ করেছে কিনা? বিশেষ করে চীনা তালিকায় কোন কোন দেশের নামের উপস্থিতি আর কোনটির অনুপস্থিতি এই সন্দেহকে বাড়িয়ে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে গত ১ ডিসেম্বর সিএনএন-এ প্রচারিত চীনের কোভিড ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনটির দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। সিএনএন-এর হাতে এসেছে চীনের হুবে প্রভিন্সিয়াল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ১১৭ পাতার গোপন নথি যা থেকে কোভিড প্যানডেমিক মোকাবেলায় চীনা হ-য-ব-র-ল অবস্থাটা স্পষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি স্থানীয় একটি সমস্যাকে বিশ্বব্যাপী সংকটে রূপান্তরিত হওয়া ঠেকানোয় চীনা ব্যর্থতাও এই ডকুমেন্টের পাতায়-পাতায় বিধৃত। অক্টোবর ২০১৯ থেকে এপ্রিল ২০২০ সময়ের কোভিড সংক্রান্ত ঘটনাবলীর বিবরণ আছে এতে। জানা যাচ্ছে শুরুর দিকে একেকজন কোভিড রোগী শনাক্ত করায় চীনাদের সময় লেগেছে গড়ে ২৩.৩ দিন। বিশ্ববাসীকে চীনারা যখন প্রথম উহানে কোভিড রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায়, ততদিনে হুবে প্রদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা-লাইক রোগের একটি আউটব্রেক চলছিল। এ সময় সেখানে ইনফ্লুয়েঞ্জা-লাইক সিম্পটমের রোগীর সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় বিশগুণ বেশি ছিল। শুধু তাই না, এসময় উহানের পার্শ্ববর্তী ইচেং এবং জিয়ানিন শহরেও এই ইনফ্লুয়েঞ্জা-লাইক এপিডেমিকটি ছড়িয়ে পড়েছিল।

সিএনএন-এর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে আরো সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে চীন জানিয়েছিল পুরো দেশে ২৪৭৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। অথচ সেদিন শুধু হুবে প্রদেশেই শনাক্ত হয়েছিল ৫৯১৮ জন নতুন রোগী। পাশপাশি অনেক কোভিড রোগীকেই ক্রাইটেরিয়ার মারপ্যাচে ফেলে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শুরুর দিকে কোভিড শনাক্তের জন্য 'সার্স' টেস্ট কিট ব্যবহার করা হচ্ছিল যার ফলে ফলস নেগেটিভ রিপোর্টের সংখ্যা ছিল খুবই বেশি। অথচ চাইনিজ ন্যাশনাল হেলথ ইন্সটিটিউট কনফার্ম পজেটিভ রিপোর্ট ছাড়া কোভিড রোগী শনাক্ত না করার জন্য এ সময় চিকিৎসকদের নির্দেশ দিয়েছিল। তার উপর চীনা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা তাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোভিড রোগীর সংখ্যা আন্ডার রিপোর্টিংয়ের জন্যও চাপের মুখে ছিলেন। রিপোর্টটির পাতায়-পাতায় চলমান প্যানডেমিকটি মোকাবেলায় চীনা আমলাতন্ত্রের দুর্বলতাও উঠে এসেছে।

সিএনএন এই ডকুমেন্টটি প্রকাশ করার আগে ৬ জন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন। একজন ইউরোপিয়ান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞও এর বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে সিএনএন-কে নিশ্চিত করেছেন। একই ধরনের মতামত দিয়েছেন ব্রিটেনের ক্র্যানফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সারা মরিস।

কাজেই ল্যানসেটে যে চীনা সাম্প্রতিক প্রি-প্রিন্ট সেটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই যে শুধু নড়বড়ে তাই-ই নয়, বরং এটি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের চেষ্টা বললেও বোধহয় ভুল হবে না।