‘নব্য বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক’ খেলাফত মজলিস!

মো. জাকির হোসেন
Published : 1 Dec 2020, 10:08 PM
Updated : 1 Dec 2020, 10:08 PM

অতি সংক্ষিপ্ত মানবজীবন। সে জীবনটিকে কেউ রাষ্ট্র বা মানুষের জন্য উৎসর্গ করলে আমরা তাকে বীর, মহানায়ক বলে সম্মান-সম্বোধন করি। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের সবটুকু উৎসর্গ করেছেন বাঙালির জন্য। সংক্ষিপ্ত জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় যৌবনকাল। বঙ্গবন্ধু তার যৌবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন বাঙালির নিজস্ব ঠিকানা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্ট্রির জন্য। রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া ও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন অনেক বার। ব্যক্তিগত পরিবারের প্রতি ভালোবাসাকে গৌণ করে বাঙালির প্রতি, বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসাকে বঙ্গবন্ধু ঠাঁই দিয়েছিলেন সবকিছুর ঊর্ধে। বঙ্গবন্ধুকে তাই ভালোবাসতেই হবে। বঙ্গবন্ধুকে যারা ভালোবাসে না তার একটাই অর্থ তিনি বা তারা অকৃতজ্ঞ, বাংলাদেশবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী।

সম্প্রতি খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক ঘোষণা করেছেন তিনি ও তার দল বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন। বঙ্গবন্ধুর সম্মান রক্ষার্থে তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন! তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসলে তারা যেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য না বানায়। কারণ এতে বঙ্গবন্ধুর কবরে 'আজাব' হবে। এরপরও ভাস্কর্য বানালে শাপলা চত্বরের ঘটনা বা তারচেয়েও মারাত্মক ঘটনার হুমকিও দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কারো কারো অবিমৃশ্যকারিতার সুযোগে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীরা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেছে। এসব হাইব্রিড মুজিব ভক্ত অতি বড় মুজিব ভক্ত প্রমাণ করতে প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘেমেও মুজিব কোট গা থেকে নামাতে চান না। এরা মেয়াদী মুজিব ভক্ত। ক্ষমতার পালা-বদল হলে, এদের অনেকেই কেবল মুজিব কোট নয়, পারলে সব কাপড়-চোপড় খুলে উদোম হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে ভুলেও কোনোদিন নৌকায় ওঠেনি তারা। এবার দেখা যাক নব্য বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক মাওলানা মামুনুল হক ও তার দল আসলে কতটা মুজিব ভক্ত, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ-ষড়যন্ত্র। অনেকেই নব্য মুজিব ভক্ত মামুনুল হকের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুড়িয়ে দেওয়ার হঠাৎ হুংকারকে নানা সন্দেহের চোখে দেখছেন। যে সব কারণে নব্য বঙ্গবন্ধু ভক্তকে ঘিরে নানা সন্দেহ তা হলো –

এক. ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার এক মাস দশ দিন পর সভ্যতা ও মানবতার ইতিহাসের যে, ভয়ংকর কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় সে অধ্যাদেশের মূল কথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ভোরে আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন খুনিদের বিরুদ্ধে কোনও আদালতে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। এ দীর্ঘ ৪৫ বছরে মামুনুল হক কিংবা তার দল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছে কিংবা হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে এমন শুনিনি। ইসলামবিরোধী ইনডেমনিটি আইন বাতিলের বিরুদ্ধে মামুনুল হক কোন হুংকার দিয়েছে এমন কোনও প্রমাণ নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হওয়ার পর বিএনপি জোট যখন আপিল আদালতে ৫ বছর ধরে বিচার কাজ বন্ধ রাখল মামুনুল হক গং এরও প্রতিবাদ করেনি।

দুই. ইসলাম ধর্মে অন্যায়ভাবে হত্যা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, "যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা জমিনে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল, আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচাল, সে যেন তামাম মানুষকে বাঁচাল।" (সুরা মায়িদা: ৩২) অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, "কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।" (সুরা নিসা: ৯৩) কোরআনের বিধান অনুসারে হত্যাকারীকে আইনের সহায়তায় ঠিক সেভাবেই হত্যা করা হবে, যেভাবে সে হত্যা করেছে, যদি না নিহতের নিকটজন হত্যাকারীকে ক্ষমা করে ছেড়ে দেয়। কোরআনে হত্যার বিচার বিষয়ে বলা হয়েছে, "মুমিনরা, তোমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে অন্যায়ভাবে হত্যার বিরুদ্ধে অনুরূপ প্রতিশোধ নিতে" (সুরা বাকারাহ: ১৭৮-১৭৯) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: 'দুনিয়া ধ্বংস করার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণ্যতর কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।' (তিরমিজি) অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, 'যদি আসমান ও জমিনের সব অধিবাসী একজন মুসলমানকে অন্যায়ভাবে হত্যার জন্য একমত হয়, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।' (মুসনাদে আহমদ) আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার পর মানবহত্যাকে সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ইসলামে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, 'সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, মানুষ হত্যা করা, মা-বাবার অবাধ্যতা করা এবং মিথ্যা কথা বলা।' (বুখারি, ৬৮৭১) ইসলামে যুদ্ধক্ষেত্রেও নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করা নিষিদ্ধ।' (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ: ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৪৮৭-৪৮৮)।

অথচ ১৫ অগাস্ট নিরীহ, নিরস্ত্র নারী ও শিশু হত্যাকে দায়মুক্তি দেওয়া হলো জিয়া-মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি আইনে। ভয়ংকর ইসলামবিরোধী এসব ঘটনা দেখেও মামুনুল হকরা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। কোরআন-হাদিসে মুমিনদেরকে অন্যায় প্রতিরোধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ''তোমাদের কেউ কোনো অন্যায় সংঘটিত হতে দেখলে সে যেন তা নিজ হাতে প্রতিরোধ করে। (নিজ হাতে প্রতিরোধ করা) সম্ভব না হলে যেন মুখে প্রতিবাদ করে। যদি তাও সম্ভব না হয় তবে যেন অন্তত মন থেকে ঘৃণা করে। এটা দুর্বলতম ঈমানের আলামত।' (বুখারি, ১৯৪; মুসলিম)। রাসূল (সা.) ইমাম, রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তা সত্ত্বেও তিনি জনসাধারণকে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যখনই তাদের কেউ কোনো খারাপ বা অন্যায় কিছু দেখতে পাবে তখন সাধ্যমতো তা পরিবর্তনে যেন এগিয়ে আসে।' (মুসলিম, ২০১) রাসূল (সা.) এর হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী কারো প্রতি অন্যায় আচরণ হতে দেখলে তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা ঈমানের অপরিহার্য দাবি। সে দাবি পূরণে সম্ভব হলে হাতে, মুখে এবং নীরবে সংগ্রাম অব্যাহত রাখা। মামুনুল হকরা ইসলামের এসব নির্দেশ জেনেও নীরব ছিলেন। এটা কী বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের ভালোবাসার ইঙ্গিত দেয়?

তিন. কুরআন ও হাদীসের বিধান মতে প্রত্যেক মুসলিমের সাধ্যমতো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ফরজ বা আবশ্যিক দায়িত্ব। আর সেই উম্মতকে সর্বোত্তম উম্মত বলা হয়েছে, যারা এই দায়িত্ব পালন করে। আল্লাহতা'য়ালা বলেন, "তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।" (সুরা আল ইমরান: ১১০) রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, 'মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, শিগগিরই আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন।' (তিরমিজি, আবু দাউদ) অন্যায়ের প্রতিবাদ না করার ফলে যখন শাস্তি নাযিল হবে তখন দোয়া করলেও সে শাস্তি থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। এ সম্পর্কে হযরত হুযাইফা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, 'যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে বাধা দিবে। তা না হলে অচিরেই আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নেমে আসবে। তখন তোমরা (সে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য) দোয়া করবে, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের দোয়া কবুল করবেন না।' (তিরমিযী)

যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধানে এগিয়ে আসে না, তাদের নিন্দাবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, "বনি ইসরায়েল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তাদের ওপর দাউদ এবং মরিয়ম পুত্র ঈসার (আ.) এর জবানিতে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি করতে শুরু করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্মপদ্ধতি বড়ই জঘন্য ছিল।" (সুরা মায়িদা: ৭৮-৭৯)

আল্লাহতায়ালা যে দুইটি মৌলিক উপাদানের কারণে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণকামী জাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, তার মধ্যে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ অন্যতম। মুমিনদের মৌলিক গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, "তারা হচ্ছে তওবাকারী, ইবাদতকারী, প্রশংসাকারী, রোজা পালনকারী, রুকু ও সিজদাকারী, সৎকাজে আদেশ এবং মন্দ কাজে বাধা প্রদানকারী, আল্লাহর বিধি-সীমাসমূহের সংরক্ষণকারী। আর আপনি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন।" (সুরা তাওবা: ১১২)

অন্যায় কাজে বাঁধা, মুমিনদের গুণাবলী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, আর বাধা না দিলে আজাবের কথা বলা হয়েছে। সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা প্রতিটি মানুষের ঈমানি দায়িত্ব হওয়া সত্ত্বেও মামুনুল হকরা কোরআন ও হাদিসের নির্দেশ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিরুদ্ধে, ইনডেমনিটি আইনের বিরুদ্ধে, ইচ্ছাকৃতভাবে বিচার আটকে রাখার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করেননি। বরং খুনিদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, চাকরি দিয়েছে, পদোন্নতি দিয়েছে, রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছে তাদের সাথে রাজনৈতিক জোট করেছেন মামুনুল হকরা। ভাস্কর্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠেছে। এই হঠাৎ ভালোবাসার রহস্য কী?

চার. বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে শত শত ভাস্কর্য রয়েছে। বহু বছর ধরে এসব ভাস্কর্য বহাল তবিয়তে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের অনেক আগে জিয়ার একাধিক ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। এসব ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি-হুংকার মামুনুল হকদের মুখ থেকে শুনিনি কোনও দিন। বরং জিয়ার ভাস্কর্য তৈরি করা দলের সাথে রাজনৈতিক জোট করেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে মামুনুলদের হঠাৎ ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার বাঁধভাঙ্গা জোশ সন্দেহের উদ্রেক করে বৈকি।

পাঁচ. বঙ্গবন্ধু কাউকে বলেননি ভাস্কর্য নির্মাণ করতে। তাহলে ভাস্কর্য নির্মাণ করলে বঙ্গবন্ধুর কবরে শাস্তি হবে বলে মামুনুল হক কোরআন-হাদিসের কোন বিধান অনুযায়ী ফতোয়া দিলেন? আল্লাহ বলেন, "প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মের জন্য দায়ী থাকবে। কেউ অন্যের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। তারপর তোমাদের পালনকর্তার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি সেসব বিষয়ে বলে দেবেন, যা নিয়ে তোমরা মতবিরোধ করতে।" (সুরা আনআম: ১৬৪)

ছয়. ভাস্কর্য নিয়ে সামান্য হলেও মতপার্থক্য রয়েছে দেশি-বিদেশি আলেমদের মধ্যে। আর এ সুযোগ নিয়েই রাসূল (সা.) এর জন্মভূমি সৌদি আরবসহ অনেক ইসলামি দেশেই প্রাণির ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ভয়ংকর কবীরা গুনাহ হিসেবে সমকামিতা বিষয়ে কোনও মতপার্থক্য নেই আলেমদের মধ্যে। সমকামী মানুষদের উদ্দেশ্য করে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, "তারা চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মতো, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।" (সুরা আরাফ: ১৭৯)। লুত সম্প্রদায় সমকামের অপরাধে ধ্বংস হয়েছিল। আল্লাহর নবী লুত (আ.) বার বার তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের এ নিকৃষ্ট কাজ হতে বিরত হতে বলেছেন। হালাল পন্থায় নারীদের সঙ্গে যৌন চাহিদা পূরণ করার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কওমবাসী তার কথা শোনেনি। ফলে আল্লাহ লুত (আ.) এর জাতিকে আজাব দিলেন। ধ্বংস করে দিলেন একটি জনপদকে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, "অতঃপর যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছাল, এরপর যখন আমার সিদ্ধান্ত কার্যকর হলো, তখন আমি জনপদের উপরিভাগ নিচে এবং নিম্নভাগ উপরে উঠালাম এবং তার উপর স্তরে স্তরে পাথর বর্ষণ করলাম।" (সুরা হুদ: ৮২)। লুত (আ.) এর জাতির ধ্বংসপ্রাপ্তরূপই আজকের 'ডেড সি' বা মৃত সাগর বলে অনেক ইসলামিক স্কলার মনে করেন। এতটাই মর্মান্তিক আজাব দিয়েছিলেন আল্লাহ যে, আজো সে জনপদে কোনো প্রাণির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলামে সমকাম ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য পাপ, মহা অপরাধ। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, 'যাদেরকে তোমরা লুতের সম্প্রদায়ের কাজে (সমকামে) লিপ্ত দেখবে তাদের উভয়কেই হত্যা করো।' (তিরমিজি, ৫৭; আবু দাউদ, ২৬৯; ইবনে মাজাহ, ৮৫৬)।

মাদ্রাসাগুলোতে সমকামিতা তথা শিশু বলাৎকার মহামারী রুপ নিয়েছে। মসজিদের মধ্যে বলাৎকার, ধর্ষণ হচ্ছে। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, 'আমি আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা আশঙ্কা করি সেটা হলো লুতের উম্মত যা করত সেটার অনুসরণ করা।' (তিরমিজি, ১৪৫৭)

ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, `Charity begins at home' অর্থাৎ `আগে ঘর, তবে পর'। সেবা, সংস্কার পরিবর্তন নিজের ঘর থেকে শুরু করতে হবে। মামুনুল হকরা এ বিষয়ে নীরব যদিও এমন ক্রমবর্ধমান ঘটনায় মাদ্রাসা ও আলেম সমাজের প্রতি জনগণের আস্থার পারদ দ্রুতলয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। ভাস্কর্য ইসলামবিরোধী বলে উচ্চকিত হবেন, মাদ্রাসার বাইরে সমকামিতার পক্ষে কাজ করার জন্য সন্ত্রাসী হত্যাকে সমর্থন করবেন আর মাদ্রাসা-মসজিদের সমকামীতার বিষয়ে নীরব থাকবেন এমন বৈপরীত্য সন্দেহমুক্ত থাকবে কী করে?

সাত. বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলতে শাপলা চত্বরের পুনরাবৃত্তির হুমকি দিয়েছেন মাওলানা মামুনুল হক। ঢাকার প্রবেশমুখ অবরোধের কথা বলে শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতি চাওয়া, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমাবেশের অনুমতি পাওয়ার পর সেখানে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানের সিদ্ধান্ত মিথ্যা, প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ। সড়কদ্বীপের গাছ কাটার জন্য মেশিন-করাত ব্যবহার, লোহার রেলিং ভাঙার জন্য হাতুড়ি-শাবলের ব্যবহার, অগ্নিসংযোগের জন্য গান পাউডার ও পেট্রলের ব্যবহার, পবিত্র কোরান ও হাদিসসহ ধর্মগ্রন্থ, তসবি, টুপি, জায়নামাজ পেড়ানো, ব্যাংকের বুথ ভাঙা, লুন্ঠণ, তাণ্ডব এর সবকিছুই পরিকল্পিত সন্ত্রাস। সমাবেশের নামে সন্ত্রাস সরকার উৎখাতের বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। তাণ্ডব-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশনের পর হাজার হাজার মৃত্যুর মিথ্যা প্রচারণা কোনও মুমিনের কাজ হতে পারে না। ভয়ংকর শাপলা চত্বরের পুনরাবৃত্তির হুমকি নানা সন্দেহকে ঘনীভূত করে। ইসলামবিরোধী বলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দিলেও সৌদি আরবসহ অনেক ভাস্কর্যওয়ালা দেশ থেকে আমাদের মাদ্রাসাসমূহ নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। তাই সন্দেহ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতার আড়ালে 'ষড়যন্ত্র ভাস্কর্য' নির্মাণ চলছে না তো?

বাংলাদেশে ইসলামী শাসন চলছে না। অসংখ্য ইসলামবিরোধী কাজ চলছে। আলেমসমাজের অনেকেই নানা ইসলামবিরোধী কাজে লিপ্ত কিংবা নির্লিপ্ত। উদাহরণস্বরুপ, সমকামিতা, ইসলামে নানা দল-উপদল সৃষ্টি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ও আইন করে এর বিচার বন্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করা ইত্যাদি। ইসলামে ঐক্যবদ্ধ থাকা ফরজ। যে কোন ভিত্তিতেই ইসলামে দল-উপদল তৈরি করে বিভক্ত হওয়া নিষেধ। আল্লাহ বলেন, "আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।" (সূরা আল ইমরান: ১০৩) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, "নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপার আল্লাহ তা`আয়ালার নিকট সমর্পিত। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) বলে দেবেন যা কিছু তারা করে থাকে।" (সূরা-আন'আম: ১৫৯)

যার সাথে রাসূল (সা.) কোনো সম্পর্ক নেই সে কেমন মুসলিম? আমাদের আলেমসমাজ বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি করে ইসলামের নামে দলাদলি ও বিভাজন করে ভয়ংকর শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছেন মুসলিমদের মাঝে। কেবল ভাস্কর্য ইসলামবিরোধী বলে হঠাৎ হুংকার, হুমকি নানা সন্দেহের সৃষ্টি করছে। সে সাথে প্রতিরোধের হুমকি রক্তপাতের আশংকাকে প্রবল করে তুলছে। ভানকরা বঙ্গবন্ধু ভক্ত সেজে ভাস্কর্য নির্মাণ প্রতিরোধ কিংবা ভেঙ্গে ফেলার হুমকির প্রয়োজন নেই। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসুন। কেবল ভাস্কর্য নয়, ইসলামবিরোধী সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ করুন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ঘিরে বিচ্ছিন্নভাবে মাঠ গরম করে সংঘাত-রক্তপাতের আশংকাকে উসকে দিবেন না।