ভাস্কর্য বিতর্ক: রাজপথে হেফাজত, পর্দার আড়ালে বিএনপি-জামায়াত?

সুলতান মির্জা
Published : 2 Dec 2020, 01:08 AM
Updated : 2 Dec 2020, 01:08 AM

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে প্রথমত সম্প্রতি ফ্রান্সবিরোধী ইস্যুতে বাংলাদেশে আন্দোলনের কথা বলতেই হচ্ছে। বিশেষ করে সারাদেশেই কমবেশি কোনও এক শুক্রবারে জুমার নামাজ শেষে জঙ্গি মিছিল-মিটিংয়ের বেশ কয়েকটি জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছে বা উপস্থিত থেকেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের অতি উৎসাহী নেতাকর্মীরা। এদের অনেকেরই আওয়ামী রাজনীতির বয়স মাত্র তিন থেকে চার বছর। এতে পাপ হয়েছে নাকি পুণ্য হয়েছে- সেই বিতর্ক ভিন্ন।

তবে যেহেতু ফ্রান্স ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল নিরপেক্ষ; সেহেতু ইচ্ছা করলেই আওয়ামী লীগের কোনও পর্যায়েরই কোনও স্তরের নেতাকর্মী ফ্রান্সবিরোধী কোনো আন্দোলনে অংশ নিতে পারেন না।

অর্থাৎ, যেসব নেতাকর্মী ফ্রান্সবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এরা প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শ উপেক্ষা করেছেন। একটু খোঁজ করলে দেখা যাবে, এদের অনেকেই ওই বছর তিন-চারেক আগে বিএনপি বা জামায়াতের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। মধুর লোভে মাছির মত এখন এসে জুটেছে সরকারি দলে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি আলোচনায় আনতে চাই সেটি হলো- ওয়াজ মাহফিল ইস্যু; বাংলাদেশে ধর্ম ব্যবসায়ীদের বাম্পার ফলন হয়েছে; আর ধর্মকর্মের মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সারাদেশের বিভিন্ন স্তরের স্থায়ী, অনুপ্রবেশকারী, বহিরাগত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ধর্মীয় আবেগ ও অধিক সওয়াবের আশায় প্রধান অতিথি হচ্ছেন। বিশেষ অতিথি হচ্ছেন। এরা কয়েক মিনিট বক্তৃতা দেওয়ার লোভে গত ৫-৭ বছরে জামায়াতি মওদুদীবাদ তথা ওয়াহাবি সালাফিজম, হেফাজতের ভারতীয় দেওবন্দিবাদের দর্শন প্রচার ও প্রসারে বেশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

এসব ওয়াজে মাহফিলের প্রধান বক্তা জুনায়েদ বাবুনাগরী, মিজানুর রহমান আজাহারী, তারেক মনোয়ার, আমির হামজা, মামুনুল হক, গোলাম রাব্বানী, লুৎফুর রহমানসহ আরো অসংখ্য জামায়াতি হেফাজতি বক্তা। যারা আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতেই দুই লাইন আরবি বাক্যের মধ্যে আকারে ইঙ্গিতে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ, সরকার, প্রশাসনবিরোধী নানান বক্তব্য উপস্থাপন করেছে এবং করছে। ইনিয়ে বিনিয়ে ফাঁসি হওয়া রাজাকারদেরকে 'আলেম' দাবি করেছে, রাষ্ট্রের আইন ও বিচারিক ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে জনমনে নতুন বিভ্রান্তি ঢুকিয়েছে। ভ্যাকসিনেশন, জন্মনিয়ন্ত্রণসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবৈজ্ঞানিক ও আজগুবি কল্পকাহিনী প্রচার করে মানুষের মনে ভীতি ঢুকিয়েছে। নারী শিক্ষা, নারীদের কর্মসংস্থান, নারী জাগরণ নিয়ে মানুষের মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছে।

এসবের পাশাপাশি নিয়মিত আয়োজন হিসেবে যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী, উগ্রবাদীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং ভিন্ন ধর্মের মানুষ ও তাদের ধর্মীয় আচার রীতি নিয়ে এক ধরনের ঘৃণা বিদ্বেষের চাষাবাদ তো আছেই। আর সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের অতিথি নেতারা তা মন দিয়ে শুনেছে। নীরবে সমর্থনও দিয়ে গেছে।

উপরের দুটো ইস্যু তুলে ধরাটা প্রাসঙ্গিক আজকের লেখায়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান চৌধুরী, তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী এতে সন্দেহ নাই। তবে তার বর্তমান অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনা, দলের প্রতি আনুগত্য ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

যেদিন বীর চট্টলার হাজার হাজার নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের প্রশ্নে ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদী উগ্রবাদী মামুনুল হককে প্রতিহত করতে রাজপথে নেমে এসেছিলেন, ঠিক সেই সময় হাটহাজারীর ওয়াজ মাহফিলে জুনাইদ বাবুনগরী কারো 'আব্বার ভাস্কর্য' টেনে ফেলার কথা বলে ওয়াজ করেছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে নোমান চৌধুরী সেই বাবুনগরীকে উল্টো ধন্যবাদ জানিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন!

পরবর্তীতে তার স্ট্যাটাসের ব্যাখ্যা আর মন্তব্য পড়ে যা বুঝলাম, নীতি-নৈতিকতা, দলীয় আদর্শ বা বঙ্গবন্ধু তার কাছে কোনো বিষয়ই নয়, তিনি (নোমান) চেয়েছেন হেফাজত আর আওয়ামী লীগের মাঝে যেন কোনো ঝগড়া না হয়- সে কারণেই ওই ধন্যবাদ দেওয়া! দেশে ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদীদের উত্থান ঘটছে এতে নোমান সাহেবের কোনো সমস্যা নেই, বরং তিনি সেইফ জোনে থাকতে চান। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বাবুনগরীরা ভেঙে ফেলবে- ফেলুক, কিন্তু এই মুহূর্তে যেন আওয়ামী লীগ ভার্সেস হেফাজতের কাইজ্যা না হয়!

মূল আলোচনা

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলে হেফাজত যে ১৩ দফা দিয়েছিল, অর্থাৎ একটি জঙ্গি, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও অকার্যকর বর্বর রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য যা যা দরকার তার সবই ছিল সেই ১৩ দফায়। যার কোনো একটি দফায় ছিল- ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা। এখানে একটা কথা অপ্রাসঙ্গিক নয়, হেফাজতের সাবেক প্রধান আহমদ শফী বেঁচে থাকতে প্রায় প্রতিদিনই একটা কথা বলতেন, "হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, হেফাজত কাউকে ক্ষমতায় বসাতে আসেনি, কাউকে নামাতে আসেনি…"। অথচ, ২০১৩ সালের ৫ মে- সেদিন হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব বর্তমান প্রধান জুনাইদ বাবুনগরী আতর সুরমা লাগিয়ে এসেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন করতে, বঙ্গভবনে মন্ত্রীর শপথ নিয়ে হাটহাজারীতে ফিরবেন বলেই।

কিন্তু বিধিবাম, বাবুনগরীর সেই আশা পূরণ হয়নি। তবে পরের সপ্তাহে বের হয়ে এসেছিল থলের বেড়াল। হেফাজতের মতিঝিল আন্দোলন ছিল বিএনপি-জামায়াতের কাছে বিক্রি করে দেওয়া আন্দোলন। অর্থাৎ, প্রয়াত আহমদ শফী সাহেব কিংবা বর্তমান বাবুনগরী দুইজনের কথাই সঠিক। হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, হেফাজত কাউকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বা ওঠাতে আন্দোলন করে না, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ঈমানী আন্দোলন করে, তবে দরদামে পোষালে হেফাজত অনেক কিছুই করতে পারে।

নাস্তিকতা প্রসঙ্গ: কারা নাস্তিক?

বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায়' ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন দুইজন। তাদের নাম পরিচয়, কাজ-কর্মের কথা উল্লেখ করলে সর্ব প্রথম আলোচনা করতে হবে তাদের পেশা কী? তারা সারাদিন কী কাজ করেন? তাদের সোর্স অব ইনকাম কী? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ জানতে চাইলে তার কপালে জুটবে কমন একটা উপাধি- 'নাস্তিক'! তাদের বা তাদের সমর্থক ভক্তরা বলতেই থাকবে- 'নাস্তিক' 'তুমি একজন নাস্তিক', 'তুমি ইসলামের শত্রু', 'মৃত্যুর পর কবরে তোমার কঠিন বিচার হবে'… ইত্যাদি। আরও পরিষ্কার করে বললে, 'আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী ছাহেব' না লিখে যদি শুধু 'বাবুনগরী' লিখেন তাহলেও তিনি নাস্তিক, কবরে তার কঠোর বিচার হবে, জাহান্নাম নিশ্চিত।

ধর্মের এই ঠিকাদারি নেওয়া, ফতোয়া দেওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে হেফাজতের। হেফাজতকে ঢাকা চিনিয়েছে জামাতের সহযোগিতায় বিএনপি। সেই হেফাজত ভোগ করছে আওয়ামী লীগের দেওয়া রেলের জমি। তারপরও তারা আবার সক্রিয়, কেন? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে গত কয়েকদিনের কর্মকাণ্ডে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে দেশে বিদেশে বিএনপি-জামায়াতের চক্র সক্রিয় কাজ করছে। এইসব চক্রের সৈনিক কারা? কোথায় পাওয়া যাবে এদের? এদের সক্রিয় সৈনিকদের পাবেন ফেইসবুক আর ইউটিউবে। এরা ইচ্ছা করলে ফেইসবুক-ইউটিউব দিয়েই বাংলাদেশে ধর্মের নামে 'রেভ্যুলেশন' করে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটাতে পারে বা কাছাকাছি অবস্থায় চলে গেছে বলে ভাব নেয়; গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরউল্লাহর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। একটু নড়াচড়া দিলেই নাকি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়ে যাবে!

তো এখন উপায়? ভাঙা হাট জমে না, ফলে বিএনপি জামায়াতের ব্র্যান্ড এইখানে চটক দেখাতে পারছে না। একদিকে করোনাভাইরাস মহামারী, সাধারণ পর্যায়ে অর্থ সংকট চলছে। তাই মোক্ষম সুযোগ, সরকারকে চটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অনেক বড় ও দুর্বল একটা বিষয়। মুজিব বর্ষে সরকার চটে গেলেই জাফরউল্লাহ গং একটা ধাক্কা দেবে, আগে থেকেই আওয়ামী লীগার সেজে বসে থাকা বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা ভাস্কর্যের কুফল লীগারদের বোঝাবে। হলো তো? বিএনপি জামায়াতের হাতে রিমোট, মামুনুল-জুনাইদ বাবুনগরী অ্যাকশনে নেমে গেল…।

ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়

যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক করছেন, তারা ভাস্কর্যকে মূর্তির সাথে মিলিয়ে ফেলছেন। নতুন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ভদ্রলোক আরো একধাপ এগিয়ে। তিনি আলাপ আলোচনা করে ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়- বিষয়টা সমাধান করবেন। আজব ব্যাপার! যেসব রাজ নেতারা নানান হিসেব মিলিয়ে দেখে বুঝে ভাস্কর্য মূর্তির ব্যাখ্যা হাজির করছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন, কাকে বোঝাচ্ছেন? কেন বোঝাচ্ছেন? কেন তারা আপনার এই বোঝানো যুক্তি বুঝতে বাধ্য? তারা যখন ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে, তখন কি আপনাদের সাথে বুঝেশুনে কথা বলে দিয়েছিল? কেন আপনি বলতে পারছেন না, ভাস্কর্য ও মূর্তি দুটোই থাকবে।

বঙ্গবন্ধু থাকবেন, রবীন্দ্রনাথ থাকবেন, জাতীয় চার নেতারা থাকবেন, সেক্টর কমান্ডাররা থাকবেন, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরপ্রতিক সকলের ভাস্কর্য থাকবে। থাকবে দুর্গা, গণেশ, লক্ষ্মী সরস্বতী, বিষ্ণুসহ হিন্দু ধর্মের দেবদেবীগণ, থাকবেন যিশু, মেরি, গৌতম বুদ্ধ, অতীশ দীপঙ্কর… এর প্রতিমা; থাকবে ময়মনসিংহের শশী লজ, নাটোরের উত্তরা গণভবনের গ্রিক নারী ভাস্কর্যসহ সকল ধরনের ভাস্কর্য, মূর্তি, প্রতিমা, স্থাপনা, স্কাল্পচার ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। যার ভাল না লাগবে সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। দুর্বলতার সুযোগ কোথায়? বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেবে বলার সাহস কোথা থেকে পেল ওরা? তাদেরকে গোণায় ধরার কী আছে? একাত্তরের রণাঙ্গনে যারা দেশের পক্ষে অস্ত্র ধরেনি, দেশ স্বাধীনে যাদের রক্ত ঝরেনি, এ দেশ কীভাবে চলবে, এখানে কী থাকবে, না থাকবে- সেসব বিষয়ে তাদের ও বংশধরদের মতামতের দাম কানাকড়িও না।

৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীরউত্তম, ১৭৫ জন বীরবিক্রম, ৪২৬ জন বীরপ্রতীকের মাঝে একজনও মাওলানা, মুফতি, মুফাচ্ছির বা হুজুর নাই। কোনো মাদ্রাসা হুজুর তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি ইউনিট তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এমন কোনো নমুনা নাই। বরং উল্টোটাই দেখা গেছে, ধর্ম ব্যবসায়ীরা হাত মিলিয়েছে পাকিস্তানি সৈনিকদের সাথে। খুন, ধর্ষণ, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী অপহরণসহ হেন কোনো যুদ্ধাপরাধ নাই, যার সাথে তারা জড়িত ছিল না সে সময়। তাহলে সে সব অমানুষদের বর্তমান প্রজন্ম কীভাবে ইসলামের ঠিকাদারি নিয়ে এই দেশের স্বাধীনতার স্থপতির নামে বিষোদগার করার সুযোগ পায়। এর পুরো দায়টা আমাদের।

ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদী জঙ্গিদের আখড়া হেফাজত-বিএনপি-জামায়াত- কী চায়? ইসলামকে হেফাজতের ঠিকাদারি তাদের কে দিল?

অরাজনৈতিক সংগঠনের দাবিদার হেফাজত চায় ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে নাস্তিকদের বিচার নিশ্চিত করতে! অস্থির সময়ের অস্থির জিজ্ঞাসা- আসলে কারা সেই নাস্তিক?

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, ধর্মে কর্মে বিশ্বাসী একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে তৎকালীন হেফাজতের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী, তার মহামূল্যবান ধর্মীয় বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীকে 'নাস্তিক' সম্বোধন করে, 'কোথায় পালাবে' বলে হুমকি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া মামুনুল হক- পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী আজিজুল হকের ছেলে;

এই মামুনুল ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের সমাবেশের বক্তৃতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে 'নাস্তিক' সম্বোধন করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'নাস্তিক্যবাদের সরকারপ্রধান' সম্বোধন করে, 'কোথা দিয়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ ছেড়ে পালাবে' বলে হুমকি দিয়েছিল। আবারো প্রশ্ন- নাস্তিক কারা?

আজকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক চলছে, স্বাধীন বাংলাদেশে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক, বিতর্কের জবাব দিতে গিয়ে এক ধরনের সস্তা যুক্তি উত্থাপিত করছে বাঙালি জাতির পিতার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে কচিপাতি নেতারা। যুক্তিটা কী?

একটা কথা বলি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের যারা এই লেখাটা পড়বেন তাদের বলছি, লিখে রাখুন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ওই সময়ের বাংলাদেশি ধর্ম ব্যবসায়ী মামুনুল, ফয়জুরদের বাপ-চাচারা বলেছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য নাস্তিক্যবাদী ভিন্ন দেশের আন্দোলন। 'মুক্তিযুদ্ধ' বলত না তারা, বলত 'গণ্ডগোল'! বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা সব সময় 'নাস্তিক' ডাকত। যদি তথাকথিত আলেম নামধারী মামুনুল, বাবুনগরী, ফয়জুলদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের কলিজা কেটেও খেতে দেন, তারা সেই কলিজা খাওয়া শেষে হাত ধুতে ধুতে বলবে- তিনি 'একজন নাস্তিক। তার বিচার চাই…।' এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে জুনাইদ বাবুনগরী, মামুনুলদের চেপে না ধরে কিসের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে?

বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এক অনন্য মর্যাদাশীল রাষ্ট্রের কাতারে তুলে ধরার জন্য যা যা প্রয়োজন, সম্ভাব্য সব দিকেই কাজ করছে। বিভিন্ন মানদণ্ডে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়ে আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার জরিপে অনেক উঁচুতে অবস্থান করছে ক্ষমতাধর অনেক দেশের তুলনায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মাঝে এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়, এটা এখন আর কাউকে আন্দোলিত করে না- বিভিন্ন গবেষণা জরিপ বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে এ এক নিত্যদিনের চিত্র।

এমন অবস্থা খুব স্বাভাবিকভাবেই পূর্বেকার সরকার, বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ অনেকের গাত্রদাহের কারণ হবেই। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে, অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্যসহ উন্নয়নের সর্বক্ষেত্রেই তাদের স্যাবোটাজ করার প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যত দুর্নীতি, অপকর্মের সন্ধান মিলছে, এর সাথে জড়িতদের যত খবর উঠে আসছে, একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায়- জড়িতদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটের ঘনিষ্ঠ। দেশের কোথাও কোনো অপরাধের সাথে জড়িতদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। নব্য লীগার কাউকে পাওয়া গেলেও পারিবারিকভাবে সেই পুরনো চক্রেরই কেউ না কেউ থাকবে। এভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উন্নয়নের নৌকার তলদেশ ফুটো করতে ব্যস্ত একটা গোষ্ঠী।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তাই যে বিপুল বিক্রমে এগিয়ে যেতে চান জননেত্রী শেখ হাসিনা, ততই একটা ভারী শিকল তার পায়ে আটকে যাচ্ছে, কমিয়ে দিচ্ছে তার অগ্রযাত্রার গতি। আর এই শিকলগুলোর একটা হলো ধর্মব্যবসা। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে যেকোনো কিছু করা সম্ভব। উপমহাদেশে ইতোপূর্বে ধর্মীয় হুজুগ তুলে অনেক অনেক অপকর্ম ও নৃশংসতাকে জায়েজ করা হয়েছে। ধর্মের নামে মানুষহত্যা খুবই সাধারণ ব্যাপার এখানে। একাত্তরে এ দেশে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ গেছে শুধু স্বাধীন বাংলাদেশকে ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কারণে। পাকিস্তান কায়েম করার অর্থ ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখা- এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রকাশ্যে বা নীরবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে কোটি মানুষ। যাদের বংশধররা আজও পূর্বপুরুষের বিশ্বাসে অটল। আর তারাই বাংলাদেশের কোনো সাফল্যে গৌরব বোধ করে না। কথায় কথায় তারা ইসলামকে পুঁজি করে মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব। যার আগুনে পুড়তে পুড়তে স্বাধীনতার পর থেকে সহায় সম্বল ফেলে দেশ ছেড়েছে আমাদেরই আশপাশের লাখো মানুষ। ফলে একটা সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা গেছে কমে, গাণিতিক হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা বেড়েছে। আর এই বর্ধিত জনসংখ্যার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে ধর্মব্যবসায়ীরা, তারা একে বলছে 'ইসলাম কায়েম হচ্ছে বলে সংখ্যায় বেড়েছে মুসলিম'!

ক্রমশ এই ধর্মের ঠিকাদাররা নিজেদের অবস্থান সমুন্নত করতে রাষ্ট্রকে খৎনা করতে চাইছে। দেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ একটি মুসলিম হলেও, তারা বলতে চায়- ধর্ম নাকি বিপন্ন! হাজারো দল উপদলে বিভক্ত এসব ধর্মব্যবসায়ীদের প্রত্যেকেই নিজেদেরকে দাবি করে ধর্মের একমাত্র অথেন্টিক রক্ষাকর্তা হিসেবে। প্রত্যেকটা সংগঠনের মাঝে মৌলিক বিভক্তি এবং তরিকাগত পার্থক্য থাকলেও নিজেদেরকে তারা একমাত্র অথরাইজড রক্ষাকর্তা বলে দাবি করে। ঠিকাদারি ব্যবসার ভাগিদার বেশি হলে অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি হয় যেমন, তেমনি নিজেদের শক্তিমত্তা অন্যের চাইতে বেশি- এটা প্রমাণ করতে হলে মাঝে মাঝেই নানাবিধ ইস্যু সৃষ্টি করে সবাইকে জানান দিতে হয়- আমরা আছি।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে সমস্যা, নাটক সিনেমায় অভিনয়ে 'কবুল' বলা নিয়ে সমস্যা, ওয়েব সিরিজে সমস্যা, কুসুম শিকদারে গানের দৃশ্যায়নে সমস্যা, জয়া আহসানের কুকুরপ্রীতিতে সমস্যাসহ সব কিছুতেই তারা জ্বলে ওঠেন! শুধু নিজেদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনাচার, খুন, ধর্ষণ, বলাৎকার, মারামারি- এসব নিয়ে তারা পুরোপুরি নীরব। শুধু এই জায়গায় তাদেরকে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। কেন? অথচ ফেইক আইডি খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বার্তা পাঠায় তারা- "অমুক গ্রামের তমুক পবিত্র গ্রন্থে পা রেখে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছে। তাকে প্রতিহত করি, চলুন তার ফাঁসি চাই, 'নাস্তিক' এর বাচ্চাকে …. করে আসি। এই বার্তা ১০০ জনকে পাঠান যদি মুসলমান হয়ে থাকেন। 'কাফের' হলে চুপ থাকুন।" এসব বিষোদগার চর্চা চলমান যুগ যুগ ধরে।

মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলাধুলা করা এই ধর্মের ঠিকাদার ব্যবসায়ীরা চায় না লোকজন সত্যিকার শিক্ষিত হোক, আত্মসচেতন হোক, আধুনিক শিক্ষা, বিজ্ঞানের চর্চায় এগিয়ে যাক। তাতে ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাঁদা বা ভিক্ষার পরিমাণ কমে যাবে, ওয়াজে লোকজনের উপস্থিতি কমে যাবে। হেলিকপ্টারের ভাড়া দূরে থাক, লোকজনকে বোকা বানিয়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে ভুয়া কল্পকাহিনী শুনিয়ে পয়সা হাতানোর পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা নিজেদের ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায় অন্ধকার যুগে। আর সেজন্য নানা ইস্যু সৃষ্টি করা জরুরি।

এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাঁধে বন্দুক রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার চোরাগলি খুঁজছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে কিন্তু বিএনপি-জামায়াত এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সাড়াশব্দ শোনা যাচ্ছে না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য দেশে টিকে রয়েছে অনেক বছর। কিন্তু সেই ভাস্কর্য নিয়ে বিশদলীয় জোটের শরিক ধর্মীয় দলগুলো কখনও আপত্তি জানায়নি। সেই বিশদলের শরিক খেলাফত মজলিসের নেতারা আজ সোচ্চার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। ভাস্কর্য ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের মুখে কুলুপ দেখেও তো স্পষ্ট হয় অনেক কিছু। এখানেই রাজনৈতিক স্বার্থ খুঁজে পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মের আচার রীতি নিয়ে কটূক্তি করা বিএনপির গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী এবং 'মুক্তিযোদ্ধা' এবং জামায়াতের সকল প্রোগ্রামের নিয়মিত উপস্থিতি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ হুমকি দেওয়া ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলতে শোনা যায়নি।

ডান-বাম সকল সংগঠন, ধর্মীয় দল, উপদল, রাজনৈতিক গোষ্ঠী একমাত্র একটাই গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নে বিভিন্ন দায়িত্বে রত। সবার লক্ষ্য একটাই- রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আরোহন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মান্ধদের হুংকার শুনলে মনে হবে দেশের ১৭ কোটি জনগণ বুঝি তাদের পাশে! অথচ রাস্তায় দেখা যায় পুলিশের হুইসেল শুনলে কাপড়-চোপড়, জুতা রেখে পালিয়ে যাচ্ছে জিহাদি জোশে 'রক্ত দিতে প্রস্তুত' সেই হুমকিদাতারা। এই ধর্মান্ধগোষ্ঠীর অনুসারীদের সংখ্যায় সব মিলে ৫০ লাখের বেশি নয়। কিন্তু অনলাইনে তাদের হুংকারে টেকা দায়। তারা বাদ বাকি সাড়ে ১৬ বা ১৭ কোটি মানুষকে আখ্যা দেয় 'নাস্তিক' বলে! ভাস্কর্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা কোরান হাদিসের অপব্যাখ্যা দেয়।

ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিশর, সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মরক্কো, আরব আমিরাত, ওমানসহ বিশ্বের সকল মুসলিম দেশের হাজার হাজার ভাস্কর্যের দৃষ্টান্ত দিলে, সেসব দেশের বড় বড় ইসলামিক স্কলার, গ্র্যান্ড মুফতি, মুহাদ্দিসদের ভাস্কর্যের সমর্থন করা এবং ভাস্কর্য স্থাপন সংক্রান্ত ফতোয়ার দৃষ্টান্ত দিলেও সন্তুষ্ট নয় বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা। তাদেরকে যদি বলা হয়- মুসলিম বিশ্বের স্বনামধন্য মুফতি শায়েখদের ইসলামি জ্ঞান কি বাংলাদেশের মোল্লাদের চাইতে কম? সেসব গ্র্যান্ড মুফতিরা কি বাংলাদেশের মাদ্রাসার তালেবেলেমদের চাইতে ইসলাম কম বোঝে? – এসব প্রশ্ন করলেই আপনি হয়ে যাবেন তাদের ভাষায় 'নাস্তিক'। সংঘাতের সূচনা এখান থেকেই।

আমাদের অনেকেই ইসলামের আলোকে এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের বোঝাতে চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন ইসলামের এই ঠিকাদাররা হয়ত 'গোমরাহি'তে নিমজ্জ, তাই ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছেন; আদতে তা কিন্তু নয়, তারা সবই বোঝেন, জানেন। কিন্তু তাদের ওস্তাদরা- যারা নিজেদের ইমান আমল সব কিছু বিকিয়ে দিয়েছেন রাজনীতির বাজারে, তাদের নির্দেশ অনুসারে দেশবিরোধীতা করতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অন্যদেরকে 'কাফের', 'নাস্তিক' আখ্যা দিতে। নিজেদেরকে অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও তাদের কাফেলার লক্ষ্য একটাই- রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।

আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী একমাত্র রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ সরকারকে ঠেকাতে হবে, যেকোনও মূল্যে। প্রয়োজনে ধর্মকে পুঁজি করে হলেও দেশকে অস্থিতিশীল করে, আফগানিস্তান বা পাকিস্থানের মতো ব্যর্থ ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে হলেও। মূলত হেফাজতের কাঁধে বন্দুক তুলে দিয়ে আড়াল থেকে শিকার করছে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো।

এই বিষবৃক্ষ উৎপাটনে সাধারণ মানুষ যতটা সক্রিয়, ততটাই নিষ্ক্রিয় খোদ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ। ক্ষমতার মোহে অন্ধ এবং ক্ষমতার বলয়ের কাছাকাছি থাকতে আগ্রহী 'সহমত ভাই'রা ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারে না, কারণ নিজেরাই নিশ্চিত নয়- তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মেনে চলবে, নাকি মোল্লাতন্ত্রের রাস্তায় হাঁটবে। আগে মানুষ, তারপর বাংলাদেশি, বাঙালি এবং মুসলিম হবে- নাকি আগে মুসলিম, পরে বাঙালি এবং মানুষ হবে- এর গূঢ় অর্থটাও বুঝতে অক্ষম তারা। বঙ্গবন্ধু কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, মুজিববাদ কী- এসব আজ তাদের কাছে অচল হয়ে পড়েছে, অথচ ভুল বানানে সোশাল মিডিয়ায় 'ওয়ার্কস এট আম্লীগ বা ছাএলিক' লেখা থাকে তাদের প্রোফাইলজুড়ে। অমুক ভাইর 'আদর্শ'ই তাদের 'আদর্শ', দলের 'আদর্শ' গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ধর্মের নামে জাতিকে বিভ্রান্ত করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের সৃষ্টি, সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝেছিলেন, ধর্মের বিষ কতটা ভয়ানক হতে পারে। আর সেজন্য তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে করেছিলেন নিষিদ্ধ।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রাষ্ট্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেই বঙ্গবন্ধু দ্রুত সংবিধান প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেন এবং তার নির্দেশ ও পরামর্শে দেশের সংবিধানের মৌলিক নীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা হয়। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি গ্রহণের পর তা দেশে একশ্রেণির রাজনীতিকদের বিরোধিতার মুখে পড়েন। এমনকি মাওলানা ভাসানী, যিনি নিজেও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি পর্যন্ত সরকারের এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এদেশে সব ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী তথাকথিত ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এসব দলের শীর্ষ নেতাদের নাগরিকত্ব বাতিল এবং কারও কারও বিরুদ্ধে কোলাবোরেটর আইনে মামলাও করেছিলেন। এর ফলে সে দলগুলো প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা করতে না পারলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতায় নেমে পড়ে। তারা 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে 'ধর্মহীন'তা বলে অপপ্রচার শুরু করে।

ঘাতকরা সোনার বাংলার স্বপ্ন শেষ করে দিতে চেয়েছিল ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। যা ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো মহত্তম আদর্শকে হত্যা। এরশাদের মতো দুশ্চরিত্র সেনাশাসকের কারণে বাংলাদেশের সংবিধানকে এখন 'রাষ্ট্রধর্ম' নামের বোঝাটি বহন করতে হচ্ছে। যা তার পূর্বসূরী মোশতাক-জিয়ার সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতির ফল। এই বোঝাটি দিন দিন এতোটাই ভারি হয়ে গেছে যে, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কথা মুখে বললেও অন্তরে বিশ্বাস করে না কেউ। ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনার চর্চাকারী মূলধারার স্রোত ক্ষীণ হয়ে আসছে।

আর সেই সুযোগটা নিচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। তারা বলে, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। 'ইমান ও আকিদাবিরোধী' কোনো কাজ করা যাবে না। এরাই আবার ভারতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ধর্মনিরপেক্ষতা চায়!

শেখ হাসিনার অর্থনৈতিকভাবে সবল রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা- মেট্রোরেল, সমুদ্রের তলদেশে টানেল, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু, যমুনা রেলসেতু, ইকোনমিক জোন, গভীর সমুদ্র বন্দরসহ উন্নয়নমূলক হাজারো কর্মকাণ্ড এই ধর্মান্ধদের মধ্যে কখনো কোনও ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। তাহলে কেন এই হাতেগোণা একটা বিশেষ শ্রেণিকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে? দেশের সার্বভৌমত্বের দিকে আঙুল তুলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অপমান করার সাহস করছে ওরা ধর্মের নামে। কেন তাদেরকে কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছে না, যেখানে সুস্পষ্টভাবে আইন রয়েছে? কেন তা প্রয়োগ করা হচ্ছে না? কেন এই বিষফোঁড়া গোষ্ঠীকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে? ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে বাঁধা কোথায়- সময় এসেছে ভেবে দেখার।