জীবন্ত সত্তা নদীকে বাঁচান, নিজেকে বাঁচান

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 1 Dec 2020, 03:59 PM
Updated : 1 Dec 2020, 03:59 PM

১.

জলের ধর্ম হচ্ছে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়া। এ পথ সে নিজেই তৈরি করে নেয়। সদা পরিবর্তনশীল পৃথিবী নামক গ্রহে কোনোকিছুই স্থির নয়। কোটি কোটি বছর ধরে পরিবর্তিত হতে হতে পৃথিবীর চেহারা এই অবস্থায় এসেছে। তবে এটি শেষ নয়। পরিবর্তনশীলতার ধারায় আজকের এই রূপ আগামীতে থাকবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে যাবে এর রূপ, ধরন এবং মানববসতি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। ফলে আগামী ১০০ বছর পর পৃথিবীর রূপ কী হবে, কী কী পরিবর্তন হতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। আজ যে পাহাড়, নদী, সাগর, হ্রদ দেখছি লক্ষ কিংবা কোটি বছর আগে তার অস্তিত্বই হয়ত ছিল না। বড় কোনো ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট পরিবর্তনের ফলে তার অনেক কিছুই আজকের রূপ নিয়েছে। হিমালয় পর্বতমালা গড়ে ওঠার পর তার গলিত পানির প্রবাহ নিচে নেমে আসার তাগিদে আজকের অনেক নদ-নদীর সৃষ্টি হয়েছে। ওপরের তরল পানি নিচে নেমে সর্বশেষে সাগরে পতিত হওয়ার পথ তৈরি করে নিয়েছে। লক্ষ কোটি বছর ধরে জলের সে গতিপথই আজকের নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে।

শুধু হিমালয় থেকে নয় যেকোনো উঁচু পর্বত বা পর্বতমালা থেকে নেমে আসা জলধারাই এক বা একাধিক নদী তৈরি করেছে।

২.

বাংলাদেশ ভাটির অঞ্চল। হিমালয় থেকে শুরু করে আমাদের উজানে থাকা পর্বতমালা থেকে নিসৃত জলধারা নদী হয়ে এদেশের বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই ভূখ- গড়ে উঠেছে উজান থেকে প্রবাহিত নদীর সাথে বয়ে আসা পলিমাটি দ্বারা।

গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, সুরমা-মেঘনা এবং এদের অসংখ্য উপনদী ও শাখানদী বাংলাদেশে নিষ্কাশন প্রণালীর ধমনীর মতো কাজ করেছে। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, ফেনী নদীসমূহ চট্টগ্রাম জেলা ও পার্বত্য অঞ্চলের জলধারাকে বঙ্গোপসাগরে পতিত করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৭০০ এর মতো নদী, উপনদী ও শাখা নদী আছে। এই নদীগুলো সারাদেশে রক্তের শিরা-উপশিরার মতো বহমান। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং মেঘনা এই নদীর মিলিত নিষ্কাশন অববাহিকার আয়তন প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। নদীগুলো বঙ্গোসাগরে বয়ে নিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণ পলি। ব্রহ্মপুত্র-যমুনাই শুধু প্রতিদিন ১,২০০,০০০ টন পলি বহন করে আনে। প্রতিবছর গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী প্রণালীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বয়ে আনা পলির পরিমাণ প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন।

বাংলাদেশের নদীগুলোর রয়েছে বিচিত্র গড়ন। বিচিত্র চরিত্র। ফলে সিলেট অঞ্চলের নদীর স্রোতে, চরিত্র ও গঠনের সাথে রংপুরের তিস্তার মিল পাওয়া যাবে এমন নয়। ফলে দেশে নদী ব্যবস্থাপনা করতে গিয়েও বিশেষজ্ঞগণ প্রতিটি নদীর জন্য আলাদা আলাদা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দাবি করে থাকেন। পলিমাটি দ্বারা গড়ে ওঠা এই ভাটির দেশের মাটি, পাহাড়, নদী, খালসমূহের গড়ন ও চরিত্রও ভিন্ন। মাত্র এক থেকে দেড় লক্ষ বছরের মধ্যে গঠিত বলে এই দেশের পাহাড়গুলো ভঙ্গুর। মাটিগুলো দোআঁশ প্রকৃতির। ফলে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতে এখানে প্রায়শ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। একেবারে ভাটির দেশ বলে সমস্ত নদ-নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা লক্ষ লক্ষ টন পলি এই দেশের মাধ্যমেই বঙ্গোপসাগরে পতিত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের উজানে ভূমিক্ষয় বেশি হওয়ার কারণে পলিমাটির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পলির সাথে অপচনশীল দ্রব্য মিশ্রিত হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত সব পলি সাগরে পতিত না হয়ে নদী ভরাটের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে নদী ভরাট হয়ে পানির ধারণক্ষমতা হারাচ্ছে ফলে বর্ষা বা অতিবর্ষণে নদীর দু-কূল ভাঙছে। চট্টগ্রামের নদ-নদীগুলোর অবস্থাও তাই। এই নদীগুলোও এখন ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পলি বহন করতে করতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

৩.

কবি বলেছেন, 'নদী আপনবেগে পাগলপারা' নদী তার আপন গতিতে চলতে অভ্যস্ত। তাই নদীতে বাঁধ দিলে, কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে সে তার স্বাভাবিক গতিপথ হারায়। প্রকৃতিতে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। চীন যখন ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ দেয় ভারত তখন তার বিরোধিতা করে। সেই ভারতই বুঝতে পারে না বা বোঝার চেষ্টা করে না আমাদের অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে আমাদের দেশের জলবায়ুর কী পরিমাণ ক্ষতি তারা করছে।

৪.

কর্ণফুলী নদী লুসাই পাহাড় থেকে সৃষ্ট। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে এই নদী রাঙামাটির পার্বত্য অঞ্চলের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় এসে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এই নদীর মোহনায় হাজার হাজার বছর ধরে একটু একটু করে এই সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠেছে। এই বন্দর প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বন্দর। আমরা জানি না কত হাজার বছর আগে কোন নাবিক সমুদ্র থেকে এই নদীতে প্রবেশ করে প্রথমে তার বাণিজ্য নৌকা কোন স্থানে নোঙর করেছিল। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই বন্দর বিভিন্ন শাসক ও সরকারের সময়ে একটু একটু করে উন্নয়ন হতে হতে আজকের এইরূপে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অন্য ৭ শত নদ নদীর সাথে প্রাকৃতিক ভৌগোলিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে কর্ণফুলী নদীর পার্থক্য আছে। এই নদীর উজানে কাপ্তাই নামক স্থানে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই নদীর মোহনায় দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। যার মাধ্যমে দেশের ৮৫ শতাংশ আমদানি-রপ্তানির কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে। কাজেই দেশের অন্য নদ-নদীর গুরুত্বের সাথে এই নদীর গুরুত্ব মেলানো যাবে না যদিও মানবসভ্যতার স্বার্থে যেকোনো নদীর অবদান অপরিসীম।

কর্ণফুলীর উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে এর গতি ব্যাহত হয়েছে। নদীর যে চরিত্র তা খানিকটা ব্যাহত হয়েছে। বাঁধের ফলে উজান থেকে বয়ে আনা পলি শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে পতিত হতে পারেনি। তা জমেছে বাঁধের উজানে। ফলে ৫ দশকের অধিক সময়কালে পলি জমতে জমতে এখন কাপ্তাই হ্রদও অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে। কমে গেছে তার পানি ধারণের ক্ষমতা। এই নদীর মোহনায় বন্দর থাকার কারণে এই নদীর নাব্যতা ঠিক রাখার বিষয়ে অধিক সচেতনতার প্রয়োজন থাকলেও তা আমরা যথাযথভাবে পালন করিনি। ফলে এই নদী এখন ভরাট ও দূষণে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। যে নদীর মোহনায় বন্দর বিদ্যমান তার কাছে কখনো নদীতে পিলার ব্রিজ নির্মাণ করা হয় না, পিলার ব্রিজের কারণে নদী ভরাট হয় বলে। কর্ণফুলী নদীতে যখন তৃতীয় পিলার ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় সে সময় চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের সঙ্গে তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী পিলার ব্রিজ নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সে সময় জোট সরকার এবং তার স্থানীয় মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা তা উপেক্ষা করে এখানে আরেকটি পিলার সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এর ফলে নদীতে 'সিলটেশন' হয়েছে। নদী ভরাট হয়ে গেছে। সেতুটি চাক্তাই খালের সন্নিকটে হওয়ায় নদী ভরাটের কারণে চাক্তাই খালের মুখটাও ভরাট হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে জোয়ার ছাড়া চাক্তাই খালে পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করতে পারে না। বন্দর সুরক্ষার স্বার্থে কর্ণফুলী নদী খনন বা ড্রেজিংয়ের কাজ নিয়মিত করা দরকার হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে মালয়েশিয়ান ড্রেজিং কোম্পানির মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় এই খননের কাজ বন্ধ ছিল বছরের পর বছর। কয়েক মাস আগে এই জটিলতার অবসান হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌবাহিনীর সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।

৫.

মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ ২০১০ সালে একটি রিট দাখিল করেন। দফায় দফায় শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ অগাস্ট কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, হাইকোর্টের সেই আদেশ এখনও বাস্তবায়ন তো হয়ইনি বরং দিন দিন গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা।

হাইকোর্টের সেই আদেশ বাস্তবায়ন না করার বিষয়টি রিটকারী আইনজীবী আদালতের নজরে আনলে ২০১৮ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র, জেলা প্রশাসন, পুলিশ কমিশনার, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সিডিএ চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিআইডব্লিউটিএ'র চেয়ারম্যানসহ আটজনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সেই রুলের সপ্তাহ তিনেক পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন উক্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সে বছরের ২৮ জুলাই নোটিশ জারি করেন। এরপর ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মহাসমারোহে নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। মাঝখানে বিরতি দিয়ে ২৭ অগাস্ট নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওইদিন মাঝিরঘাট এলাকায় ১০ একর জমি পুনরুদ্ধার করা হয়।

এরমধ্যে কর্ণফুলী নদীর তীরে নতুন করে খাস জমি দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। নগর প্রান্তে নতুন ব্রিজের পশ্চিম পাশে সরকারি খাস জমিতে স্ট্যান্ড বানিয়ে বাস, ট্রাক দাঁড় করানো হচ্ছে। এসব মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নাম দিয়ে ট্রাকের কাছ থেকে চাঁদাও আদায় করছেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন সাংবাদিককের কাছে। দখল ও অনিয়ম প্রক্রিয়া এখনো থেমে নেই। নতুন ব্রিজের নিচে নতুন করে অবৈধ ঘাট বসানো হয়েছে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের রাজস্ব শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, নগরপ্রান্তে কর্ণফুলী নদীর ঘাটগুলো সিটি করপোরেশন ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায় করে আসছে। কিন্তু নতুন ব্রিজের নিচে বসানো ঘাটটি অবৈধ হওয়ায় এই ঘাট থেকে কোনো রাজস্ব পায় না সিটি করপোরেশন।

দখল-দূষণের শেষ নেই কর্ণফুলীতে। এর পাড়ে অবৈধ একটি ইটভাটাও আছে। আট বছরেও উচ্ছেদ হয়নি ইটভাটাটি। যদিও বিধি মোতাবেক সিটি করপোরেশন এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নির্মাণের নিয়ম নেই। তবে অনেকটা প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তোলা ইটভাটাটি উচ্ছেদে কার্যকর ভূমিকাও নেই প্রশাসনের। শাহ আমানত সেতু লাগোয়া ওই ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও এটিকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে তুলছে অনেকে।

এই ইটভাটা গড়ে ওঠার পেছনে চমকপ্রদ ইতিহাসও আছে। চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর 'ক্যাপিটাল ড্রেজিং অ্যান্ড ব্যাংক প্রটেকশন' প্রকল্পের কাজ পায় আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং করপোরেশন। প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিস নামের স্থানীয় এজেন্ট ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ওই সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় এজেন্ট ড্রেজিং কাজের পাশাপাশি কর্ণফুলীর পাড়ে গড়ে তোলে এই ইটভাটা।

২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ আলমগীর এবং উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান আখন্দ ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে দেখতে পান ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে তুলে আনা মাটি ব্যবহার করে পাশের ইটভাটায় ইট নির্মাণ করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের টিমটি সরেজমিনে পরিদর্শনকালে পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মোহাম্মদ আলমগীর কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর সন্নিকটে ইটভাটা স্থাপন করে পরিবেশ দূষণ, নাব্যতা বিঘ্ন এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে কর্ণফুলী নদী দূষণের অপরাধে প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিসকে এক কোটি টাকা জরিমানা করেন। একই সাথে প্রচলিত আইন অমান্য করে সিটি করপোরেশনের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে কিছুদিন ইটভাটার কার্যক্রম চালালেও পরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং অ্যান্ড ব্যাংক প্রটেকশন প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

২০১২ সালে জেলা প্রশাসন থেকে ইটভাটাটি নির্মাণের জন্য কোনো লাইসেন্স দেওয়া না হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুধুমাত্র পরিবেশ ছাড়পত্র দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। পরে ওই ছাড়পত্রটিও বাতিল করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এরপর ইটভাটাটি উচ্ছেদে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। পরবর্তীতে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদের দায়ের করা এক রিটের শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ অগাস্ট কর্ণফুলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের রায় দেন উচ্চ আদালত। জেলা প্রশাসনের তৈরি করা অবৈধ দখলদারের ওই তালিকার একটি হচ্ছে কর্ণফুলী পাড়ের এই ইটভাটা।

এদিকে ইটভাটাটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে ২০১২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের তৎকালীন এক পরিচালকের বিরুদ্ধে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দেন নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ওই অভিযোগের সূত্র ধরে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অতিরিক্ত সচিব অরূপ চৌধুরী অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন। পরবর্তীতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ইটভাটাটির উচ্ছেদ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমানে ইটভাটাটি পরিত্যক্ত হিসেবে অব্যবহৃত পড়ে থাকলেও এটির চারপাশে নতুন নতুন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। সম্মেলনে আয়োজকরা বলেন, আদালতের নির্দেশনার পরে অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হলেও তা আবার থমকে গেছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও অদৃশ্য কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা থাকছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি খাস খতিয়ানের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা জেলা প্রশাসনের উচ্ছেদ করার কথা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে 'বন্দরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে' উল্লেখ করে দায় সারছে জেলা প্রশাসন। সরকারি প্রতিষ্ঠান দুটির (জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ) বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালনে গড়িমসির অভিযোগও করেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের নেতারা।

সংবাদ সম্মেলনে কর্ণফুলী দখল ও জরিপ প্রতিবেদন-২০২০ উপস্থাপন করা হয়।

এতে উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলী সেতু নির্মাণের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬.১৬ মিটার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চালানো জরিপে শাহ আমানত সেতুর নিচে বর্তমানে কর্ণফুলী নদী ভাটার সময় প্রস্থ মাত্র ৪১০ মিটারে নেমেছে। তাছাড়া কর্ণফুলী ব্রিজের উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের উচ্চতা বাড়লে নদীর দক্ষিণ অংশে ব্যাপক স্রোতের সৃষ্টি হয়। স্রোতের এই তীব্রতার চাপ কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে শাহ আমানত ব্রিজের সংযোগ সড়কের বর্ধিত অংশের পিলারে পড়ছে। যা শাহ আমানত সেতুর জন্য বিপজ্জনক। এতে বন্যা বা সাইক্লোন হলে শাহ আমানত সেতুর ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এডিবির মাস্টারপ্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী রাজাখালী খালের মুখে কর্ণফুলীর প্রস্থ ৮৯৮ মিটার, কিন্তু বাস্তবে তা মাত্র ৪৬১ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফুলীর প্রস্থ ৯৩৮ মিটার হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে আছে ৪৩৬ মিটার। ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ হওয়ার কথা ৯০৪ মিটার, কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণ করায় সেখানে নদীর প্রশস্ততা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫০ মিটারে।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে ছয়টি সুপারিশ দেওয়া হয়। তন্মধ্যে- অবিলম্বে কর্ণফুলী মেরিনার্স পার্ক, সোনালী মৎস্য আড়ত, বেড়া মার্কেটসহ কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে ওঠা সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর গতিপথ ফিরিয়ে আনা। নিয়মিত ড্রেজিং করে ও প্রয়োজনীয় নদীশাসনের মাধ্যমে বাংলাবাজার, সদরঘাট, চাক্তাই ও রাজাখালী এলাকার নৌবন্দর ঝুঁকিমুক্ত করা। নদীর পাড় স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করা এবং প্রস্তাবিত হাইড্রো মরফলোজিক্যাল মডেল স্টাডির মাধ্যমে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রবাহ ও নদীশাসনের কাজ সম্পূর্ণ করার ব্যবস্থা নেওয়া।

৬.

২০১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তুরাগ নদী নিয়ে রায় ঘোষণাকালে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ উঠলে তিনি এমপি নির্বাচন থেকে শুরু করে সকল নির্বাচনে অযোগ্য হবেন'। নদী দখলের মতো অভিযোগ থাকলে সরকারি বা বেসরকারি কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও অযোগ্য হবেন ।

নদী রক্ষায় প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচন কমিশন এবং বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতি এই নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নদী রক্ষার জন্য দেয়া রায় বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া এ-সংক্রান্ত রায়ের কপি (অনুলিপি) প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

হাইকোর্ট বলেছেন, এ রায়ের কপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হোক। যাতে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের নদ-নদী, খাল-বিল সম্পর্কে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।

তুরাগ নদীকে জীবন্ত সত্তা (লিগ্যাল পারসন) ঘোষণা করে সে সময় হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এসব নির্দেশনাসহ বিভিন্ন ধরনের পর্যবেক্ষণ দিয়ে মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তুরাগ নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সব নদ-নদী-খালের আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করছেন হাইকোর্ট। দেশের সব নদ-নদী-খাল-জলাশয় ও সমুদ্র সৈকতের সুরক্ষা এবং তার বহুমুখী উন্নয়নে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাধ্য থাকবে বলেও রায়ে উল্লেখ করেছেন আদালত।

আদালত তার রায়ে নির্দেশনা দিয়ে নদী দখলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কঠিন সাজা ও জরিমানা নির্ধারণ করে অভিযোগ দায়ের, তদন্তের ব্যবস্থা রেখে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা আইন সংশোধন করে ছয় মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। পাশাপাশি নদী রক্ষা কমিশন আইনের যেসব সংশোধন প্রস্তাব করেছে, তা অনতিবিলম্বে বিবেচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

এছাড়া নদী রক্ষা কমিশনকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও নদী রক্ষায় প্রতিরোধমূলক নির্দেশনা হিসেবে আদালত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই মাসে একদিন এক ঘণ্টা করে নদী দূষণের ওপর সচেতনতামূলক ক্লাসের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

হাইকোর্টের এইসব নির্দেশনা যে উপেক্ষিত হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাতে আদালত অবমাননার ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে হাইকোর্ট কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানি না। তবে নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করার মতো যুগান্তকারী রায়টি একটি মাইলফলক তা মানতে হবে।

৭.

বর্তমানে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে গৃহীত প্রকল্পে খালের মুখে স্লুইচ গেইট নির্মাণের কাজ চলছে। স্লুইস গেটের ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্বের। যেখানে এর প্রয়োগ হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের জলবায়ু নদ-নদীর গতি-প্রকৃতির কোনো মিল নেই। ফলে জেনারেল জিয়ার আমলে গৃহীত স্লুইচগেট পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে দেশের অনেক উপনদী, শাখা নদী মরে গেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পূর্বেই বলেছি মৃত্তিকার ধরনের কারণে এই এলাকার নদ-নদী খালগুলো শুধু পানি নয় প্রচুর পলিও বহন করে। স্লুইুচ গেটের কারণে উজানের নদী, শাখানদী, উপনদীতে পলি জমতে জমতে তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে বর্তমানে মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে।

নগরীতে কোনো সময় পাহাড় কাটা বন্ধ করা যায়নি। প্রতিনিয়ত এখানে পাহাড় কেটে বসতি, বাণিজ্যিকভবন, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সড়ক সংস্কারের সময় বা সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়ির সময় প্রচুর মাটি সড়কের ওপর তুলে রাখা হয়। পাহাড়কাটা ও নালাসড়কের এই মাটিগুলো শেষ পর্যন্ত খালে গিয়ে পড়ে। ফলে একেকটি খাল বছরে শত শত টন কাদা, বর্জ্য ও পলি বয়ে নিয়ে নদীতে ফেলে। এখন খালের মুখে স্লুইচগেট নির্মাণ করা হবে এবং গেটের আগে জমে থাকা পানি শক্তিশালী পাম্পের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হবে বুঝলাম। কিন্তু হাজার হাজার টন পলি তথা কাদামাটিগুলোর কী ব্যবস্থা হবে। তার সাথে যে কয়েক টন অপচনশীল বর্জ্য যুক্ত হবে তার ব্যবস্থা কী হবে? হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন নয়। অন্য দেশের ফর্মুলা আমাদের দেশে কার্যকর নাও হতে পারে। আমাদের পরিকল্পনা নিতে হবে আমাদের দেশের বাস্তবতার সাথে মিল রেখে। আমাদের জলবায়ু, মাটির গড়ন, নদনদী ও খালের প্রকৃতির সাথে মিল রেখে নদী শাসন, জলব্যবস্থাপনা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

চাক্তাই খালের সংস্কার, খনন ইত্যাদি নানা কাজে সরকারের হাজার কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু তার কোনো সুফল জনগণ পায়নি। এবারও যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। অযথা জটিল করে না তুলে সহজ পরিকল্পনা নিতে হবে। মাথায় রাখতে হবে কোনো না কোনোদিন আজকের দিনের কৃতকর্মের জবাবদিহি জনগণের কাছে করতেই হবে।