সাকিব এখন কার কাছে মাফ চাইবেন?

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 25 Nov 2020, 02:26 PM
Updated : 25 Nov 2020, 02:26 PM

আমাদের গৌরব ক্রিকেটার সাবিক আল হাসান ক্ষমা চাওয়ার যৌক্তিকতায় বলেছেন, তার কলকাতায় কালীপূজায় গমনের কারণে যারা ব্যাথিত হয়েছে, তাদের ব্যথা উপশমের জন্যই তিনি ক্ষমা প্রার্থী। তার বক্তব্যের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তার কাজে কেউ মনক্ষুণ্ণ হলে তিনি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে থাকেন। অর্থাৎ কারও মনোকষ্ট তার সহ্য হয় না, তিনি ক্ষমার ভাণ্ডার। সেই অর্থে তার এখন সেই বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত যারা- তিনি ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের কাছে ক্ষমা চাওয়ায় গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন, নিরাশ হয়েছেন।

সাকিব সাহেব নিশ্চয় এরই মধ্যে জানতে পেরেছেন যে মৌলবাদীদের খুশি করার জন্য তিনি ক্ষমা চাইলেন তাদের সংখ্যার চেয়ে যারা তার সেই ক্ষমা চাওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়েছেন তাদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। সুতরাং এই বহুলাংশে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ নিবারণের জন্য তিনি যদি এখন তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাহলেই প্রমাণিত হতে পারে তিনি মায়াহীন সংসারে একজন ক্ষমার দূত।

সাকিব সাহেব এই মাটিরই সন্তান। তাছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা, আমাদের দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রীর ও স্নেহধন্য একজন মানুষ। তাই তার কলকাতা গমনে যে গোষ্ঠীর গায়ে জ্বালা ধরেছিল, তারা যে আমাদের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি, তারা যে একাত্তরে পরাজিত ধর্মান্ধদের উত্তরসূরী, দেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার ইচ্ছা যে সর্বোক্ষণ তাদের চিন্তা চেতনায় বিরাজ করছে, এ কথা তিনি জানেন না বললে তার আইকিউ নিয়ে যে কেউই প্রশ্ন তুলতে পারে। ধর্মান্ধদের কাছে সাকিব সাহেবের ক্ষমা চাওয়ার প্রেক্ষাপটে জনমনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন জাগ্রত হয়েছে।

প্রথমত, মহসিন তালুকদার নামক এক ঘৃণিত বদ্ধ উম্মাদের ভয়ে যে ব্যক্তি ভীত হয়ে কাল বিলম্ব না করে ক্ষমা চেয়ে নিজের প্রাণ রক্ষার প্রয়াস পান, তিনি টাইগার নামে বিশ্বসভায় পরিচিত আমাদের গৌরবময় ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিনা?

দ্বিতীয়ত, গুটিকয়েক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের সমালোচনার কাছে কাপুরুষসুলভ নতি স্বীকার করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তার নিজের অবস্থান শক্ত নয়, তাই প্রমাণ করলেন কিনা, অর্থাৎ প্রয়োজনে তিনি তাদের সঙ্গেই দলবদ্ধ হয়ে, তাদের সুরেই কথা বলবেন কিনা? অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারে তার ইমান পরিষ্কার নয়, এটা ভাবাই যৌক্তিক কিনা?

তৃতীয়ত, তিনি নিশ্চিতভাবে কলকাতা গিয়েছিলেন, স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে, অর্থাৎ যাওয়ার আগে তার মনে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। হঠাৎ দুইদিন পরে এক উম্মাদের এবং কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী পাকিস্তানপ্রেমির হুমকিতে তিনি শুধু ক্ষমাই চাইলেন না, বলে ফেললেন- মানুষ ভুল করে, কলকাতা গিয়ে তিনিও ভুল করেছেন। প্রশ্ন হলো- এ ধরনের ক্ষণিকে ক্ষণিকে কক্ষচ্যুত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা যায় কিনা, তাকে দৃঢ় বৈশিষ্ট্যের মানুষ ভাবা যায় কিনা এবং আমাদের গর্বের ক্রিকেট দলের তারকার ভূমিকায় বিবেচনা করা যায় কিনা।

চতুর্থত, এতো অল্পতে যে ব্যক্তি ভয় পেয়ে যান, স্খলনের গর্তে পড়ে যান আমাদের ক্রিকেট দলের গৌরব এবং মর্যাদা রক্ষার্থে তার উপর কতটা নির্ভর করা যায়।

পঞ্চমত, সাকিব নামটি এখন শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, একজন সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে তার পরিচিতি বিশ্বময়। সে অবস্থায় তার অদূরদর্শিতা এবং কাপুরুষসুলভ আচরণ বিশ্ববাসী কিভাবে নেবে, সেটিও বড় প্রশ্ন বৈকি।

আমার মনে আছে, আমাদের স্কুল জীবনে পাকিস্তানের সেরা বোলার, অধিনায়ক ছিলেন ফজল মাহমুদ, ওভাল মাঠে জয়লাভের পর 'ওভাল হিরো' নামে যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। তখন সাংবাদিকের তিনি বলেছিলেন তিনি বাস্তব অর্থে তার দেশের একজন দূত বিধায় তার সমস্ত চিন্তা চেতনা, কর্মকাণ্ড হতে হয় অত্যন্ত সতর্কতাপূর্ণ। যাতে কেউ তার মধ্যে কোনও দোষ লেপন করতে না পারে, তার অবস্থান সিদ্ধান্ত এবং বিচক্ষণতা হতে হবে সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। অসাম্প্রদায়িকতার মডেল হিসেবে আজ বাংলাদেশ বিশ্বসভায় সমাদৃত। সাকিব সাহেবের এমন ১৮০ ডিগ্রি ডিগবাজি কি বাংলাদেশের সেই অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে না?

ষষ্ঠ প্রশ্ন হচ্ছে, বাঘের দলে শৃগালের মতো ভীতু, স্থির সিদ্ধান্তে অক্ষম দোদুল্যমান চিন্তার মানুষকে বিশ্বই বা কিভাবে দেখবে! ভারতেও কিন্তু সাকিবের প্রচুর জনপ্রিয়তা রয়েছে, যা তার এই ক্ষমা চাওয়া কর্মকাণ্ডে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে বাধ্য বটে।

এর পরের প্রশ্ন মহসিন তালুকদার নামক সাকিবের হুমকিদাতাকে ঘিরে। একে নেহায়েত উম্মাদ বলে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে চরম অবিবেচকের কাজ। সে যা করেছে, তা জেনেশুনেই করেছে। প্রথমেই তার পারিবারিক পরিচয় নেওয়া দরকার, এটা নির্ণয় করার জন্য তার পূর্ব পুরুষরা ৭১ এ পরাজিত অপশক্তির অংশ বা রাজাকার কিনা। অর্থাৎ তার ধমনিতে রাজাকারের রক্ত রয়েছে কিনা। যদি তা না হয়, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যাবে সে ওয়াজ শুনে মগজ ধোলাই হওয়া দলের একজন। তার কর্মকাণ্ড নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করে অধিক সংখ্যক ওয়াজওয়ালা পাপ কার্যের, আইন ভাঙ্গার উপদেশ দিচ্ছে, ছড়াচ্ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা এবং হিংসার বাণী, যা কিনা আসলেই ইসলাম বিরোধী। ইসলাম যে শান্তির, সৌহ্যর্দের ধর্ম তা কিন্তু এসব ওয়াজওয়ালারা বলছেন না।

ইসলাম ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক পুরুষ মওলানা জালালউদ্দিন রুমি বলেছেন, ধর্ম, জাতি, দেশ, নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসাই ধর্ম। খুব কম ওয়াজওয়ালাই এই বাণী প্রচার করছে। তারা নারীদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কথা বলে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, আমাদের জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা বিরোধী করে তুলছে, পাকিস্তানপ্রেমী করে তুলছে, যে পাকিস্তান আমাদের ৩০ লাখ লোক হত্যা করেছে, ৫ লাখ নারীকে নির্যাতন করেছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, 'ফিরহাদ হাকিম' নামের কলকাতার মেয়র, যিনি সেই পূজার অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন, তিনিও কিন্তু একজন মুসলিম। তার ধর্ম তো চলে যায়নি! পশ্চিম বাংলায় কম বেশি ৩ কোটি মুসলমানের বাস এবং তাদের মধ্যে অনেক হুজুর রয়েছেন। কই তারা তো ফিরহাদ হাকিম সাহেবের পূজা উদ্বোধনের জন্য তাকে নিন্দা করেননি।

আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রতিনিয়ত পূজা অনুষ্ঠানে যান এবং পূজার সময় আয়োজকদের বঙ্গভবনে আপ্যায়ন করেন। আমাদের অত্যন্ত ধর্মভীরু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু পূজোর অনুষ্ঠানে গমনই করেন না, তিনি বলেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। কাজী নজরুল সর্বাধিক পূজার গান লিখেছেন। আমি নিজে বহুবার পূজার অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছি। প্রথম জীবনে মাদ্রাসা শিক্ষিত ২১শে গানের রচয়িতা গাফ্ফার চৌধুরী সাহেব বহু পূজা অনুষ্ঠান প্রধান বক্তার ভাষণ দিয়েছেন, এতে কারো ধর্ম চলে যায়নি। সাকিব সাহেব কি এদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলেন! তিনি বলেছেন, তিনি গর্বিত মুসলমান। তার কথায় মনে হয় তিনিই দেশের একমাত্র মুসলমান। তার তো জানার কথা এদেশের অনেক মুসলিমই পূজার অনুষ্ঠানে গিয়ে থাকেন এবং সেই ঐতিহ্য হাজার বছরের। সাকিব সাহেবের কথায় মনে হচ্ছে, আমাদের পয়লা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, পয়লা ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রান্তিতে উৎসব করা ঠিক নয়, ঠিক নয় রবীন্দ্রনাথসহ হিন্দু কবি সাহিত্যিকদের কাব্য সাহিত্য চর্চা।

তার মত দ্বিধাগ্রস্ত, দোদুল্যমান, অনিশ্চিত এবং স্থির চিন্তাবিহীন ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত কারো শ্রদ্ধাই ধরে রাখতে পারে না। তিনি যেসব ধর্মান্ধদের খুশি করার জন্য ক্ষমা চাইলেন, তারাও কিন্তু তাকে বিশ্বাস করবে না এবং শ্রদ্ধার চোখে দেখবে না।

ক্ষমা এক মহৎ গুণ বটে, যার প্রশংসায় কবিগুরু বলেছেন,

ভগবান , তুমি যুগে যুগে দূত , পাঠায়েছ বারে বারে/

                     দয়াহীন সংসারে ,

তারা বলে গেল  'ক্ষমা করো সবে, বলে গেল  'ভালোবাসো —

                     অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।

আবার সেই কবিগুরুই লিখেছেন, "ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে", লিখেছেন "ক্ষমিতে পারিলাম না, ক্ষমোহে মমো দীনতা"।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি যে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য এটা বোধ হয় সাকিব সাহেবের জানার সুযোগ হয়নি। তাই তার উচিত মরমী কবি শাহ আব্দুল করিমের অত্যন্ত জনপ্রিয় গানটি শোনা যে গানে তিনি বলেছেন, "গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান… আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।" তিনি হিন্দু-মুসলমানের একত্রে ধর্মীয় উৎসব পালনের কথা বলেছেন। এ গানের কথা উপলব্ধি করতে পারলে সাকিব সাহেবের দ্বন্দ্ব কাটতে পারে।