সরকারি ভাবে সরবরাহকৃত নিরিকা জাতের বীজ চাষ করে কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আফ্রিকা থেকে আমদানি করা এই জাতের ধান চাষ করে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন । কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়ার পরেও কৃষকেরা আশাপ্রদ ফলন পান নি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফসল না পাকার ফলে পরবর্তী আমনের ফসল চাষে সমস্যায় পড়েছেন। দেশের সকল কৃষকদের জন্য এই খবর উদ্বেগের বিষয়। কোনরকম ফলাফল প্রদর্শনী ছাড়াই হঠাৎ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে এ বছর আউস মৌসুমে নিরিকা জাতের এই বীজ সরবরাহ করে কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।
বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ২০১০ সালের শুরু থেকে আফ্রিকার কৃষি অর্থনীতি বদলে দেয়া ধান নিরিকা বাংলাদেশে আবাদ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। বলা হয় এই জাতের বৈশিষ্ট্য সমুহের মধ্যে অন্যতম হল বছরের সব সময়ই আবাদ করা যাবে, সবধরণের তাপমাত্রায় ফলন দেবে, অধিক খরা সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে, জীবনকাল ৯০ থেকে ১১৫ দিন, ফলন হেক্টর প্রতি ৪.০ থেকে ৪.৬ মেট্রিক টন, বাংলাদেশে ৮০ দিনেও ফলন পাওয়া যাবে, ইত্যাদি। দেশের কৃষি অর্থনীতি বদলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে অচিরেই কৃষকদের মাঝে আবাদের জন্য এই ধান বীজ সরবরাহের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
তবে কিভাবে এই আফ্রিকান ধান দেশের কৃষি অর্থনীতি বদলে দেবে, কী ধরনের পরীক্ষামূলক আবাদ করে সুফল পাওয়া গেছে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) কাছে মজুদকৃত এক মেট্রিক টন নিরিকা ধানের বীজ কিভাবে এলো এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ব্যাখা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে উৎপাদিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের তুলনায় আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত নিরিকা জাতের ধানের কোন কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে উৎকৃষ্ট, উপযোগী বা বাংলাদেশে আবাদ করা হবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোন তথ্য ছিল না। নিরিকা জাতের উল্লেখিত বৈশিষ্টের মধ্যে কোনটি সারা দেশে ওই সময়ে আবাদকৃত জাতের মধ্যে অনুপস্থিত সেটাও চিহ্নিত করা হয়নি। জাতটি বাংলাদেশে ৮০-৯০ দিনে ফলন দিয়েছে বলে তথ্য দেয়া হয়। কিন্ত ফলন কত হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়না।
উল্লেখিত কারণ সমূহের জন্য আমাদের দেশে এ ধরণের বিদেশী জাতের আবাদের প্রয়োজন আছে কি না তা ভেবে দেখা উচিত বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে দু'বছর আগে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই বিদেশী জাতের আবাদে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছিল (বিডনিউজ২৪.কম, ১৫ জুলাই ২০১০)। ওই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল যে আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি দেশী জাত ৮০-৯০ দিনে ফলন দেয়। তবে জীবনকাল যত কম হবে ফলনও সেই অনুপাতে কমে হয়। বিআর ৯ ও ১৫ এ দুটি আধুনিক জাত আউস মৌসুমে (চৈত্র-আষাঢ়) ১২০ দিনে হেক্টর প্রতি ৫ টন ফলন দেয়। বোরো মৌসুমে (অঘ্রাহায়ণ-জৈষ্ঠ্য) এই একই জাতের আবাদে ৩০ থেকে ৪০ দিন সময় বেশী নিয়ে হেক্টর প্রতি ফলন ০.৫-১.০ মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়। বিএডিসি'র নিজস্ব দু'তিনটি ফার্মে সীমিত পরিমাণের বীজ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে নিরিকা বীজের পরিবর্ধন ও কৃষকদের নিকট বিতরণ ঠিক হবেনা বলে সতর্ক করা হয়েছিল। তাছাড়া এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব যথাসম্ভব বিএডিসি'র নয়। এ ব্যাপারে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতামত, বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা কর্তৃক উপযোগিতা যাচাই এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে প্রদর্শনী ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ প্রসঙ্গে আফ্রিকান মাগুরের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। আশি দশকে আমিষের অভাব দূরীকরণে বেশ জোরেশোরে এই মাছের চাষ শুরু করা হয়। পরবর্তীকালে রাক্ষুসে মাছ আখ্যা দিয়ে আফ্রিকান মাগুরের চাষ বন্ধ হয়ে যায়।
যাহোক এ বছর এপ্রিল মাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩০ জেলার কৃষকদের মাঝে বিএডিসি ৪ শত ৫০ টন নিরিকা জাতের বীজ সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। খোদ কৃষি মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় এই বীজ সবরাহ করা হয়েছে। বিএডিসি থেকে সরবরাহকৃত বিভিন্ন ধরণের বীজের মূল্য ৩৫ থেকে ৫০ টাকা। গড়ে ৪৫ টাকা হিসেবে বীজের মূল্য ২ কোটি টাকা হবে। সরকারি খরচে বীজ উৎপাদন করা হয়েছে। এর আগে এই বীজের উপযোগিতা যাচাই করার কথা হয়েছে। যদিওবা এ ধরণের যাচাইয়ে দুই বছর মোটেও যথেষ্ট নয়। যাহোক এ বাবদও খরচ হয়েছে। অধিক ফলন পাওয়ার লোভ দেখিয়ে গড়ে ১০ কেজি করে ধরা হলে প্রায় ৪৫ হাজার কৃষকদের কাছে এই বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। সরকারি ভাবে তখনও বীজ ছাড়করণ হয়নি এবং পরীক্ষার উদ্দেশ্যে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে তখন জানানো হয়।
সরকারি ভাবে আশা করা হয়েছে যে আউস মৌসুমে এই জাত জনপ্রিয়তা লাভ করবে। এছাড়া জীবনকাল কম বলে বন্যা পরবর্তী সময়ে আবাদের জন্য উপযোগী হবে। কিন্ত বাস্তবে হয়েছে অন্যরকম। সরকারি এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কৃষকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শোনা গিয়েছিল যে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে স্বয়ং নিরিকা জাতের ধানবীজ নিয়ে আসেন। এই তথ্য সঠিক না হলে এই বীজ কি ভাবে দেশে এলো তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।
এর আগেও এ দেশের কৃষকেরা প্রায় একই ধরণের বিপাকে পড়েছিলেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে হঠাৎ করে হাইব্রিড ধান বীজের আবির্ভাব ঘটে ভারত থেকে আমদানীর মধ্য দিয়ে। তখনও পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যতিরেকে এবং ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতামত ছাড়াই এই বীজ বাজারজাত শুরু করা হয়। বাংলাদেশ বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা কর্তৃকও এ বীজ প্রত্যায়িত ছিল না। যে দেশ থেকে আমদানী করা হচ্ছে সে দেশের সরকার কর্তৃকও জাতগুলো অনুমোদিত ছিল না। আমদানী করা হাইব্রিড বীজ ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়। আগ্রহী কৃষকেরা আশানুরুপ ফল না পেলেও বারবার তাদেরকে আশা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কৃষকেরা প্রতারিত হতে থাকে। তারা বুঝতে পারে যে আমদানিকৃত বীজ এদেশের কৃষি পরিবেশে উপযোগী নয়। অনেক কৃষক প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হন। এ নিয়ে ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদে বাকবিতন্ডা হলে সরকার বিরোধী দলকে দায়ী করলেও প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকেও এ ব্যাপারে কোন রকম নির্দেশ দেয়া হয়নি। বিশিষ্ট ধান গবেষক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভূতপূর্ব পরিচালক ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য ডক্টর এস, এম, হাছানুজ্জামান এই বীজ আমদানিকে অসাধু ব্যবসা ও চতুর দস্যুতা বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই সময়েও কৃষিমন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী।
এমনিতেই কৃষি পণ্যের দাম উপকরণ বাবদ খরচের তুলনায় অস্বাভাবিক কম। বিগত চার দশকে চালের সরাকারি মুল্য কেজি প্রতি ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৮ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে ধান আবাদে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত ইউরিয়া সারের মূল্য ৫৪ পয়সা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২০ টাকা। বীজ, কীটনাশক ও ডিজেলের মূল্য এবং শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে আরো অধিক হারে। এই অবস্থায় কৃষকদের উপর কোন প্রযুক্তি চাপিয়ে দেয়া এ ব্যপারে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করা কোন ক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে কৃষকদের ভোগান্তি বাড়ে, খেসারত দিতে হয়। এতে শুধু কৃষকেরা নয় দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নতুন প্রযুক্তি কৃষকদের কাছে হস্তান্তরের আগে বা মাঠ পর্যায়ে পাঠানোর আগে ভালো করে উপযোগিতা যাচাই করে নেয়ার জন্য কৃষকের আবাদি জমি নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। সারা দেশে বিএডিসির আঞ্চলিক ফার্ম, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক ষ্টেশন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক কেন্দ্র ও কৃষি প্রশিক্ষায়নের খামার রয়েছে। এগুলো মাল্টি লোকেশন ট্রায়াল সাইট হিসেবে নতুন উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ উপযোগিতা মাঠ পর্যায়ে যাচাইয়ের জন্য খুবই উপযুক্ত। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের অধীনে মাঠ পর্যায়ে যোগ্য বিশেষজ্ঞরাও আছেন। এই সুবিধা থাকা সত্বেও নিরিকা বীজ চাষে কৃষকদের যে ক্ষতি করা হল তার জন্য ক্ষতিপূরণ কে দেবে? বিএডিসি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর না এই বীজের বাহক?
কিউ আর ইসলাম: কৃষি, পানি ও পল্লীউন্নয়ন বিশ্লেষক।