কৌশলটা যেন ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে

কবীর চৌধুরী তন্ময়
Published : 22 Nov 2020, 09:23 PM
Updated : 22 Nov 2020, 09:23 PM

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে (১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি) প্রত্যাবর্তন করে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারে নির্যাতনের বর্ণনা করতে গিয়ে লক্ষ-কোটি মানুষের সামনে বলেছিলেন, 'আমার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না।'

বঙ্গবন্ধুর এই দার্শনিক কথা- 'বাঙালি' 'মানুষ' এবং 'মুসলমান'; আজ আমরা কতটুকু ধারণ ও পালন করছি, সেইসাথে রাষ্ট্র কিভাবে এই 'দর্শন'কে গুরুত্ব দিচ্ছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে, এটি গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা আদৌ কি বঙ্গবন্ধু'র স্বপ্নের মতন শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত–এটিও খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বঙ্গবন্ধু তার চিন্তা-দর্শন থেকেই 'আমাদের জাতীয়তাবাদ বাঙালি'র পরে আমাদের সবার পরিচয় 'আমরা মানুষ' হিসেবে তুলে ধরেছেন। তৃতীয়স্থানে ব্যক্তিগত বিশ্বাস 'ধর্ম'কে গুরুত্ব দিলেও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আমরা যেন তৃতীয় ধর্মবিশ্বাসকে প্রথমে তুলে আনার চেষ্টা করছি। ব্যক্তিগত থেকে দলীয় বা রাজনৈতিকভাবে, সমাজ বা রাষ্ট্রীয়ভাবেও সুকৌশলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি বা 'সচেতন মুসলমান' হওয়ার চেষ্টা করছি!

এ যেন ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব-নিকেশ, জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কৌশলের পাশাপাশি রাজনীতির মাঠে বিশেষ শ্রেণির সমর্থন অর্জন যা ভোটের রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহির্প্রকাশ ঘটানো বিবেচনা করা হয়।

অন্যদিকে ধর্মীয় বিশ্বাসের নামে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র কাঠামোর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকীরণনীতি সুকৌশলে বিস্তারের সুযোগ নিচ্ছে।  যেমন- নারীর হিজাব, পুরুষের টাকনুর ওপর পোশাক পরার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট! এখানে সরকারি বিধি অনুযায়ী নয়, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম তার অফিস চালাতে চেয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত মনমর্জি বা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আর তাই তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ড্রেস কোডও নির্ধারণ করে (২৮ অক্টোবর, ২০২০) এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি লিখেছেন, 'অত্র ইনস্টিটিউটের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অফিস চলাকালীন সময়ে মোবাইল সাইলেন্ট/বন্ধ রাখা এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুরুষ টাকনুর ওপরে এবং মহিলা হিজাবসহ টাকনুর নিচে কাপড় পরিধান করা আবশ্যক এবং পর্দা মানিয়া চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।'

আবার একশ্রেণির মানুষের প্রিয়ভাজন ব্যক্তি বা জনপ্রিয় সেলিব্রিটি কতিপয় মানুষও ব্যক্তিগতভাবে সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করে নেওয়ার উদাহরণও উল্লেখযোগ্য। যেমন, অভিনয়শিল্পী মোশাররফ করিম ও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান!

মোশাররফ করিম তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে দেওয়া (২৩ মার্চ, ২০১৮) এক স্ট্যাটাসে ক্ষমা চেয়ে লিখেছেন, "চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে আমার উপস্থাপিত একটি অনুষ্ঠানের একটি অংশে আমার কথায় অনেকে আহত হয়েছেন। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি যা বলতে চেয়েছি তা হয়ত পরিষ্কার হয়নি। আমি পোশাকের শালীনতায় বিশ্বাসী এবং তার প্রয়োজন আছে। এই কথাটি সেখানে প্রকাশ পায়নি। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা আমার অভিপ্রায় না। এ ভুল অনিচ্ছাকৃত। আমি অত্যন্ত দুঃখিত। দয়া করে সবাই ক্ষমা করবেন।"

ক্ষমা চাওয়ার কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের টিভি অনুষ্ঠান 'টেডএক্স' ও ভারতের 'সত্যমেভ জয়তে' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের নির্মাণ করা ও প্রচারিত অনুষ্ঠানের এক দৃশ্যে মোশাররফ করিম বলেন, "একটা মেয়ে তার পছন্দমতো পোশাক পরবে না? আচ্ছা পোশাক পরলেই যদি প্রবলেম হয়, তাহলে সাত বছরের মেয়েটির ক্ষেত্রে কী যুক্তি দেব, যে বোরাকা পরেছিলেন তার ক্ষেত্রে কী যুক্তি দেব? কোনো যুক্তি আছে?"-এটি প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোশাররফ করিমকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগও তুলেছেন।

আবার সাম্প্রতিক দুটি আলোচিত ইস্যু নিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ঘটনা দুটির ব্যাখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষমা প্রার্থনাও করলেন ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তিনি তার ফ্যান-ফলোয়ারের উদ্দেশ্যে বলেন, "দ্বিতীয় যে ঘটনাটি, অবশ্যই খুবই সেনসিটিভ। প্রথমেই আমি বলতে চাই, নিজেকে আমি একজন গর্বিত মুসলমান হিসেবে মনে করি এবং সেটাই পালন করার চেষ্টা করি। ভুল-ত্রুটি হবেই এবং ভুল-ত্রুটি নিয়েই আমরা জীবনে চলাচল করি। আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে অবশ্যই আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে সেজন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।"

সাকিব আরও বলেন, "পূজার উদ্বোধন আমি কখনোই করিনি এবং সচেতন মুসলমান হিসেবে আমি করব না। তারপরও হয়তো ওখানে যাওয়াটাই আমার ঠিক হয়নি। সেটা যদি আপনারা মনে করে থাকেন, তাহলে আমি অবশ্যই আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। আমি মনে করি, আপনারা এটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটির চেষ্টা করব।"

দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য, আমরা অনেকে জেনে বা না জেনে ধর্ম পালন বা 'সহীহ-সচেতন মুসলমান' হওয়ার চেষ্টার নামে মূলত সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিচ্ছি, মানুষের পরিচয় 'আমরা মানুষ' নয় বরং ধর্মকে টেনে এনে বিভেদ সৃষ্টি করছি। অন্ধকারে নিমজ্জিত আর কুসংস্কারে বিশ্বাসী কতিপয় মানুষকে আরও বিপদগ্রস্ত করে তুলছি।

দায়িত্ব নিয়ে যেখানে 'মানুষ' আর 'মানবতা'র দিকে আহ্বান করার কথা, দায়িত্ব নিয়ে যেখানে আলোর পথ দেখানোর কথা, দায়িত্ব নিয়ে যেখানে শিক্ষা অর্জন আর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা-সেখানেই তথাকথিত 'সহীহ-সচেতন আর গর্বিত মুসলমান' হওয়ার চেষ্টা করছি। ধর্ষণের কারণ যে শুধু নারীর পোশাক দায়ী নয়–এটিও দায়িত্ব নিয়ে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে ব্যাখ্যা করে বুঝানোর পরিবর্তে ক্ষমা চেয়ে বরং নারীর পোশাককে ধর্ষণের কারণ হিসেবে দায়ী করছি।

এতে আর যাই হোক, সভ্য সমাজ এই ধরনের ক্ষমাকে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় বা উস্কে দেওয়া হিসেবেই বিবেচনা করবে। একশ্রেণির মানুষকে অন্ধকার-কুসংস্কার থেকে টেনে তুলে আনার চেষ্টার বিপরীতে উল্টো ধ্বংসাত্মক জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়াকেই মনে করবে।

কারণ, ইতিহাস প্রমাণ করে, বঙ্গবন্ধু'র ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্বাধীনতা অর্জনের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্ত দিয়ে, রক্ত নিয়ে, অত্যাচারিত হয়ে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যার যা ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আল-সামস ও তথাকথিত শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সূর্যসন্তানরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করেছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, 'বাঙালি' জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সেই সত্তা যাকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সোহরাওয়ার্দী, পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের মতো মহান ব্যক্তিরা নিজের মতো করে আকার দিয়েছেন, সাঁজিয়েছেন। সেই স্বপ্নেরই এক কঠিন সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে তার কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল মহান গুরুদায়িত্ব। আর তার হাতেই পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের।

প্রচণ্ড দুঃখ ঘনীভূত হয় যখন দেখি স্বয়ং সংসদও সেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পদচিহ্ন সৃষ্টি করে।

মুজিববর্ষের বিশেষ অধিবেশনে সংসদে জাতির পিতার ভাষণ থেকে যখন 'ধর্মনিরপেক্ষতা' প্রসঙ্গে কিছু অংশ বাদ দিয়ে শোনানো হয়, তখন প্রশ্ন আসে, এখানেও কি সুকৌশলে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে অবস্থান? কারণ, সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (১) নং দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জাতির পিতাকে স্মরণ করে জাতীয় সংসদে একটি বিশেষ অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল মার্চেই। করোনাভাইরাসের কারণে সে অধিবেশন পিছিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ৫ থেকে ১৫ নভেম্বর ২০২০। এতে জাতির পিতার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন, কর্ম, আদর্শ ও দর্শনের ওপর বিস্তারিত আলোচনা, ডকুমেন্টরি প্রস্তুতের যথেষ্ট সময় পাওয়ার পরেও এটিকে নিছক ভুল বলা দায়িত্বের প্রতি অবহেলা বা অদক্ষতার বহির্প্রকাশ বলে ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি।

এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে যে ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাটিও ছিল এমন যে, "ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।"

"ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।"

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হওয়ার পরেও ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখেরও বেশি সম্ভ্রম বিনাশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশ যে সকলের বাংলাদেশ হবে, সকল ধর্মের, সকল শ্রেণিপেশার মানুষের শোষণমুক্ত দেশ হবে–এটি তার বক্তব্যেও বুঝিয়েছেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে (১০ জানুয়ারি, ১৯৭২) স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মাটিতে পা রেখেই সেদিন বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।…কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশে কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকুক।'

আবার তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কাছে একই স্বপ্ন-বার্তা পৌঁছে দিতে ওই বছরের ২৬ জুন মাইজদি কোর্টের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি। তার অর্থ ধর্মবিরোধী নয়। …এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর অত্যাচার করবে না। ধর্মের নামে জুয়াচুরি, পকেটমার, লুটতরাজ, ব্যবসা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পয়সা খাইয়া রাজনীতি করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। তবে আমি মুসলমান, আমি মুসলমান হিসেবে আমার ধর্মকর্ম পালন করব। হিন্দু হিন্দুধর্ম পালন করবে। কেউ ধর্মকর্মে বাধা দিবার পারবে না। ঠিক? মানেন? আমার ধর্ম আমার কাছে। তোমার ধর্ম তোমার কাছে। আমার কুরআনের আয়াতে আছে তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে–এইটাই হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।'

আমাদের বুঝতে হবে মানুষ, মানবতাবোধ আর মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন ও চর্চা করতেন, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে যেমন বিশ্বাসী ছিলেন, আবার তেমনিভাবে ব্যক্তিগত পর্যায় ইসলাম ধর্ম ও মহান আল্লাহর ওপর তার ছিল অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা।

বঙ্গবন্ধু নিজের ধর্ম পালন সম্পর্কে লিখেছেন, 'আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজী তরজমাও পড়েছি' (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ-১৮০)।

আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে গ্রহণ করায় স্বাধীনতার পরাজিত ধর্মব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে বাঙালির ভাষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলন ও সংগ্রামে ইসলাম ধর্মকে 'বর্ম' হিসেবে ব্যবহার করে বাধাগ্রস্ত করার হীন অপচেষ্টা চালিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে!

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দায়িত্ব নিয়েই দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ উপহার দিলেও ১৯৭৫ সালে ১৫ অগাস্ট তিনি সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হবার পর অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে দায়িত্বের আসনটিকে অবমাননা করেন জিয়াউর রহমান। পাকিস্তানি ছায়া সরকার-রাষ্ট্র বানাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে পরবর্তীতে স্বৈরশাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও। এমনকি, তারা সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' আর 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'কে যুক্ত করে ধর্ম ব্যবসার আদলে সুকৌশলে যে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে–এটি ব্যক্তি পর্যায় থেকে সাংগঠনিক রাজনীতিসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও অদৃশ্যভাবে শক্তিশালী হয়ে ধীরে-ধীরে বেড়ে উঠছে।

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক দর্শন, ব্যক্তি পর্যায় ধর্মচর্চা, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ দেশে কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই একে অপরের ভাই-বন্ধু হয়ে সুখে-শান্তিতে থাকতে তোমার ধর্ম আমার উৎসব, আমার ধর্ম তোমার আনন্দ–এই ধর্মনিরপেক্ষতা তৃণমূল জনগোষ্ঠীর মন-মগজে প্রতিস্থাপনসহ রাষ্ট্র কাঠামোতেও প্রতিষ্ঠিত করতে সামাজিক, রাজনৈতিক, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি পর্যায় থেকেও নানা রকম কর্মসূচি নেওয়া উচিত।