ট্রাম্পের নির্বাচনী ফল প্রত্যাখান: কোন পথে আমেরিকা? 

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 15 Nov 2020, 02:19 PM
Updated : 15 Nov 2020, 02:19 PM

বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বের নির্বাচনের একটা সাধারণ প্রবনতা হল পরাজিতদের বিজয়ীদের প্রতি কারচুপির অভিযোগ তোলা। অনেকে দেশেই এ সমস্ত অভিযোগের যথেষ্ট সারবত্তা থাকে। রাষ্ট্রযন্ত্র এবং নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনরা সে সমস্ত দেশে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেন।  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদের সাথে সম্পর্ক এবং স্বার্থের নিরিখে এর মধ্য থেকে বেছে বেছে কোন কোন রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রহীনতা, কারচুপি এসব বিষয়ে ছবক দেয়। আবার কোন কোন রাষ্ট্রের ব্যাপারে চুপ থাকার নীতি অনুসরণ করে। 

নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকে ডনাল্ড ট্রাম্প বলে আসছিলেন, এবার নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হবে। তাকে হারানোর চক্রান্ত চলছে।দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়া দেশগুলোতে কেন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয়না, এ নিয়ে এতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উচ্চকণ্ঠ ছিল। এখন সে রাষ্ট্রটির প্রধান তাঁর নিজের দেশের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে কারচুপি এবং অস্বচ্ছতার অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাটিক দলের আল গোর কারচুপি করে তাকে হারানো হয়েছে বলে বলেছিলেন।পরে সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবহার করে গোরের পরাজয় নিশ্চিত করা হয়। আদালতের রায়ের সাথে তিনি একমত না হলেও পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন। 

নির্বাচন নিয়ে সমস্যা দেশটিতে গোরের পূর্বেও হয়েছে। তবে আগে কোন রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা ছাড়বেন না, এমন বলতে শোনা যায়নি। কিন্তু ট্রাম্পসহ রিপাবলিকান দলের বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা নির্বাচনের ফল মেনে নিতে অস্বীকারই শুধু করছেন না, তারা ক্ষমতা না ছাড়ার কথাও বলছেন। তারা মনে করছেন, পরাজয় মেনে নিলে আগামীতে রিপাবলিকানদের ক্ষমতায় আসা দুরূহ হয়ে যাবে।

রিপাবলিকান দলের ৭০ শতাংশ সমর্থক মনে করছেন নির্বাচনে কারচুপি করে ট্রাম্পকে হারানো হয়েছে। নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানির মত নেতারা তৃতীয় বিশ্বের নেতাদের মত একই ভাষায় বলছেন, কবর থেকে উঠে এসে ডেমোক্র্যাটরা ভোট দিয়ে গেছে। কারচুপির প্রতিবাদের সারা আমেরিকাতে আর সোশ্যাল মিডিয়াতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে রিপাবলিকান দলের সমর্থকরা। ফক্সসহ সমস্ত দক্ষিণপন্থি মিডিয়া এ বিক্ষোভে সমর্থন জোগাচ্ছে। 

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এর মধ্যে স্পষ্ট করেছেন যে, ট্রাম্প প্রশাসন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে ফান্ড রয়েছে সেটা আটকে দিয়েছে ট্রাম্প সরকার। বিদেশি রাষ্ট্রনায়করা যাতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে বাইডেনকে শুভেচ্ছা জানাতে না পারেন, সে ব্যবস্থাও করেছে বর্তমান সরকার। পাশাপাশি পেন্টাগনসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন জনকে বহিষ্কার করে ট্রাম্প তার অনুগতদের বসাতে শুরু করেছেন। 

প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারকে বহিষ্কার করেছেন তার নির্দেশ অমান্য করার জন্য। জানা গেছে ট্রাম্প এসপারকে বলেছিলেন জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল, সে বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে। এসপার সেসময় তার নির্দেশ না মানবার ফলে এখন তাকে পদে বহাল রাখা ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সমীচীন মনে করছেন না ট্রাম্প ।   

ট্রাম্প আসলে কী চাচ্ছেন? এ প্রশ্ন ঘিরে বর্তমান মার্কিন রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে। ট্রাম্প কি আইনকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার দলকে ক্ষমতায় থাকবার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে যাচ্ছেন? ট্রাম্প যদি শেষ পর্যন্ত সে পথেই হাঁটেন তাহলে যে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হবে তার মোকাবেলা কী করে করা হবে? এ বিষয়টা অনেককে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তবে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকবার সব আয়োজন পাকাপোক্ত করছেন, যদিও তিনি একই সাথে নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগে আইনি লড়াইতেও অবতীর্ণ হয়েছেন। 

যে সমস্ত অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছেন বা ভোট গণনায় পিছিয়ে রয়েছেন তার সবগুলিতেই তিনি ভোটে অনিয়মের মামলা করেছেন। কিন্তু মামলা করার দুই/তিন দিনের মধ্যেই এ সমস্ত মামলা কোন কোন অঙ্গরাজ্যে খারিজ হয়ে গেছে, বাকিগুলোতেও হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

কোর্ট থেকে বলা হয়েছে, রিপাবলিকানরা অনিয়মের কোন প্রমাণ তুলে ধরতে পারেনি, তাই মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে বাকি অঙ্গরাজ্যগুলিতেও মামলা হয় খারিজ হয়ে যাবে অথবা ট্রাম্প হেরে হবেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, এরপর তিনি কী করবেন? তিনি কী সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হবেন? কেননা সেখানে বর্তমানে বেশির ভাগ বিচারক হচ্ছেন রিপাবলিকান দলের। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অতি রক্ষণশীল বা অন্যভাবে বললে দক্ষিণপন্থার রাজনীতিকে ধারণ করেন। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে দল ক্ষমতায় থাকে, সুপ্রিম কোর্টে তখন বিচারক পদ খালি হলে, তাদের সমর্থক ব্যক্তিকে তারা বিচারক পদে বসিয়ে দেন।এখন প্রশ্ন হল, মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলে ট্রাম্প কি মামলা জিতে আসবেন? বিচারকরা কি দলীয় পরিচয়ে ট্রাম্পের পক্ষে রায় দিবে? যদি সেটা হয়, তাহলে ডেমোক্র্যাটরা তারপর কী করবেন? আর যদি মামলা সুপ্রিম কোর্টে নেওয়া না যায়, অথবা সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্প রায় না পান, তাহলে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? 

তবে এ মুহূর্তে ট্রাম্প প্রশাসন একটা পরিষ্কার বার্তা দিয়ে দিয়েছে যে, যেহেতু তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, তাই তারা ক্ষমতা ছাড়ছেন না। তবে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের সাথে তার দলের চারজন সিনেটর এবং চারটি অঙ্গরাজ্যের গভর্নরসহ হাতেগোণা কয়েকজন নেতৃস্থানীয় রিপাবলিকান ভিন্নমত পোষণ করে বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। 

ট্রাম্প হয়ত আরো কিছু শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকানের সমর্থন হারাবেন। কিন্তু একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় বেশির ভাগ রিপাবলিকানই তার সাথে থাকবেন। এছাড়া তিনি দৃঢ় সমর্থন পাবেন দলের বাইরের বিভিন্ন দক্ষিণপন্থি এবং বর্ণবাদী গোষ্ঠীগুলো থেকে। এদের অনেকগুলো আবার সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ। 

সমস্ত দক্ষিণপন্থি এবং বর্ণবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতীকে পরিণত হয়েছেন ট্রাম্প। তারা চাচ্ছে খ্রিস্ট-ধর্ম নির্ভর, বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ আমেরিকার পুনুরুত্থান, যাকে তারা বলছে "Make America Great Again" । এ গোষ্ঠীগুলো যেকোনও মূল্যে ট্রাম্পকে ক্ষমতায় রাখতে চাচ্ছে।   

দলের বাইরে মার্কিন রাজনীতিতে এ সমস্ত গোষ্ঠীগুলোর গুরুত্ব অনেক। ডান বামসহ নানা ধারায়, মতে বিভক্ত এ সমস্ত গোষ্ঠীগুলো আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম, বিক্ষোভ, মিছিল, নির্বাচন, প্রচারণা, নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে ট্রাম্পের মূল সমস্যা হচ্ছে, প্রায় পুরো এস্টাবলিস্টমেন্টের তার বিপক্ষে চলে যাওয়া। এ বিপক্ষে চলে যাবার মূল কারণ যতটা না অভ্যন্তরীণ তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক।  

কট্টর দক্ষিণপন্থি ট্রাম্প যখন ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন পুরো  এস্টাবলিস্টমেন্ট, বিশেষত মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স খুব খুশি হয়। তারা ধরে নিয়েছিল সাম্প্রতিক কালের যেকোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে ট্রাম্প হয়ত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরো আগ্রসী ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি এমন নীতি নেবার কথা বললেন যেটা মার্কিন রাজনীতিতে বামপন্থিরা বলে থাকে। 

প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করতে শুরু করে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরো জোরালো হয়। দেশে দেশে সরকার উচ্ছেদ, সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠন, "গণতন্ত্রের" আন্দোলন গড়ে তোলা, নানা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, সেনা অভিযানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন বা কোন সরকারের সমর্থনে সেনা পাঠান ইত্যাদি হয়ে উঠে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। আর এ নীতি বজায় রাখবার জন্য বিশ্বের ৭০ টির বেশি দেশ এবং অঞ্চলে ৮০০ এর মত সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা নানা ঘরানার বাম রাজনীতি করেন তারা এতদিন বলে আসছিলেন এ সমস্ত ঘাঁটি বন্ধ করে দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশি ভূমিকার অবসান ঘটাতে। ট্রাম্প নির্বাচিত হবার পর সেই একই কথা বলা শুরু করেন। শুধু তাই নয় বামপন্থিদের ভাষায় ন্যাটো জোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। এতে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। এতদিন ধরে চলে আসা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তনের কথা শুধু বলাই নয়, এ লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতেও তিনি উদ্যোগী হন।

চরম দক্ষিণপন্থি ট্রাম্প যখন এসব কথা বলা শুরু করেন তখন মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স প্রমাদ গণা শুরু করে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সসহ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দুই একটা বাদে প্রায় সবগুলো ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চলে যায়। মিডিয়া এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনেকে ট্রাম্পকে রাশিয়ার দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করে। 

ট্রাম্প যখন ক্ষমতাসীন হন তখন অনেকেই মনে করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে তিনি হয়ত কঠিন পন্থা অনুসরণ করবেন। কিন্তু দেখা গেল তার সময় মধ্যপ্রাচ্যসহ দুনিয়ার কোথাও তিনি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেননি। একমাত্র ইরানের জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করা ছাড়া আর কারো রক্তে তার প্রশাসনের হাত রঞ্জিত হয়নি। এমনকি ইরান যখন এ হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি ইরানে পাল্টা হামলা করা থেকে বিরত থাকেন। 

ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন ট্রাম্প। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের চাপ সত্ত্বেও সিরিয়াতে এমন ভূমিকা নেন যাতে সেক্যুলার আসাদ সরকারের পতন না ঘটে এবং  বিরোধী ইসলামী মৌলবাদীদের হাতে ক্ষমতা চলে না যায়। এর বিপরীতে জো বাইডেন যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তুলনামূলক বিচারে সেক্যুলার, লিবিয়ার গাদ্দাফিকে শুধু ক্ষমতাচ্যুত নয়, তাকে বিনা বিচারে হত্যা করে সশস্ত্র "ইসলামপন্থার" রাজনীতির বিকাশের পথ উন্মুক্ত করা হয়। 

নীতিগতভাবে ট্রাম্প বামপন্থা এবং "ইসলামপন্থা"—এ দুই ধারার রাজনীতিরই ঘোর বিরোধী। দুই ধারার রাজনীতিকে তিনি মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর মনে করেন। প্রথমটির বিরোধিতা নিয়ে মার্কিন এস্টাবলিস্টমেন্টের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মার্কিন এস্টাবলিস্টমেন্ট "ইসলামপন্থার" রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী বিশ্বে তাদের প্রভাব বিস্তারের কৌশলের হাতিয়ার হিসাবে।  

মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের সাথে ট্রাম্পের আরেকটি বিরোধের জায়গা হল ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার বিষয়টি। ট্রাম্প চাচ্ছেন ক্রিসমাসের আগে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সেনাবাহিনী মনে করছে এতে মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। এসব নানা বিষয় নিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে বর্তমানে ট্রাম্পের একটা শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। 

শুধু সেনাবাহিনী নয় এস্টাবলিস্টমেন্টের সাথে যুক্ত সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ মূল ধারার প্রায় সব ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার সাথে গত চার বছরে ট্রাম্পের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, জুনিয়র বুশের সময় মুসলিম বিরোধী নীতি এবং পদক্ষেপের ব্যাপারে এ সমস্ত মিডিয়া কখনো বুশকে সমর্থন দিয়েছে, কখনো নীরব থাকার নীতি অনুসরণ করেছে, আবার কখনো এ ধরনের সংবাদ উপেক্ষা করেছে। ওবামা প্রশাসনের অভিবাসন বিরোধী পদক্ষেপের সময়ও তারা চুপ থাকার নীতি অনুসরণ করেছে। 

এ দু'জনের তুলনায় মৌখিক রেটোরিক ছাড়া বাস্তবে অভিবাসী এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে অত কঠিন পদক্ষেপ না নিলেও মিডিয়া ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কঠিন সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়। শুধু এ দুটো বিষয় নয়, ট্রাম্পের যেকোনও বিষয় নিয়ে মিডিয়া কঠিনভাবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। যেমন ট্রাম্পের যৌন হেনস্থার বিষয় নিয়ে মিডিয়া সব সময় সোচ্চার থেকেছে; কিন্ত সিনেটর থাকাকালীন বাইডেনের যৌন হেনস্থার বিষয়টি যতটা সম্ভব উপেক্ষা করে গেছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে কোন প্রেসিডেন্টকে মূলধারার মিডিয়ার এমন চরম বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি। মিডিয়ার সমর্থন নিয়েই তারা তাদের প্রেসিডেন্ট থাকার সময়কাল শেষ করেছেন। মিডিয়া তাদের একটা উজ্জ্বল ইমেজ দেশে এবং বহির্বিশ্বে তুলে ধরেছে। ফলে, অন্তত জাতীয়ভাবে মূলধারার জনগোষ্ঠীর কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা একটা ইতিবাচক ইমেজ নিয়েই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। ট্রাম্প হচ্ছেন মার্কিন ইতিহাসে একমাত্র প্রেসিডেন্ট, মিডিয়া যার পুরো নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। 

ট্রাম্পও মিডিয়াকে ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা দুনিয়ার বামপন্থিরা যে ভাষায় আমেরিকান মিডিয়ার সমালোচনা করে, সে একই ভাষায় তার নিজের দেশের মূল্ধারার মিডিয়াকে ক্রমাগত আক্রমণ করে গেছেন, যেটা ইতিপূর্বে আর কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে করতে দেখা যায়নি। 

ট্রাম্প গত চার বছর ধরে বলে আসছেন তার নিজের দেশের মিডিয়া ফেইক বা ভূয়া নিউজ তৈরি করে নিজেদের সুবিধামত—যে কথা বামপন্থিরা সবসময় বলে থাকেন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি তার নিজের দেশের মিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তেমনি মিডিয়াও চেষ্টা করেছে যেকোন ভাবে ট্রাম্পের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে। 

মূলধারার মিডিয়ার কর্ণধারদের সাথে হাত মিলিয়েছেন ফেইসবুক, টুইটারের মত সোশ্যাল মিডিয়ার কর্ণধাররাও। এদের সাথে যোগ দিয়েছেন জ্বালানি, ফাইন্যান্স, হাই টেক ইন্ডাস্ট্রির মত বড় বড় কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা। যেহেতু তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে যুক্ত, তাই তারা ট্রাম্পের বিশ্বায়ন এবং মুক্তবাজার অর্থনৈতিক নীতির যে বিরোধিতা—তার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। 

ট্রাম্পকে ঘিরে মার্কিন পুঁজিবাদী শ্রেণির মাঝে একটা মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বড় দাগে কিছু ব্যতিক্রম বাদে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির প্রায় পুরোটা ট্রাম্পের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অপরদিকে, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি পুঁজিপতিদের প্রায় সবাই ট্রাম্পকে সমর্থন দিচ্ছে। এর বাইরে ট্রাম্পের সমর্থনের মূল ভিত্তি গ্রামাঞ্চলের জনগণ এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণি। মায়ামিতে ট্রাম্পের কিউবা বিরোধী নীতির কারণে কিউবা থেকে আসা অভিবাসীরা সেখানে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছে। 

নির্বাচনে মার্কিন বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজি বাইডেন যাতে জিতে আসেন তার জন্য বিপুল বিনিয়োগ করে। ফলে বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে ১৪৪ মিলিয়ন ডলার বেশি নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করতে পারেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নানা মাধ্যমে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচার চালায়। অনেক জায়গাতেই বাইডেনের তুলনায় ট্রাম্প ক্যাম্পের নির্বাচনী প্রাচারণা ছিল নিষ্প্রভ। 

এসবের পাশাপাশি অনেকের কাছে এটাও প্রতীয়মান যে, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ট্রাম্প প্রশাসন শুধু ব্যর্থই নয়, জনগণকে তিনি তার বক্তব্য এবং আচরণের মধ্যে দিয়ে খাদের কিনারে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম দিকে কিছুটা ভালো করলেও, করোনা সংক্রমণের প্রবল ধাক্কা লাগে অর্থনীতিতে। এতে বহু লোক কাজ হারায়।  

ট্রাম্প প্রশাসনের নিম্ন এবং মধ্য আয়ের মানুষদের ১২০০ ডলারের দ্বিতীয় উদ্দীপনা চেক দেবার প্রক্রিয়া ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদে আটকে দেয়। এ সমস্ত কিছুই ট্রাম্পের নির্বাচনে পরাজয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। দুজনের ভোটের ব্যবধান ৩ শতাংশের কিছুটা বেশি। অর্থাৎ, সব কিছুর পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের একটা বড় সমর্থন রয়েছে। গত চার বছরে দক্ষিণপন্থার রাজনীতির একটা শক্ত ভিত্তি তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন।

দক্ষিণপন্থার রাজনীতির বিপরীতে গত চার বছরে বামপন্থার রাজনীতির এক অভাবনীয় উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছে—যার সিংহভাগ কৃতিত্ব বার্নি স্যান্ডার্সের। কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব ধরনের বামপন্থীরা নির্বাচনে বাইডেনকে শুধু সমর্থনই করেনি, তিনি যাতে জিতে আসতে পারেন তার জন্য নানাভাবে কাজ করেছে। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের পর যে ব্যাপক বিক্ষোভ গড়ে উঠে, সেটাসহ ট্রাম্প বিরোধী সব বিক্ষোভের নেতৃত্বে থেকেছে বাম সংগঠনগুলো।

ট্রাম্প ধাঁচের দক্ষিণপন্থার পাশাপাশি বামপন্থার উত্থানেও মার্কিন এস্টাবলিস্টমেন্ট চিন্তিত। কিন্তু একই সাথে এটাও এ নির্বাচনে বাস্তবতা যে, বার্নির বিপুল সংখ্যক সমর্থকসহ সব ঘরানার বামদের ভোট ছাড়া বাইডেন নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারতেন না। এতে আগামী চার বছর বামদের প্রবল চাপের মধ্যে তাকে থাকতে হবে, যার ফলে তার পক্ষে অতি ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণ করা দুরূহ হবে। 

 তবে সব কিছু নির্ভর করছে ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপের উপর। এখন পর্যন্ত রিপাবলিকান দলের বাইডেনের জয়কে অস্বীকার করার যে নীতি, তাকে মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা পিপলস ওয়ার্ল্ড এ মাসের ১০ তারিখে প্রকাশিত এক নিবন্ধে "Soft Coup" এর পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করেছে। 

পুরো বিষয়টাকে ট্রাম্প এ মুহূর্তে ঘোলাটে অবস্থায় রেখেছেন। এক দিকে তিনি বলেছেন যে, ২০২৪ সালে তিনি  আবার নির্বাচনে অংশ নেবেন। আবার একই সাথে এ ইঙ্গিতও দিচ্ছেন,  তিনি ক্ষমতা ছাড়ছেন না। তবে এটা পরিষ্কার যে, তিনি যে পদক্ষেপই নেন- তার নিজের এবং দলের রাজনীতির ভবিষ্যত ভেবে- তাকে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে পরাজিত করা হয়েছে, এ অভিযোগ থেকে তিনি পিছিয়ে আসবেন না। 

এমতাবস্থায় ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের গ্রহণযোগ্যতা তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়কের মতো যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হবে, তেমনি মার্কিন গণতন্ত্রকেও এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কেননা, একটি রাষ্ট্র কতোটা গণতান্ত্রিক তার মূল নিয়ামক নির্ভর করে পরাজিত প্রার্থী নির্বাচনের ফল মেনে নিচ্ছেন কিনা সেটার উপর—বিজয়ী প্রার্থীর ফল মেনে নেওয়ার উপর নয়। নিজে নির্বাচিত হবার গ্রহণযোগ্যতা সঙ্কটের ফলে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে অন্য রাষ্ট্রের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দুরূহ হবে। 

ট্রাম্পকে হয়ত শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছেড়ে যেতেই হবে। তিনি যেভাবেই ক্ষমতা ছাড়ুন না কেন, মার্কিন রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার একটা প্রবল উপস্থিতি- যেটা এখন ট্রাম্পইজম বা ট্রাম্পবাদ নামে পরিচিত- রয়ে যাবে। এ দক্ষিণপন্থার সাথে বামপন্থার দ্বন্দ্বই আগামী চার বছরে মার্কিন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। 

পাদটীকা: মার্কিন নির্বাচন একটি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরিচালিত হয় না। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সরকার পৃথক পৃথক ভাবে এ নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে।