গবেষণা পোস্টার উপস্থাপন প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সফলতা ও দুর্বলতা

মোহাম্মদ আব্দুল বাছিত
Published : 14 Nov 2020, 04:05 PM
Updated : 14 Nov 2020, 04:05 PM

একটি জাতির সামাজিক পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন এবং জাতীয় উন্নয়নের সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তরুণ গবেষকদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান, উদ্যম এবং দক্ষতার সর্বোত্তম ব্যবহার অপরিহার্য।  তাই, সম্ভাবনাময় তরুণ বিজ্ঞানীদের প্রতিভা অন্বেষণ ও বিকাশের লক্ষ্যকে সামনে রেখে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে 'ইয়ং  একাডেমি (YA)' যাত্রা শুরু করে।

২০০০ সালে জার্মানিতে সর্বপ্রথম ইয়ং একাডেমি 'Die Junge Akademie' প্রতিষ্ঠার পর পরই বিশ্বের আরও কিছু দেশ তাদের ইয়ং একাডেমি গোড়াপত্তন করেখুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে তরুণ গবেষকদের মাঝে  বিশ্বজনীন পর্যায়ে একটি একাডেমি গড়ে উঠে যার নাম দেওয়া হয় 'গ্লোবাল ইয়ং একাডেমি (GYA)' পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ন্যাশনাল ইয়ং একাডেমি (NYA) স্থাপন এবং তাদের মধ্যে সুসমন্বয় নিশ্চিত করতে গ্লোবাল ইয়ং একাডেমি একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে এবং ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় ৪০টিরও বেশি দেশে ন্যাশনাল ইয়ং একাডেমি  প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা পরামর্শ প্রদান করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করতে একটি স্বচ্ছ বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০ জন শিক্ষক এবং গবেষকের সমন্বয়ে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে 'ন্যাশনাল ইয়ং একাডেমি অব বাংলাদেশ' (এনওয়াইএবি)। 

২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বৈশ্বিক এ দুর্যোগে আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ সুস্থ-স্বাভাবিক  রেখে তাদের জ্ঞানচর্চার স্পৃহাকে অব্যহত রাখার জন্য মে' মাসের ১৩ তারিখ থেকে এনওয়াইএবি ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করে কতকগুলো ওয়েব-বেইজড সেমিনার (ওয়েবিনার)। বিচিত্র বিষয়ের উপর আয়োজিত ওয়েবিনারসমূহ একদিকে যেমন বিজ্ঞান সম্মত সঠিক তথ্য মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে, তেমনি  শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং গবেষকসত্ত্বার বিকাশে অর্থবহ ভূমিকা রেখেছে বলে অনেক প্রবীণ অধ্যাপক এবং বিজ্ঞ গবেষক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। একই লক্ষ্যে পরবর্তীতে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন বিষয়ের উপর নিয়মিতভাবে ওয়েবিনারের আয়োজন শুরু করে যার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছে।

প্রতিবেশী ন্যাশনাল ইয়ং একাডেমিগুলোর সাথে গবেষণা সংযোগ স্থাপন এবং করোনাকালে তরুণ গবেষকদের একটি সুস্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করার লক্ষ্য নিয়ে এনওয়াইএবি অগাস্ট মাসে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের নিয়ে 'ইন্টারন্যাশনাল পোস্টার প্রেজেনটেশন কম্পিটিশন ২০২০' বা সংক্ষেপে 'আইপিপিসি ২০২০' নামে একটি গবেষণা পোস্টার উপস্থাপন প্রতিযোগিতা আয়োজনের ঘোষণা প্রদান করে।

এনওয়াইএবি'র এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়েছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর ইয়ং একাডেমিসমূহ- ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইয়ং একাডেমি অব সায়েন্সেস, শ্রীলংকান একাডেমি অব ইয়ং সায়েন্টিস্ট এবং থাই ইয়ং সায়েন্টিস্ট একাডেমি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উক্ত আয়োজনে গ্রুপ 'এ'  তে স্নাতক, মাস্টার্স এবং গ্রুপ 'বি' তে এমফিল, পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রির জন্য অধ্যয়নরত বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে মর্মে আয়োজক কমিটি একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেন।

চারটি বিষয়ে পৃথক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল: ভৌত বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, ফলিত বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সামাজিক বিজ্ঞান। প্রতিযোগিতার প্রথম পর্যায়ে নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ২৪৩টি গবেষণা পোস্টারের ডিজিটাল ভার্সন আয়োজক কমিটির কাছে জমা দেন।  দাখিলকৃত পোস্টারের মধ্যে  বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জমা পড়ে  ৫০ শতাংশ, ভারত,  শ্রীলংকা এবং থাইল্যান্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জমা পড়ে যথাক্রমে  ৩৬ , ৯ এবং ৫ শতাংশ পোস্টার। এই পর্যায়ে চার আয়োজক দেশের সর্বমোট ৪০ জন বিজ্ঞ বিচারক ছাত্রদের গবেষণা এবং পোস্টারের গুণগত মান বিবেচনা করে ৪৭ জন  প্রতিযোগীর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রণয়ন করেন। প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থানপ্রাপ্ত প্রতিযোগীরা বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলীর সামনে স্লাইডের সাহায্যে পোস্টারে প্রদত্ত গবেষণা কর্ম মৌখিকভাবে অনলাইনে উপস্থাপন করেন। ছাত্রদের উপস্থাপন দক্ষতা এবং উপস্থাপন শেষে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে গবেষণা বিষয়ে তাদের জ্ঞানের গভীরতা মূল্যায়ন করে বিচারকমণ্ডলী নম্বর দেন।  প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত সম্মিলিত নম্বরের ভিত্তিতে বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ ৪টি অনুষদের ২ টি করে মোট ৮টি গ্রুপে সর্বমোট ২৪ জন প্রতিযোগীকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ৮ জনকে বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড এবং বাকিদেরকে ১ম এবং ২য় রানার আপ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। আরও ৭৬ জন প্রতিযোগীকে 'সার্টিফিকেট অব মেরিট' দেওয়া হয়।

অগাস্ট থেকে অক্টোবর মাস অবধি বিভিন্ন যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার ঘোষণার লক্ষ্যে গত ১৭ অক্টোবর ২০২০ অনলাইনে উক্ত প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। উক্ত সমাপনী এবং  পুরস্কার ঘোষণা  অনুষ্ঠানে  প্রতিযোগী শিক্ষার্থী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী, গ্লোবাল ইয়ং অ্যাকাডেমি'র দু'জন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী (প্রাক্তন চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন), ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক চন্দ্রিমা সাহা এবং চার আয়োজক দেশের বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ। উক্ত অনুষ্ঠানে বিজয়ী প্রতিযোগীদের নাম ঘোষণা করেন ৪টি দেশ থেকে নিযুক্ত ৪ জন প্রধান বিচারক। পুরস্কার হিসেবে নগদ অর্থ এবং সার্টিফিকেট বিজয়ীদের নিকট শীঘ্রই প্রেরণ করা হবে মর্মে প্রতিযোগীদের জানানো হয়।

বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কর্ম সম্পাদন করছেন। সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উক্ত গবেষণা কর্ম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপনের সুযোগ পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে এই বিশ্বাস থেকেই এনওয়াইএবি 'আইপিপিসি ২০২০' আয়োজনের উদ্যোগ নেয়। মোট ৪টি অনুষদের বিভিন্ন বিষয়ে ৮টি গ্রুপে ২৪৩ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ২৪ জন বিজয়ী প্রতিযোগীর ফলাফল বিশ্লেষণ করলে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সফলতা এবং দুর্বলতার একটি সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠে। ভারত-থাইল্যান্ড-শ্রীলংকার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা কতটুকু অর্জন করতে পারবে তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু, গ্রুপ 'এ' তে অর্থাৎ অনার্স এবং মাস্টার্স লেভেলে  ১৫ টি পুরস্কারের মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ২টি বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ডসহ মোট ১১ টি, শ্রীলঙ্কান শিক্ষার্থীরা  ১টি বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ডসহ মোট ২টি, ভারত এবং থাইল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা যথাক্রমে ১টি বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড এবং ১টি রানার আপ অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। অন্যদিকে, গ্রুপ 'বি' তে অর্থাৎ এমফিল এবং পিএইচডি লেভেলে সর্বমোট ৯টি পুরস্কারের মধ্যে মাত্র ১টি বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড লাভ করে শ্রীলংকার একজন শিক্ষার্থী,  ৩টি বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড সহ বাকি মোট ৮ টি পুরস্কার লাভ করে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছিল আইআইটি খড়গপুর, আইআইটি হায়দারাবাদ, আইআইটি রোপার, আইআইএসসি ব্যাঙ্গালোর, আইআইএসইআর কলকাতা, সিএসআইআর-সিএসআইও চণ্ডীগড়।

অনার্স এবং মাস্টার্স লেভেলে আমাদের শিক্ষার্থীদের সাফল্য ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ, তবে অত্যন্ত দুঃখের সাথে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, গ্রুপ 'বি' তে অর্থাৎ পিএইচডি লেভেলে আমাদের সাফল্য শূন্যের কোঠায়।  বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থী কোন পুরস্কার লাভ করেনি। মাত্র একটি প্রতিযোগিতা থেকে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সমীচীন হবে না বলে অনেকেই মতামত প্রদান করবেন, তদুপরি বলতে হচ্ছে, এটাই আসলে আমাদের সামগ্রিক চিত্র। নিঃসংকোচে বলা যায়,  অসম্ভব মেধাবী আমাদের শিক্ষার্থীরা, শুধু প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারা দেশে উচ্চতর গবেষণায় নিজেদের মেধা এবং প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাতে পারেন না।ফলস্বরূপ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনো সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠে না, জ্ঞান সৃষ্টিতে আমাদের  বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক মানচিত্রে কোন অবদান রাখতে পারে না।

পরিশেষে আমাদের সকলের জানা কথাগুলো সংক্ষেপে আবারও বলতে চাই, জাতীয় স্বার্থে শিক্ষা এবং গবেষণার আন্তর্জাতিকীকরণ অপরিহার্য। শিক্ষা এবং গবেষণায় আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে হলে এখনই আমাদের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে  দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যোগ্য শিক্ষাবিদকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে কেবল 'একাডেমিক এক্সিলেন্স'-কেই শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পদোন্নয়নের জন্য বিবেচনা করতে হবে। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও  দেশ থেকে মানসম্মত পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী ব্যতিক্রমী ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের তত্ত্বাবধায়কদেরকে উদ্দীপনা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদেরকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন এনে  উন্নত গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে এবং একই সাথে আন্তর্জাতিক কোলাবরেশন বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থা থেকে যে সকল গবেষণা অনুদান এবং ফেলোশিপ প্রদান করা হয় তা আরও সুপরিকল্পিতভাবে প্রদান করতে হবে যাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে উৎসাহী হয়। অন্যথায়, দুই লেভেলে এমন বিপরীতমুখী ফলাফল আরও বহু যুগ আমাদের হজম করতে হবে।