ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য করণীয় কী?

গোলাম মোরশেদ
Published : 7 Nov 2020, 07:43 AM
Updated : 7 Nov 2020, 07:43 AM

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষার হার ৬৫.৬% (পুরুষ ৬৭.৮% এবং নারী ৬৩.৪%)। তবে গত কয়েক দশকে শিক্ষার হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও এখন পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা যায়নি। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ২০১৯-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির গ্রস হার ১০৯.৪৯% এবং নীট হার ৯৭.৩৪%। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০১৯ অনুযায়ী এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি যোগ্য বয়সীদের ৬.৪৮% শিশু বিদ্যালয়েই ভর্তি হতে পারে না যা সংখ্যায় মোটেও সামান্য নয়। এই হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, নিম্ন মাধ্যমিকে ভর্তি যোগ্যদের মধ্যে ৩১.৫% শিশু শিক্ষার বাইরে অবস্থান করছে। ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের একটা নির্দিষ্ট অংশ প্রতিবছর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ছে। যদিও গত এক দশকে ঝরে পড়া হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে ঝরে পড়ার হার ১৭.৯০% যা এক দশক আগেও দ্বিগুণের বেশি ছিল। তবে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় সামগ্রিকভাবে ঝরে পড়া হ্রাস পেলেও কিছু কিছু বয়স বর্গে তা উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। যেমন, ব্যানবেইসের 'বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য-২০১৮' এর প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, এক বছরের ব্যবধানে মাধ্যমিকে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ২.৫% বেড়েছে। আর ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ১% এর কিছু বেশি কমলেও এখনো ছাত্রদের তুলনায় বেশি রয়েছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ঝরে পড়া রোধ করে ছেলে-মেয়েদের একটি সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণ করা সম্ভব।

বিবিএসের সর্বশেষ শ্রম শক্তি জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ (২৯.৮%) রয়েছে যারা না আছে পড়াশুনায়, না কর্মে, না কোনো প্রশিক্ষণে। আবার এদের মধ্যে প্রতি দশ জনে নয় জনই নারী (৮৭%)। এদের একটা ভাগ যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী তা সহজেই অনুমান করা যায়। ২০২০ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায় যে, তারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির সময় মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৫০ জনের অধিক অথচ এদের মাঝে মাত্র ৯৩ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। যারা পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মেয়ে।

ঝরে পড়া রোধ করতে হলে প্রথমে সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে প্রতি বছর শেষে কী কী কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। এই কারণসমূহের ক্যাটাগরি বিশ্লেষণ করতে হবে। জানতে হবে সমাজের কোন ক্যাটাগরির সন্তানদের মধ্যে ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বয়স প্রভৃতি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে। যেমন ধনী বা সচ্ছল পরিবারের তুলনায় দরিদ্র বা অসচ্ছল পরিবারে কিংবা শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কি বেশি? প্রতিটা ক্যাটাগরির বা দলের সন্তানদের ঝরে পড়ার পেছনে কারণগুলো কি একইরকম নাকি ভিন্ন?

গবেষণায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার বিভিন্ন কারণ জানা যায়। ছাত্রাবস্থায় বিবাহিত ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই (বিশেষত মেয়েরা) ঝরে পড়েছে বলে জানা যায় কিংবা বিয়ের উদ্দেশ্যে অনেকেরই পড়াশুনা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের পাশাপাশি দারিদ্র ও নিরাপত্তাহীনতা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সময়ে বেশ কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে যেখানে জানা যায় যে, বিদ্যালয় বা কলেজে যাওয়ার পথে হয়রানী কিংবা উত্যক্ত হওয়ার কারণে পড়াশুনা ছেড়ে দেয়। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর ওপর ঘটে যাওয়া নিপীড়নের ঘটনা অভিভাবকদের মনে এক ধরনের আতংক সৃষ্টি করেছে বলে অনুমান করা যায়। বর্তমানে ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের ৩২.৯% বিবাহিত। ২০-২৪ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৫.৫% মেয়েরা পনের বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে করেছে এবং ৫১.৪% আঠারো বছরের আগে বিয়ে করেছে। কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে যারা কোনো একটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে কিংবা আশানুরূপ ফলাফল না হলে পড়াশুনা ছেড়ে দেয়। গ্রামীণ এলাকায় যুবকদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এরকম অবস্থায় অনেকেই শ্রমিক হিসেবে দেশের বাইরে চলে যায়। আবার কিছু শিক্ষার্থী ছাত্রাবস্থায় প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে যার পরিণতি হিসেবে ঝরে পড়ে। কেউ কেউ ছাত্রাবস্থায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। সংখ্যায় কম হলেও পরিবারের বাইরে একা থাকতে না পারা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশোভন আচরণ যেমন, র‌্যাগিং, বুলিংসহ বিভিন্ন কারণে অনেকেই ঝরে পড়ে।

শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিশুদের একটা বড় অংশ অভিভাবকহীন পথশিশু। এ ধরনের শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সরকারকে বিশেষায়িত প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। তবে তার পূর্বে কোনো স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান দ্বারা গবেষণা করাতে হবে যে, কোন উন্নয়ন মডেলটি কার্যকর হবে তা নির্ধারণ করার জন্য। আবার যে সকল গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছে তাদের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। ঝরে পড়া শিশুদের মধ্যে একটি অংশ বিশেষ চাহিদাসম্পপন্ন শিশু। তাদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যমে হওয়ার কারণে যে সকল শিশুদের মাতৃভাষা বাংলা কিংবা ইংরেজি কোনোটিই নয় তাদের জন্য প্রাথমিক পর্বে ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ মূলধারার বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ বেশি থাকে। কেননা নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্য বই না থাকা এবং দক্ষ শিক্ষকের সংকট তাদের মাঝে ঝরে পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করে। শুধু ভাষাগত সমস্যার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে অনেক শিশু। দুর্গম এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যবই ও পাঠদানের ভাষা বুঝতে না পেরে শিশুরা ঝরে পড়ছে।

এছাড়া এলাকাভিত্তিক ঝরে পড়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। কিছু এলাকায় দেখা যায় যে, স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবেশগত ভিন্নতার কারণে বিশেষ মৌসুমে শিক্ষার্থীদের পারিবারিক কাজে যুক্ত হতে হয়। তখন বিদ্যালয়ে না যেতে যেতে ঝরে পড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া শিক্ষকদের রূঢ় আচরণ, ঘনঘন পরীক্ষার চাপ, প্রাথমিক স্তর থেকে ওপরের দিকে শিক্ষার ব্যয় ক্রমেই বেড়ে যাওয়া, ব্যয়বহুল প্রাইভেট কোচিং ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই শিশুশ্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ৫-১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬.৮% শিশু শিশুশ্রমের সাথে জড়িত আছে। এক্ষেত্রে ঝরে পড়া ঠেকাতে পারলে প্রত্যক্ষভাবে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভবপর হবে।

সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্য বই বিতরণ, শিক্ষা বৃত্তি ও স্কুল ফিডিং কর্মসূচিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ও দেশি-বিদেশী সংস্থার শিক্ষা প্রোগ্রামগুলো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি অধিক উন্নতির জন্য কর্তৃপক্ষকে আরো যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় শিক্ষার্থীদের একটি জাতীয় ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু পাঠদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ না করে এক একটি তথ্য ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে হবে। ফলে প্রতি শিক্ষাবর্ষ শেষে খুব সহজেই কোন কোন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কী কী কারণে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়েছে তা পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার অনুসন্ধান করতে হবে। প্রধান শিক্ষককে প্রতিটা শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার কারণসমূহের একটি প্রতিবেদন উপজেলা/জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর প্রেরণ করতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ঝুঁকিপ্রবণ শিক্ষার্থীর পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতি শিক্ষাবর্ষে কতজন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হচ্ছে এবং তাদের মাঝে কতজন পরবর্তীতে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে কিংবা ঝরে পড়ছে তার ফলো-আপ করতে হবে। অকৃতকার্য হওয়ার কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ফিরে আনতে বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পুনরায় ভর্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেই বয়সী শিক্ষার্থীদের মাঝে ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি তাদের বিশেষ কাউন্সিলিং প্রোগ্রামের অধীনে নিয়ে আসা দরকার। বিদ্যালয়ে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ঝুঁকিপ্রবণ শিক্ষার্থীর এবং তাদের পারিবারিক কাউন্সিলিংয়ের দায়িত্ব পৃথক পৃথক শিক্ষকের উপর অর্পণ করতে হবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য আলাদা প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরো সচেতন হতে হবে। তাদের বিশেষ যত্নের নির্দেশনা দিতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া রোধে শিক্ষা বৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে যেন তাদের পরিবার শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার খরচকে কোনোভাবেই বোঝা মনে না করে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অভিভাবক সভা অনুষ্ঠিত হতে হবে। ঝরে পড়া ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলা ও বিনোদনমূলক কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে হবে। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পর্যায়ে বয়সবর্গ বিবেচনায় প্রয়োজনীয় খেলনা উপহার দিতে হবে। মুলধারার বাইরের জনগোষ্ঠীর শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার কমাতে মাতৃভাষাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে জোরাল ভূমিকা পালন করতে হবে। যে সকল ছেলেমেয়েরা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না তাদের কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষা সংক্রান্ত প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্পে দেশি-বিদেশী সংস্থাগুলোর যেসব মডেল ও দৃষ্টিভঙ্গি সফলতা অর্জন করেছে তা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা যাতে ভীতিকর না হয়ে আগ্রহের বিষয় হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে র‌্যাগিং কিংবা বুলিংয়ের মত ঘটনার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে।