সহিংসতার পর মুখ রক্ষা

শিহাবুর রহমান
Published : 13 Oct 2012, 05:26 PM
Updated : 13 Oct 2012, 05:26 PM

কক্সবাজারে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত ধর্মীয় সহিংসতার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর চীন আন্তর্জাতিক বেতারে আমার এক ভারতীয় সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞেস করেন, 'বাংলাদেশে কী হয়েছে'। আপততদৃষ্টিত প্রশ্নটি খুব সাধারণ ছিল। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত অর্থ অতটা সাধারণ ছিল না। প্রশ্নকারীর ভঙ্গিমা বলছিল, তিনি শুধু ঘটনাটি জানতে চান নি; তিনি চেয়েছেন আমি স্বীকার করে নেই যে, ধর্মীয়ভাবে বাংলাদেশ খুব অসহনশীল এবং এখানে যে কোনো সময় সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা দিতে পারে – আমরা যে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তা মানুষকে বোঝানোর জন্য যত প্রচেষ্টা নেই না কেন।

আলোচনার সময় আমার ওই সহকর্মী ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সেই ধর্মীয় সহিংসতার কথা পাড়তে ভোলেন নি, যার শিকার হয়েছিল এদেশের বৃহত্তম সংখ্যলঘু হিন্দু সম্প্রদায়। আমি একটু বাঁকা করে তাঁর কথার জবাব দিতে পারতাম। আমি বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করে কথা বলতে পারতাম ('বাংলাদেশের পক্ষে' বলছি এ কারণে যে, বিদেশিরা কক্সবাজারের ঘটনার জন্য গোটা জাতির ছোট একটা অংশ ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দোষ দিচ্ছেন না; তারা দোষ দিচ্ছেন বাংলাদেশকে) – এ ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা তুলনা টেনে এবং প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভারতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ইতিহাস তুলে ধরে। কিন্তু আমি তা থেকে বিরত থাকি এবং জবাব দেই, 'হ্যাঁ, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এবং আমরা, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ, এজন্য লজ্জিত এবং এর নিন্দা জানাই'। আমি উপলব্ধি করি, দেশের সম্মান গেলেও একজন ভারতীয় নাগরিকের সামনেও এ ঘটনাকে ছোট করে দেখানোর কোনো জো নেই, যদিও ভারতে বিভিন্ন সময়ে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এর চেয়ে গুরুতর সহিংসতা ঘটেছে।

আমার ধারণা কেবল আমাকেই এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না; পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে অবস্থানকারী প্রতিটি বাংলাদেশিকে এমন ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। বস্তুতপক্ষে জাতির কেউই এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে না, যেমন পারা যায় না জাতির কিংবা তার একজন সদস্য অর্জিত সাফল্যের আনন্দ থেকে কোনো একজনকে বঞ্চিত করতে। জাতির সদস্য হিসেবেই আমরা ড. ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনে সম্মানিত হয়েছি, যদিও সেক্ষেত্রে আমাদের কোনোই অবদান ছিল না।

সেই বিবেচনায় কক্সবাজার ঘটনায় গোটা জাতির ওপর দোষ চাপিয়ে বিদেশিরা দোষের কিছু করেন নি। এবং জনসংখ্যার তুলনায় সামান্য সংখ্যক মানুষ যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এমন একটি হামলা চালাতে সক্ষম হয় এবং জাতির অবশিষ্টরা এবং গোটা প্রশাসন যদি তাদেরকে থামাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গোটা জাতিই অপবাদের দাবিদার দায় বহন করবে। আর এভাবেই আমরা কিছু সংখ্যক ধর্মীয় উগ্রবাদীর কাছে হারাই আমাদের দীর্ঘ দিন ধরে অর্জিত ধর্মনিরেপেক্ষ জাতির মর্যাদা।

সহিংসতা-পরবর্তীকালে বাংলাদশের সংবাদমাধ্যমে এ ঘটনার বিরুদ্ধে যে উচ্চবাচ্য চলছে তা দেখে যে কেউ এ ঘটনার দুঃখ কিছুটা প্রশমন করতে পারেন এবং মেনে নিতে পারেন যে দেশের বেশিভাগ মানুষ এ হীন কাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু রামু, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বৌদ্ধদের জীবনের ও সম্পদের যে হানি ঘটেছে এবং সেখানকার মন্দির ও মঠের ক্ষতি যে হয়েছে, তা অপূরণীয় – যেমনটি অপূরণীয় জাতির ভাবমূর্তিতে সৃষ্ট ক্ষতি। এ ঘটনার হোতাদের বিরুদ্ধে সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক না কেন – আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের হৃদয়ে যে ক্ষত হয়েছে, তা কোনদিন সারবে না এবং তাদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে তা দূর হবে না। আমরা তাদেরকে বোঝাতে পারবো না যে এই দেশটি তাদের বসবাসের জন্য নিরাপদ। বাংলাদেশে প্রতিদিন যে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে তার অন্যতম কারণ তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান এই নিরাপত্তাহীনতা। বাংলাদেশে অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যারা এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা বা অস্বীকার করবেন। কিন্তু আমি জানি কেন আমার স্কুল জীবনের বেশিরভাগ হিন্দু সহপাঠী আর এদেশে নেই; কেন তারা অনিশ্চিত যাত্রায় বেরিয়েছিল পেছনে ফেলে রেখে তাদের মায়াময় পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি, যেখানে তাদের জন্ম হয়েছিল, যেখানে আপনজনদের সঙ্গে তাদের দুরন্ত শৈশব কেটেছিল এবং যেখানকার পারিপার্শ্বিকতা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।

এখন কক্সবাজার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত, দায়ি ব্যক্তিদের গ্রেফতার এবং বিচারে সোপর্দ করা, আক্রান্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত মূল্যবান নিদর্শন পুনরানায়ন করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা আতঙ্কিত মানুষদের সেই নিরপত্তা নিশ্চিত করাসহ সহিংসতা-পরবর্তী বিষয়গুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সম্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে পারে।

কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে কারো পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ন্যায় বিচার পাবে। শক্ত হাতে ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দরকার ছিল যে সব দল সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে একটা ঐকমত্য। প্রধান দুই দল – ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি – দুই ভিন্ন পথে রয়েছে এবং এ রকম ঐকমত্য থেকে তাদের অবস্থান অনেক দূরে। অন্য সব ঘটনার মতো এ ক্ষেত্রেও তারা একে অন্যকে দোষারোপ করার খেলায় মেতেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যকার এই দোষারোপ-খেলার উদ্দেশ্য হতভাগ্য মানুষগুলোর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা নয়; বরং তার লক্ষ্য ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা।

সংখ্যলঘু সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের রক্ষা করা দরকার শুধু এ জন্যই নয় যে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব সংবিধানই দিয়েছে; এটা এ জন্যও দরকার যে তাদেরকে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করার অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রাষ্ট্র করেছে। সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ থেকে শুরু করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং সব ধরনের বর্ণবৈষম্য নির্মূল বিষয়ক চুক্তি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনি দলিলগুলোতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর বা অনুস্বাক্ষর করেছে। সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও সে বিক্ষোভ ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কুটনীতিকদের ডেকে এই আশার বাণী শুনিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে 'অপরাধের প্রতি শূন্য সহনশীলতা নীতি' অবলম্বন করবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে যদি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় তাহলে দেশে ও বিদেশে সরকার সামান্য হলেও মুখ রক্ষা করতে পারবে। সেক্ষেত্রে সরকার বলতে পারবে আমরা ঘটনা প্রতিরোধে সক্ষম না হলেও এটা আমরা বরদাশত করি নি। এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই কেবল সরকার পারে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধ করতে।

শিহাবুর রহমান:সাংবাদিক।