যে সমীকরণে পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন ট্রাম্প

মর্তুজা হাসান সৈকতমর্তুজা হাসান সৈকত
Published : 31 Oct 2020, 08:06 AM
Updated : 31 Oct 2020, 08:06 AM

সারাবিশ্বের দৃষ্টি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। আগামী ৩ নভেম্বর দেশটির জনগণ তাদের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে বেশ এগিয়ে রয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন৷ যদিও এসব জনমত জরিপগুলোয় রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্র্যাটদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি ছিল।

কিছুদিন আগেও মার্কিন নির্বাচন নিয়ে অবস্থা অনেকটা এমন ছিল যে, অধিকাংশ নির্বাচন বিশ্লেষকই ট্রাম্প জমানার শেষ দেখে ফেলছিলেন। তবে নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ততই ধীর লয়ে এগিয়ে যাওয়ার খবর আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৫০টি অঙ্গরাজ্য থাকলেও মোটামুটি ১২টি রাজ্য ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা কখনো রিপাকলিকানদের জয়ী করে আবার কখনো ডেমোক্র্যাটদের। এই রাজ্যগুলোকে বলা হয় সুইং স্টেট। সম্প্রতি এখান থেকে ট্রাম্পের জন্য সুখবরই আসছে বলা যায়।

সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, এসব অঙ্গরাজ্যে বাইডেন খুব বেশি একটা এগিয়ে নেই। অন্যদিকে দুই তিনটি অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্পও এগিয়ে আছেন। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন জরিপে যেখানে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে দুই অঙ্কের ব্যবধানে এগিয়ে দেখানো হয়েছিল, বর্তমানে সেই ব্যবধান কমতে কমতে ৫-৬ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রচলিত নীতি অনুসারে জরিপের ফলাফলে সব সময় ভুলত্রুটির পরিমাণ ৩ শতাংশ থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রাম্পের অগ্রযাত্রা ইতোমধ্যে ভোটারদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বেশ আগে থেকেই দাবি করে আসছেন, আসন্ন নির্বাচনে তিনি ২০১৬ সালের চেয়েও বড় ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনকে হারাতে পারবেন৷ ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকরাও তাই আশা ছাড়তে রাজি নন। তারা বলছেন, ট্রাম্প যা চান, তা ঠিকই করে ফেলেন।

এবার এখন পর্যন্ত ৭ কোটি ১০ লাখেরও বেশি মানুষ আগাম ভোট দিয়ে ফেলেছেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ সংখ্যাটা ১০ কোটিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। এদের অধিকাংশই ডেমোক্র্যাট সমর্থক। আগাম বা পোস্টাল ভোট এবার এত বেশি পড়ার কারণ হচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেকই গণজমায়েত এড়িয়ে চলতে চাইছেন। আবার অনেক ভোটার মনে করছেন, নির্বাচনের দিন দেশটির অনেক স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতে পারে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পোস্টাল ভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এমন ভোটের মাধ্যমে জালিয়াতির সুযোগ তৈরি হয় বলে তিনি জানিয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের রায় আদালত পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভাবনা দেখছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। কারণ প্রেসিডেন্ট এমনও বলছেন, নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলে তা মেনে না-ও নিতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন। এই প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‌প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ডাকযোগে ভোট প্রদানের বিরোধিতা করে বলেছেন, এই ব্যবস্থায় জালিয়াতি হবে। মূলত এসব বলার মাধ্যমে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার পথ সুগম করে রাখতে চাইছেন। যাতে ফলাফল নিজের পক্ষে না হলে রিপাবলিকানরা আইনি লড়াইয়ে নামতে পারে।

এর পাশাপাশি জনমত জরিপে বেশ পিছিয়ে থাকা ট্রাম্প সম্প্রতি ভাগ্য পরিবর্তনে বেশ কয়েকটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যার প্রভাব জনমত জরিপগুলোতেও প্রতিফলত হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে একজন রক্ষণশীল বিচারপতির সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ চূড়ান্ত করা। আরেকটি হচ্ছে, চীনকে ঠেকানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর। এই সামরিক চুক্তির আওতায় এখন থেকে দেশ দুটি একে অপরের স্যাটেলাইট ও মানচিত্রের স্পর্শকাতর তথ্যসমূহ শেয়ার করবে। এই ব্যাপারগুলো শেষ মুহূর্তের ভোটারদের উজ্জীবিত করতে পারে ট্রাম্পকে পুনরায় নির্বাচিত করতে।

এই প্রসঙ্গে অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, ক্ষমতার পুরোটা মেয়াদ জুড়ে মার্কিন ফেডারেল আদালতগুলোয় রক্ষণশীল বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া ট্রাম্প শেষদিকে এসে রক্ষণশীল বলে পরিচিত অ্যামি কোনি ব্যারেটকে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ চূড়ান্ত করে সবচেয়ে বড় দানটি মেরেছেন। যা যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল, বিশেষত ইভানজেলিক্যাল ভোটারদের মধ্যে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। এসব ভোটারদের অনেকদিনের দাবি ছিল, গর্ভপাতের যে অধিকার বর্তমানে প্রচলিত আছে, সে আইনের সম্পূর্ণ রদ। ব্যারেট ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক, গর্ভপাত প্রশ্নে তার বিরোধিতা সুপরিচিত। তাই তিনি সে আইন রদে অধিক ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন বলেই ভাবছেন ভোটারদের এই অংশ। তাই ব্যারেটকে 'ট্রাম্পকার্ড' হিসেবে ব্যবহার করে ট্রাম্প আশা করছেন, তার এই উপহারের জবাবে উজ্জীবিত রক্ষণশীল ভোটাররা তাকে পুনরায় নির্বাচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

তাছাড়া, বিচারপতি ব্যারেটের নিয়োগ ট্রাম্পকে আরও একটি ক্ষেত্রে এগিয়ে দিতে পারে। ট্রাম্প এবার ব্যালটের মাধ্যমে নয়, তার পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের রায়েই নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত করতে চাইছেন। এজন্য কৌশলে তিনি এমন কিছু কাজ তিনি করছেন যাতে নির্বাচনের ফলাফল পক্ষে না এলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সহজ হয়। এর পাশাপাশি পোস্টাল ভোটের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে বারবার বলছেন এ ভোটের মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটরা জালিয়াতি করবেন।

অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে ফলাফল বিপক্ষে গেলে ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন। তখন মেশিনে ব্যালট গণনার সময় তা ভুলভাবে গোনা হয়েছে এমন অনেক যুক্তি উপস্থাপন করে পুনরায় ভোট গণনার আবেদন করা হবে। আর এমনটাই যদি ঘটেই তাহলে আরও একবার নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে সুপ্রিম কোর্ট। এই কারণে আগেভাগেই সুপ্রিম কোর্টকে রিপাবলিকানপন্থী বিচারক দিয়ে ভরে রেখেছেন ট্রাম্প।

বলা তো যায় না, কি না কি ঘটে যায়। এই বিচারপতিদের পক্ষপাতিত্বের কারণেই জর্জ বুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানো কিন্তু অমূলক ভাবনা নয়। কারণ, কাগজে-কলমে মার্কিন বিচারপতিরা নিজেদের নিরপেক্ষ দাবি করলেও, তারা আসলে দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে রক্ষণশীল বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।

ব্যারেটের নিয়োগের ফলে বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক বিচারপতিদের অনুপাত ৬: ৩। অ্যামি ব্যারেটের নিয়োগ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খোলাখুলিই জানিয়েছিলেন যে, ডেমোক্র্যাটরা বিপুল কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তার পছন্দমাফিক একজন বিচারপতি নিয়োগ হওয়ায় এখন তেমন ভয় আর তার থাকছে না।

২০০০ সালে আল গোর বনাম জর্জ বুশের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল। ফ্লোরিডায় দুই প্রার্থীর ভোটসংখ্যা খুব কাছাকাছি হওয়ায় আবারও গণনার প্রয়োজন পড়ে। সেবার ৯ সদস্যের সুপ্রিম কোর্টের রায় ৫-৪-এ জর্জ বুশের পক্ষে যায়। পক্ষপাতদুষ্ট সেই রায়ে মাত্র ৫৩৭ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় জর্জ বুশকে। নিপাট ভদ্রলোক আল গোর গণতন্ত্রের স্বার্থে সে রায় মেনে নিলেও পরবর্তীকালে দেখা গেল, ফ্লোরিডার ভোট যদি সঠিকভাবে গণনা করা হতো, তাহলে আল গোরই হতেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম প্রেসিডেন্ট।

পরিস্থিতি যেভাবে আগাচ্ছে তাতে ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মামলাও যে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে, এটাই বাস্তবতা। ডেমোক্র্যাটদের এটা এড়ানোর উপায় কেবল একটাই— জো বাইডেনকে এত বিপুল সংখ্যাক ভোট পেতে হবে যে, যাতে কোনো আইনি লড়াইয়ের প্রশ্নই না ওঠে। এমনটা যদি নাই হয়, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিষয়টিকে ডনাল্ড ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাবেন। সেখানেই ডেমোক্র্যাটদের ভয়। কারণ, রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের প্রতি পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। অতীত ইতিহাস বিবেচনায় নিলে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

যুক্তরাষ্ট্রে এবার মোট ভোটার ২৪ কোটি, এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত ১৮-১৯ কোটি ভোট ব্যালটে পড়তে পারে। আগাম ভোটে এখন পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটরা এগিয়ে থাকলেও নির্বাচনের দিনে রিপাবলিকানদের ভোটই ব্যালটে পড়বে বেশি। কারণ, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে কেন্দ্রে যেয়ে ভোট দেওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক কম। অন্যদিকে শেষ মুহূর্তে ভোটার তালিকাভুক্তির ব্যাপারে রিপাবলিকানরা এগিয়ে। এর পাশাপাশি হোয়াইট সু‌প্রি‌মে‌সিরও পুরো ফায়দা তুলতে চাইবেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে এখনো সাদা চামড়ার ভোটার ৬৭ শতাংশ, এরা সাধারণত রিপাব‌লিকান‌দের ভোট দেন। জরিপে এদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বেশ কম থাকে।

এসব বিবেচনায় নিয়ে জরিপের ফলাফলের চেয়েও নির্বাচন বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার হবে বলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাইডেন শিবির থেকে। এই সমীকরণ গুলোর সাথে ২০১৬ সালকে যদি স্মরণে রাখা হয় তাহলে ডনাল্ড ট্রাম্পকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো স্বাভাবিক অবস্থাকে যেকোনো অস্বাভাবিক অবস্থায় রূপান্তর করতে পারঙ্গম ট্রাম্প শেষ মুহূর্তে আদালতের রায়ে ভর করেও যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়ে যান, তাহলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।