নরসুন্দর হে!

সাদিকুল আওয়াল
Published : 27 Oct 2020, 08:11 AM
Updated : 27 Oct 2020, 08:11 AM

শিশুকাল থেকেই আমার মাথার চুল খুব ঘন ছিল। সেই সাথে চুলগুলো মোটা মোটা। আর মোটা হওয়ার কারণে একেবারেই খাড়া খাড়া। অনেকটা গ্রামের ছনের (শুদ্ধ ভাষায় বলে শণ, আমরা গ্রামের ভাষায় বলতাম ছোন) জমির মতো। যারা ছনের জমি দেখেছেন তারা জানেন ছন কেটে নেয়ার পর মাঠের কি অবস্থা হয়। কেটে নেয়ার পর ছনের যে গোড়া থেকে যায়, প্রতিটাই একদম খাড়া হয়ে থাকে। খালি পায়ে ছনের মাঠে হাটা অসাধ্য হয়ে পড়ে। চুলের এই অবস্থার কারণে চুল কাটাতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে, অহরহই। সেই বালক বয়স থেকেই কত যে সেলুনের নাপিতদের বিরক্তির কারণ হয়েছি!

শৈশবে কিছুদিন গ্রামে থাকতে হয়েছিল। গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার সরলতা, সহজ হিসেব-নিকেষ, কিছু কিছু বৈচিত্র্য এখনও মনে দাগ কেটে আছে। যেমন গ্রামে চুল কাটার ব্যাপারটি! গৃহস্থের পরিবারে সারা বছরের জন্যে একজন নাপিত ঠিক করা থাকত। দুই মাস, তিন মাস পরপর নাপিত এসে বাড়ির বয়স্ক পুরুষ থেকে শুরু করে বালক-শিশু সব পুরুষ সদস্যদের চুল কেটে দিয়ে যেত। পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক বা মুরুব্বি যার পছন্দ-অপছন্দ, মতামত আর কথামতোই প্রত্যেকের চুল কাটানো হতো। কার মাথায় বাটি ছাট দিতে হবে, কার মাথা একেবারেই কামিয়ে ফেলতে হবে সবকিছুর নির্দেশনা আসত তার থেকে। তিনি হতেন চুল কাটানোর স্টাইল বিশেষজ্ঞ, ডিজাইনার, প্রযোজক এবং নির্দেশক-পরিচালক। একের ভেতর অনেক! নাপিতের পারিশ্রমিক ছিল বছর শেষে। যখন ঘরে ধান উঠত নাপিত এসে তার সারা বছরের পারিশ্রমিক হিসাবে কাঠায় মেপে ধান নিয়ে যেত।

ছোটদের চুল কাটা হতো আগে। নাপিত নিজে একটা উঁচু মতো পিঁড়িতে বসত। মাথার চাঁদির ওপরের চুল চিরুনি দিয়ে আটকে নিয়ে কাঁচি দিয়ে কচ কচ করে ছোট করেই মাথার পিছনের চুল কাটাতে মনোনিবেশ করত। মাথার পিছনের চুল কাটার সময় সেলুনের নাপিতেরা যে চুল কাটাচ্ছে তার পেছনে চলে যায় বা পেছন থেকেই কাটে। পিঁড়িতে বসে, কখনও মুখে পাতার বিড়ি নিয়ে আয়েশ করে বসা গ্রামের এই নাপিতেরা যখন পেছনের চুল কাটত তারা নিজের আসনেই ঠায় বসে থাকত। কি দরকার বাপু কষ্ট করে পিঁড়ি থেকে উঠে মাথার পিছনে যাওয়া! মাথার পিছনটা টেনে সামনে আনলেই তো হয়। চুল কাটা বলে কথা। যার চুল কাটছে তার মাথাকেই সামনে টেনে হিচড়ে চোখের সামনে আনা হতো। অনেকটা পুজোর সময় পাঁঠা বলি দেওয়ার সময় পশুটির গলা দুই ফাটকের মাঝে আটকে দেওয়ার মতো, নাপিত বালকের মাথা তার দুই হাটুর মাঝে চেপে ধরে মাথার পেছনের চুল কাটতো। নড়াচড়া করলেই দুই হাটুর চাপ দুদিক থেকে, দুই কান বরাবর। মাথাটা এমনভাবে চেপে ধরা হতো যে, যে চুল কাটাচ্ছে তার মাথার চাঁদি নাপিতের পেটে গিয়ে ঠেকতো আর নাক থাকতো নাপিতের নাভীর নিচ বরাবর। নাপিতের পরনের ধুতি কতদিন আগে পরিষ্কার করা হয়েছে তা কারো মাথাতেও আসত না। সারাদিন এই একই ধুতি পরে কতবার ছোট অথবা বড় টয়লেট করত তাও বিবেচনার ভিতরে থাকত না। নাকে কোনো "খুশবু" আসত কি না তা আজ আর মনে নেই। তবে আমার মাথার ভেতর আজও আটকে আছে একটা খুশবু। যখন কানের দুই পাশের জুলফির চুল ক্ষুর দিয়ে কামিয়ে ছোট করত, কাজটি মহাশয় খুব যত্নে করতেন। ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে করতেন। ভালোবেসে করতেন। ভালোবাসার আতিশয্যে হলদেটে দাঁতে ভরা মুখটা একেবারেই মুখের কাছে এনে, পাতার বিড়ি খাওয়া নিশ্বাস নাক মুখ দিয়ে ছেড়ে খুশবুতে ভরে দিতেন। খুশবুটি এতটাই তীব্র ছিল, আমার মাথার মগজের কিছু কোষে এখনও আটকে আছে। আরেকটি জিনিস মগজের কোষে আটকে নেই, স্মৃতির পাতায় ইমপ্রিন্ট হয়ে আছে। বড়রা চুলকাটা হয়ে গেলে ময়লা জমা, রোদে পুড়ে কুচকুচে কালো রঙের বগলটি নাপিত বাবুর সামনে তুলে ধরতেন।

বালক বয়স হওয়ার পরেও আমার মাথার চুল কাটা হতো সবার পরে। বড়দেরও পরে। আমাকে দেখলেই মহাশয় বলে উঠতেন "এর চুল কাটব সবার পরে। এর চুল কাটার পর কাঁচিতে আর ধার থাকে না"। চুল কাটার সময় আবারও বিড়বিড় করা মন্তব্য, "বাবারে বাবা, শজারুর কাঁটাও এর থেকে নরম হয়"!

ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। ঢাকায় শাজাহানপুরে বাসার কাছেই মোড়ের সেলুনে চুল কাটাতে যেতাম। আমাকে দেখলেই সেলুনের নাপিতের মুখে একটু গোমড়া ভাব চলে আসত। সেলুনের যিনি আমার চুল কাটতেন, সিদ্দিক ভাই, সুদর্শন চেহারা। মোটাসোটা, নাকের নিচে বাহারি গোঁফ। সবসময় ধবধবে সাদা ফতুয়া আর সাদা লুঙ্গি পড়ে থাকতেন।

সেলুনে সপ্তাহে একবার দুবার শেভও করিয়ে নিতাম। সেলুনে আসলেই সিদ্দিক ভাই আগে আমার মাথার দিকে তাকাতেন। বোধহয় আন্দাজ করার চেষ্টা করতেন আমি চুল কাটাব নাকি দাড়ি শেভ করাবো। সেলুনে ঢুকেই একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম "সিদ্দিক ভাই কেমন আছেন"? উনি কুশলাদির ধারে কাছে না ঘেষে জিজ্ঞাসা করতেন, "ভাইজান কী চুল কাটাবেন"? যেদিন বলতাম "হ্যাঁ দেখেন না চুলগুলো বড় হয়ে গেছে"। সাথে সাথে ঘোর অমাবশ্যার আঁধার ওনার চোখে মুখে।

গম্ভীর গলা ওনার, ভাইজান এই চেয়ারটায় বসেন। আমাকে তিনি সবসময়ই সিলিং ফ্যান থেকে একটু দুরে কোণার চেয়ারটায় বসতে বলতেন। কোকের কাচের বোতলে পানি, বোতলের মুখে স্প্রে করে পানি দেয়ার জন্যে একটা নল লাগানো। বোতলের পানি দিয়ে আমার সারা মাথার চুল ভিজানোর কাজটা উনি অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে করতেন। এত পানি মাথার চুলে দিতেন যে আমার মাথা ভিজে পানি জুলফির চুল বেয়ে আমার দুই কাঁধ ভিজিয়ে দিতো।

"সিদ্দিক ভাই আমাকে কী গোসল করাচ্ছেন"?

"ভাইজান, আপনার চুলের যে কঠিন অবস্থা, পানি না দিলে তো কাটতে পারব না"!

সিদ্দিক ভাই পানি দিয়ে চুল পরিপূর্ণভাবে ভিজিয়ে পিতলের চিরুনি দিয়ে চুলগুলি চিরুনির দাঁতের ফাকে ধরে কাঁচি দিয়ে এক পোচ মারেন, মুহূর্তেই কাটা চুলগুলি ফ্যানের বাতাসে ফর ফর করে উড়ে ঘরের ভেতরে, সিদ্দিক ভায়ের গায়ে, চোখে মুখে আছড়ে পড়ে।

"দেখেন, পানি দেয়ার পরেও আপনার চুলগুলো কেমন বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে! এমন চুল আমি আমার জীবনে দেখিনি। এমন বেয়াড়া চুল ক্যামনে বানাইলেন ভাইজান"?

কমনওয়েলথের সিঙ্গেল স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে গিয়েছি পড়াশুনা করতে। আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও পরিবার নিয়ে গিয়েছিলাম যুক্তরাজ্যে। একা থাকতে পারি না, থাকা সম্ভব না। প্রতিটা পাউন্ড খরচ করতে হতো হিসেব করে। তখনকার সময়েই সবচেয়ে সস্তার সেলুনে চুল কাটাতে লাগত পাঁচ পাউন্ড। স্কলারশিপের অর্থের সিংহভাগই চলে যেত বাসা ভাড়া বাবদ। কাজেই পাঁচ পাউন্ড আমার কাছে বিশাল খরচের ব্যাপার।

আমার আশেপাশের অ্যাপার্টমেন্টে যে স্টুডেন্টরা পরিবার নিয়ে থাকত বেশির ভাগই পাকিস্তানি। এরা কেউই কখনও সেলুনে চুল কাটাত না। দেশ থেকে আসার সময়ই চুলকাটার যন্ত্রপাতি-সরঞ্জমাদি সাথে করে নিয়ে এসেছে। আমি সেলুনে চুল কাটাই শুনে এদের অনেকেরই মুখে একটা টিটকারী মিশ্রিত হাসির ঝিলিক বয়ে যায়। চুল বড় হয়েছে। বাসার ওনাকে বললাম, "সবাই তো বাসাতেই চুল কাটে। ওদের স্ত্রীরা কেটে দেয়। তুমি চেষ্টা করে দেখো না তুমি আমার চুল কেটে দিতে পারো কি-না! অনেকগুলো পাউন্ডও সেভ হবে"।

কথাটা বোধহয় ওনার মনে ধরল। কিংবা হয়তো তারুণ্য-তরুনিমার প্রণয়ের ভাবাবেগে স্বামীর প্রতি তখনও অগাধ মায়া-ভালোবাসা-বাধ্যগত-অনুগত। সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলেন।

উৎফুল্ল গলায় বললেন "কখন কাটবে"?

"কাটো, এখনই কাটো"- বলেই মনে হলো, কাটবে কী দিয়ে! জিজ্ঞাসা করলাম, "চুল যে কাটবে কাটার যন্ত্রপাতি কোথায পাবে"?

"যন্ত্রপাতি লাগবে না। আমার কাছে কাঁচি আছে, আর চুল আঁচড়ানোর জন্যে চিরুনিতো কয়েকটাই আছে। আর কী লাগবে"।

উত্তমকথা! কাটবে চুল, তার জন্যে কাঁচি আর চিরুনি ছাড়া কি-ই বা প্রয়োজন!

তারপরেও আমি আশ্বস্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, "কাঁচি দিয়ে যে কাটবে, সেই কাঁচি কোথায় পাবে"?

আশ্বাসে ভরা বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ও তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি বাংলাদেশ থেকে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি"।

আমার আশ্বস্ত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

বাঙালি অনেক নারীকে দেখেছি প্রবাসে স্বামীর কাছে সংসার করতে আসার সময় বদনা, শিল-পাটা, দা-বটি, পুরানো ন্যাকড়া, বাসন মাজার ছাই কতকিছু নিয়ে আসে, আমি মশারি আনতেও দেখেছি। আর উনি কাঁচি আনবেন, খুবই সামান্য ব্যাপার।

স্টূডেন্ট হাউজ, ঘরে দুটি মাত্র চেয়ার। তার একটি দেখিয়ে বললেন, "এই চেয়ারের বসো। আমি কাপড় আনি"।

আমি বসলাম। উনি বিশাল সাইজের ওড়না দিয়ে আমার গলা পেচিয়ে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিলেন। ওড়না গায়ে দিয়ে নিজেকে ওনার সমগোত্রীয় ভাবতে খারাপ লাগলো না। প্রবল উত্তেজনা ওনার চোখে মুখে। আর আমার ভিতর ভালোলাগার আবেশ!

"একদম সোজা হয়ে বসো। এতটুকু নড়বে না"। আমার প্রতি আদেশ।

আমার পিছনে একটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করছেন। বুঝতে পারছি। পিছনে এসে দাড়ালেন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি ডানহাতে বিশাল একটা কাপড় কাটা কাঁচি আর বাম হাতে লাল রঙের চুল আঁচড়ানো চিরুনি।

বেশ ভারী লোহার কাঁচি দিয়ে দরজিরা কাপড় কাটেন। কাপড় কাটার কাঁচিগুলো প্রথমে বেশ বড়সড় থাকে। ধার দিতে দিতে ছোট হয়ে আসে। একপর্যায়ে ব্যবহারের যোগ্যতা হারায়।

"এই তোমার কাঁচি, এটা দিয়ে চুল কাটবে"?

"অসুবিধা কী? আমি তো এটা দিয়ে কত মোটা মোটা কাপড় কাটি, সুতা কাটি"।

একদম খাঁটি কথা। সুতা, কাপড় কাটা গেলে চুল কাটা যাবে না কেন! চুল তো সুতার থেকেও চিকন।

মাথার পিছনে দাড়িয়ে বললেন, "মাথার পিছন থেকেই শুরু করি। বিসমিল্লাহ"!

চিরুনি দিয়ে চুল আটকিয়ে কাঁচি দিয়ে দিলেন পোচ। কাঁচি দিয়ে কিছু কাটলে কচ করে শব্দ হয়। আবার কোনো ভোতা কাঁচি দিয়ে যদি পুরানো ধ্যারধেরা ন্যাকড়া কাটার চেষ্টা করা হয়, একটা ভোতা শব্দ হয় অথবা কাঁচির দুই অংশ একসাথে বাড়ি খেয়ে ছোট একটা ধাতব শব্দ হয়। আমার মাথার চুলের ভিতর ভোতা আর ধাতব দুটো শব্দই হলো। পিছন থেকে উনি বলে উঠলেন, "ও আল্লা চুল তো কাটে না। চুল তো পিছলায়ে যাচ্ছে"!

শৈশবে দেখেছি, শিং মাছ, মাগুর মাছ কাটার সময় হাত থেকে পিছলিয়ে যায়, সেইজন্য ছাই দিয়ে ধরে। আমি বললাম, "এককাজ করো চুলগুলো ছাই দিয়ে ধরো"।

ভেবেছিলাম রসিকতাটুকু করে ওনার ভিতরে একটু রসের প্রলেপ দিই। উনি রস গ্রহণ না করে ঝংকার মেরে উঠলেন, "ফাইজলামি করবে না তো। সবসময় ফাইজলামি ভালো লাগে না। হবে না কেন? আমি এই চুল কাটবোই"।

আমি মিনমিনিয়ে বলি, "একবার না পারিলে দেখো শতবার"!

উনি শতবার না হলেও, বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেন, বহুবার চেষ্টা করলেন। একবার বাটি থেকে পানি নিয়ে হাতের ছিটায় মাথা হালকা ভিজালেন, আরেকবার সিঙ্কে নিয়ে মাথা পুরোটাই ভেজালেন। টাওয়েল দিয়ে মুছলেন। মাথায় গায়ে মাখা সাবান ঘষলেন। আবার মাথায় ট্যালকম পাউডারের কৌটা থেকে সারা মাথায় পাউডারও ছিটালেন। চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখলেন না।

সবশেষে মুখের সামনে ছোট একটা আয়না ধরলেন। ছোট আয়না, মাথার পুরোটা দেখা যায় না। আবার মুখের অবয়বও পুরোটা আসে না। ক্যামেরা প্যান করে যেমন বিভিন্ন জায়গা ফোকাসে আনা হয়, আমিও ছোট্ট আয়নাটা মাথার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নার ভিতর দিয়ে দেখছি।

উপকুলবর্তী অঞ্চলে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের রাতব্যাপী প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন থেমে যাওয়ার পর সকালে বাইরে বেরিয়ে ঠাওর করে উঠতেই সময় লাগে কোন দিক থেকে তাণ্ডবলীলার চিহ্ন দেখা শুরু করতে হবে। মাথার উপরিভাগ রোপা ধানের ক্ষেত, কোথাও একগাছি চুল, কোথাও মাথার তালুর আভাস। আবার যেখানে গোছাভরা চুল সেগুলোও কোনোটা লম্বা, কোনোটা বেটে বামন। এক পাশের জুলফি কানের অনেক উপরে উঠে গেছে, আরেক পাশেরটা কানের নিচে নেমে এসেছে, অনেকটা "সি-স" এর মতো, এক প্রান্ত উঁচুতে, অন্য প্রান্ত নিচু। আমি তাকিয়ে আছি আয়নার দিকে, আর উনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চোখদুটো ভরা অস্বস্তিবোধ, সংকোচ আর শঙ্কা। বড় বড় চোখ দুটো ছলোছলো!

চুলের কথা ভুলে বেচারিকে দেখে কষ্টে আর মায়ায় মনটা ভরে গেল। সে তো তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। আমি জানি তার কেমন খারাপ লাগছে।

আমি বলি "মন খারাপ করো না তো। ভোঁতা কাপড় কাটার লোহার কাঁচি দিয়ে অ্যামব্র্রোস পেরিও এর থেকে ভালো পারতো না"।

"অ্যামব্র্রোস পেরিটা কে"?

"বিশাল বিখ্যাত এক নাপিত। তিনি ফ্রান্সের দ্বিতীয় হেনরী, দ্বিতীয় চার্লস, নবম ফ্রান্সিস এদের সবার চুল কেটেছেন"।

"জ্ঞানের কথা রাখো। আমি পাঁচ পাউন্ড দিচ্ছি। সেলুন থেকে চুল ঠিক করে আনো"।

"তোমার কী মাথা খারাপ? এখন সেলুনে গেলে সরাসরি বলবে- "উই কান্ট ফিক্স ইট, সরি"। বাদ দাও। আমার খারাপ লাগছে না। সবাই ভাববে নতুন হেয়ার স্টাইল। চুলে যাই করো, সেটাই এখানে হেয়ার স্টাইল। তাছাড়া এক মাস পরেই তো বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছি। ঢাকা যেয়ে কাটাব।

ঢাকায় মগবাজারে একটা সেলুন ছিল। বেশ সাজানো গোছানো। এয়ারকন্ডিশন্ড সেলুন। সামনে টিন্টেড গ্লাস। ভিতরটা দেখা যায় না। সেলুনের তিন চারজন কর্মী, সবাই সাদা টি শার্ট পরা। এর আগে কয়েকবার চুল কেটেছি। বিলেত থেকে ফিরে পরের দিনই সেলুনটিতে গেছি। চুল কাটাতে।

দরজার কাছেই একটা কাছেই একটা ডেস্ক নিয়ে বসে থাকে একজন ম্যানেজার কাম ক্যাশিয়ার কাম সেলুনটির বস। তিনিই দেখিয়ে দেন কোন চেয়ারে বসতে হবে।

চেয়ারে বসলাম। যুবক বয়সী এক সেলুনকর্মী এগিয়ে এসে গায়ের উপর একটা ধবধবে সাদা কাপড় পেঁচিয়ে দিলো। হাতে চিরুনি আর কাঁচি এনে মাথার চুলে পোচ দিতে যেয়ে থমকে গেল!

"স্যার আপনার চুলের এ অবস্থা ক্যান? কোন সেলুনে চুল কাটছেন?"

"দেশের কোনো সেলুনে কাটাইনি। ইউকে ছিলাম সেখানে কাটিয়েছি"।

"স্যার লন্ডনে চুল কাটছেন"?

"হ্যাঁ, লন্ডনে ছিলাম, তখন চুল কাটিয়েছি"।

"ও আল্লা! স্যার ওই ইংলিশ ব্যাটারা আপনার চুলের এইভাবে – (ছাপার অযোগ্য) মারছে? শুনছি ওরা চুল কাটার উপর লেখাপড়া করে? এইটা কি সত্য?"

"হ্যা সত্যি কথা। ওদের কোর্স করতে হয়, ডিগ্রিও আছে"।

কি জানি কী মনে হলো। সে তার দোকানের অন্য সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে বলল, "এই দেখ স্যার লন্ডনে চুল কাটছে। লন্ডনের নাপিত চুল কাটার উপর লেহাপড়া করছে। দেখ ক্যামনে স্যারের চুলের … মারছে।"

দোকানে দুজন কাস্টমারও পাশে লম্বা বেঞ্চ, সেখানে বসে চুল কাটানোর অপেক্ষায় আছে। আমি আয়নার ভিতর দিয়ে দেখছি, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি অস্বস্তি কাটানোর জন্যে বললাম, "এই তুমি কী চুল কাটতে পারবে"?

"পারুম না ক্যান! তয় এক কাটাতে কিছুই হইব না। তিন চার কাটান দিলে হয়তো চুল জাতে আইবো"। বলেই সে চুলে কাঁচি আর চিরুনি স্পর্শ করল।

দীর্ঘ ছয়মাসব্যাপী লকডাউন চলছে এই মেলবোর্নে। সবকিছুই বন্ধ, এমনকি চুল কাটার সেলুনও খোলা নেই। বয়সের সাথে সাথে চুলের ঘনত্বেও কমতি ধরেছে। সেই ঘন চুল আর নেই। কিন্তু খাড়া ভাব ঠিকই আছে। কপাল প্রশস্ত হতে হতে মাথার চাদিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রশস্ত হওয়ার পথটি খুব মসৃণ, আর চকচকে। পথে রেখে গেছে স্বল্প কিছু নিদর্শন। আর অল্প কয়েকটা চুল প্রশস্ত জায়গা পেয়ে একেবারের তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে! অনেকটা হোমার সিম্পসনের সামনের চার-পাঁচটি চুলের মতো। আর দুই কানের দুই পাশের জুলফির কিছু চুল আমার বাগানের মটর শাকের মতো অবাধ্যভাবে বেড়ে উঠেছে! শুধু যে বেড়ে উঠেছে তাই নয়, এগুলোর থেকে আকর্ষীও গজিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নাম করা একটা সেমিনারে আমাকে অতিথি বক্তা হিসাবে একটা পেপার উপস্থাপন করতে হবে। এই করোনাকালে সবই এখন অনলাইন। সেমিনারটিতে আমন্ত্রিত বক্তা হিসাবে সুযোগ পাওয়া বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ সেমিনারটিতে ইউএস কংগ্রেস-এর প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিরা থাকেন, বিভিন্ন নাম করা কোম্পানীর নির্বাহী কর্মকর্তারা থাকেন, নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক গবেষকরা থাকেন। জীবনে অনেক সেমিনার কনফারেন্সে পেপার পড়েছি, কিন্তু এটার গুরুত্ব আর উত্তেজনা ছিল ব্যতিক্রমী।

ল্যাপটপের সামনে বসে বক্তৃতা দিতে হবে। একটা শার্টের ওপর জাম্পার পরে নেব, নিচে লুঙ্গি পরলেও সমস্যা নেই (যদিও আমি লুঙ্গী ব্যবহার করি না), নিচে তো আর কেউ দেখতে পাবে না। বাসার ওনাকে বললাম "কি পরে সেমিনারের সামনে বসবো"।

বললেন "কোট-টাই পরো"।

কোট-টাই স্যুট আমার পছন্দের পোশাক না। জীবনে হাতেগোনা কয়েকদিন কোট-টাই স্যুট পরতে হয়েছে, তাও ওনার পীড়াপীড়ি, রাগারাগি, কথা বলা বন্ধ করে দেয়ার হুমকিতে। ওনাকে বললাম "কোট-টাই পরব না"।

ঝামটা মেরে বললেন, "তোমার যা ইচ্ছে তাই পরো"! এই ঝামটা দেওয়ার উছিলায় হয়তো ঝামেলাও এড়িযে গেলেন!

অনেক সময় নিয়ে, যত্ন করে দাড়ি শেভ করলাম। সাধারণত দাড়ি শেভ করলে সব পুরুষের চেহারায় একটা সতেজ ভাব চলে আসে। ফ্রেশ লাগে দেখতে। এদিন শেভ করার পর মনে হলো চেহারা আরও চিমসে মেরে গেছে। কানের দুই পাশের জুলফির ওই আকর্ষীর আকৃতির এলোমেলো চুলগুলো চেহারার ফ্রেশভাবটাতে আলো-ছায়ার প্রভাব ফেলছে। অনেকটা ঢাকার হাইকোর্টের মাজারে লম্বা লম্বা অথবা জটাধারী চুলের ফকিরগুলো মাঝে মাঝে যখন ক্লিন সেভ করে গাজায় টান দিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকে অনেকটা সেই রকম। জুলফির চুলগুলোও ইচড়ে পাকার মতো অনেক আগেই পেকে গেছে। যেভাবেই হোক জুলফির চুলগুলো কেটে-ছেটে মানানসই সাইজে আনতে হবে। টেবিলের ড্রয়ারে ছোট একটা কাঁচি থাকে। বাথরুমের সিঙ্কের উপর বসানো আয়নার সামনে দাড়িয়ে অনেকক্ষণ পানি দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে একেবারে টান টান সোজা হওয়ার পর ছোট কাঁচি দিয়ে একপাশের জুলফির চুল বেশ অনেক খানি সমান করে কাটতেই দেখি মুখের একপাশের আলোছায়া সরে গিয়ে বেশ সজীব লাগছে।

অন্য পাশেরটা পরিমাণ মতো কেটে আয়নাতে দেখি আসলেই বেশ ফ্রেশ লাগছে। আয়নাতে নিজের চেহারা দেখছি, সেই সাথে নিজের ক্ষৌরকর্মে মুগ্ধ আমি। আবারও আয়নার ভিতর দিয়ে নিজের চেহারার দিকে ভালো করে তাকাতেই দেখি দুই পাশের জুলফির চুল কাটা সমান হয়নি। সেই "সি-স" এর মতো হয়ে আছে। এক পাশেরটা উঁচুতে, অন্যটা নিচে।

ডান পাশের জুলফি ঠিক কানের মাঝ বরাবর এসে থেমেছে। আর বামপাশেরটা মাঝ বরাবর থেকে অনেক উপরে শেষ হয়েছে। অসুবিধে নেই। কাপড় বেশি থাকলে বানানো গার্মেন্টস ফিট না হলে ঠিক করা সহজ। দুইটা জুলফিই এখনও বেশ বড়ই আছে। ডান পাশের জুলফিটা বড় হয়ে গেছে, কেটে ছোট করে আয়নাতে তাকিয়ে দেখি, এখন বাম পাশেরটা বড় দেখাচ্ছে, ডান পাশেরটা ছোট। ডান পাশেরটা কেটে ছোট করি বাম পাশেরটা বড় হয়ে যায়, বাম পাশেরটা কাটলে ডান পাশেরটা বড় হয়ে যায়।" চলন্ত সি-স"। দুই পাশের জুলফিই একই সমান্তরালে আনতে কখন যে দুইটাই দুই কানের উপর সীমানা পেরিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। খেয়াল হলো দেরিতে।

ফ্যামিলি রুমে টিভির সামনে ছোট কন্যা আর কন্যার মা বসে আছেন। কিছুক্ষণ আগে আমাকে ঝামটা দিয়েছেন। আমার পায়ের শব্দে মুখের গাম্ভীর্যের হেলমেট আরও ভালো করে বেধে নিয়েছে বোধহয়। তাদের কাছে গিয়ে দাড়াতেই কন্যা বলে উঠলো, "বাবা চুল এ কী করেছ? তোমাকে তো থ্রী স্টুজেজের মো এর মতো লাগছে"।

কন্যার মা গাম্ভীর্যের হেলমেট মূহূর্তেই খুলে ফেলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, "বেশি আঁতেল! যাও এখন থ্রী স্টুজেজ এর উপর শো করো!"

প্রাচীনকালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে শল্য চিকিৎসায় অনেক ক্ষৌরকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে ষষ্ঠদশ শতাব্দীর ফ্রান্সের অ্যামব্রোস পেরির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেক তথ্যেই তাকে আধুনিক শল্যবিদ্যার জনক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তিনি ছিলেন পেশায় একজন নাপিত। তার বিশেষ দক্ষতা ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষতের চিকিৎসা আর ব্যবস্থাপনায়। তিনি এতটাই প্রসিদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, যে তাকে ফ্রান্সের রাজা হেনরী-২ এর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তিনি বেশকিছু পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেন। তিনিই প্রথম হার্নিয়ার চিকিৎসায় টাইট আন্ডারগার্মেন্টস (Truss) ব্যবহারের কথা বলেন। তিনিই প্রথম Syphilis Ensurysm এর কথা উল্লেখ করেন।।

কোভিড-১৯ মানবজাতিকে অনেক কিছুই শিখিয়ে দিল, দেখিয়ে দিল। ইকোলজির ভাষায় সেই এককোষী প্রাণি থেকে মনুষ্যজাতি পর্যন্ত সমগ্র প্রাণিকুলকে দুইটি সম্প্রদায়ে (community) ভাগ করা হয়েছে। লঘু সম্প্রদায় (minor community) গুরু সম্প্রদায় (major community)। কি ভাবছেন, মানুষ গুরু সম্প্রদায়? না, মানুষ লঘু সম্প্রদায়ের একেবারেই তলানীতে। যে প্রাণি বেঁচে থাকার জন্যে, জীবন ধারণের জন্যে যত বেশি অন্যের উপর নির্ভরশীল সে প্রাণি সম্প্রদায় ততটাই লঘু সম্প্রদায়ের তলানীতে। মানুষ জীবন ধারণের জন্যে অন্য প্রাণি সম্প্রদায়ের ওপর, নিজ সম্প্রদায়ের ওপর ব্যপকভাবে নির্ভরশীল প্রাণি। তাই বেচে থাকার জন্যে, সুস্থভাবে জীবন যাপনের জন্যে এই অসহায় মানবকুল মানুষ, প্রত্যেকেই মোরা প্রত্যেকের তরে।

নরসুন্দরেরা, আপনারা পৃথিবীর যে যেখানেই আছেন, যেখানেই কাজ করেন, এই করোনাকালে আমরা আপনাদের সেবার অভাব মনে প্রাণে অনুভব করেছি। ভালো থাকেন আপনারা, নরসুন্দর সকলে!