ধর্ম প্রচার ও কতিপয় ‘আলেম-ওলামা’দের ভূমিকা

কবীর চৌধুরী তন্ময়
Published : 28 Oct 2020, 05:06 PM
Updated : 28 Oct 2020, 05:06 PM

ইসলাম প্রচারের নামে আমরা বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন হতে দেখি। আধুনিক এ সভ্যতায় পশ্চিমাদের ইন্টারনেট-প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখন রীতিমতো ঘরে বসেই সেই ওয়াজ-মাহফিলে আমাদের একশ্রেণির আলেম ওলামারা কী বলছেন, তারা কিভাবে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন-এটি দেখা ও শোনা যায়। সরাসির সম্প্রচার যেমন, ফেসবুক আর ইউটিউব লাইভের পরেও বিভিন্ন ফেসবুক, ফেসবুক পেজের সাথে সাথে ইউটিউব জুড়ে ওইসব আলেম ওলামাদের ওয়াজ-মাহফিলের বয়ানের ভিডিও পাওয়া যায়। অর্থাৎ আপনি সশরীরে উপস্থিত না হয়েও তাদের ওয়াজ মাহফিলের বয়ান শুনতে পাবেন এবং দেখারও সুযোগ আছে। আর এটি বাস্তবে বসে-দাঁড়িয়ে দেখা-শোনার চেয়েও ভিডিওচিত্রে অনেকটা কাছাকাছি ও স্পষ্ট মনে হবে।

উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা আছে। ভারত-বাংলাদেশে কবে থেকে ইসলাম প্রচার শুরু হয়েছে, কে শুরু করেছেন, কীভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়েছে–এটি নিয়ে বিস্তর লাইন ধরে ধরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না করলে মূলত অল্প কথায় বিস্তারিত বুঝানো কঠিন। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে, ৭ম শতাব্দীতে মালাবার সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে নব্য মুসলিম আরব বণিক এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ইসলামের আবির্ভাব হয়।

ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মানোর (খ্রিস্টিয় ৫৭০) মাত্র ৫০ বছর পর ৬২০ খ্রিস্টাব্দে লালমনিরহাট জেলার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় বলে ইদানিং বেশকিছু ইতিহাসবেত্তা তথ্য প্রমাণাদি উপস্থাপন করে জোরালো দাবি করছেন। এতে আরও দেখা যায়, ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে দেশের প্রথম মসজিদটিও নির্মিত হয় ওই জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের 'মজেদের আড়া' নামক গ্রামে যার নাম 'সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ'। আর 'রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ' এবং 'রংপুরে দ্বীনি দাওয়াত' গ্রন্থেও এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্যাদির সন্ধান রয়েছে।

অন্যদিকে ব্যতিক্রমধর্মী ঐতিহাসিক, কথাসাহিত্যিক ও রাজনৈতিককর্মী সত্যেন সেনের ১৯৬৮ সালে রচনা করা 'মসলার যুদ্ধ' গ্রন্থেও মুসলিম আরব বণিকদের কথা উল্লেখ করা আছে। এ গ্রন্থে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ-ভারতে সংঘটিত এক ভয়াবহ যুদ্ধের কাহিনী। এতে আরব বণিকদের এ দেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে ভূমিকাটিও উঠে এসেছে। যদিও সত্যেন সেন বাংলা-ভারতে ইসলাম প্রচার নিয়ে ইতিহাস লেখেননি, তিঁনি মধ্যযুগে মসলা বাণিজ্য নিয়ে ভারত-আরব ও ইউরোপের মধ্যে যে আন্দোলন-সংগ্রাম ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তার বিস্তারিত ইতিহাস থেকে তুলে ধরেছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি দরবেশ শায়খ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররদ যিনি ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ ইংরেজি সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন। অন্যদিকে বাংলার প্রথিতযশা সুফী সাধক এবং ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শাহ মখদুম রূপোশ। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ তথা রাজশাহী অঞ্চলে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করেছিলেন। আর তার অনুপম ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। মূলত শাহ মখদুমের মাধ্যমেই বরেন্দ্র এবং গৌড় অঞ্চলে ইসলামের শক্তিশালী বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বর্তমানে এসব অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল।

কিন্তু আজকের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ইসলাম প্রচার নিয়ে নানা কথা কিংবা আলোচনা-সমালোচনা দেখা যায়। দেশের সচেতন, শিক্ষিত জনগণের সাথে সাথে ইসলামিক চিন্তাবিদরাও এ নিয়ে মিডিয়াতে কথা বলেন, ইসলাম প্রচারের নামে কতিপয় আলেম-ওলামাদের কোরআন ও সহীহ হাদিসের ব্যাখ্যা 'বিকৃত' ও 'উচ্চারণগত ভুল'-এর বিষয়াদি নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। আর ওয়াজ-মাহফিলে কোন বক্তা কী বলেছেন, কিভাবে গানের সুরে-সুরে রীতিমতো নাচের ভঙ্গিমায় দর্শক-শ্রোতাদের 'ঠিক কিনা' বলে মাতিয়ে রেখেছেন বা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজের প্রতি আকর্ষণ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন–এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোডকৃত বা ভাইরালকৃত ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করলে অতি সহজেই বুঝা যায়।

এখানে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা শুধু 'ঠিক কিনা' বললে সবাই 'হ্যাঁ' বলে সম্মতি প্রদান করে। কিন্তু 'কী ঠিক' আর 'কী ঠিক নেই'–এটি বোঝার মতো ওই আয়োজনে কেউ আছে কিংবা থাকে কিনা, এটি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে!

তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, যারা ওয়াজ মাহফিলে যায়, তাদের নাগরিক সচেতনতা আর ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়টি কোন স্তরের? তাদের সামনে যেভাবে মনগড়া কথা আর গালভরা বুলি চিৎকার করে শোনানো হয়, তাদের প্রতিক্রিয়া কেন শুধু 'ঠিক কিনা'র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে? আবার যিনি বয়ান করেন, তিনিই বলে ওঠেন, 'নাউজুবিল্লাহ' আবার বলে উঠেন, 'সুবহান আল্লাহ' কিংবা 'আল্লাহু আকবর'! অর্থাৎ কখন আর কোন কথা শুনলে এসব কথা-শব্দগুলো বলতে কিংবা উচ্চারণ করতে হবে–এগুলো উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার বোধগম্য নয়!

যেমন, মুফতি ইব্রাহিম যখন করোনাভাইরাসের সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে ইসলামকে হাসিঠাট্টার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন, আবার এন্টারকোটিক নামের আস্ত একটা মহাদেশ আবিষ্কার করার দাবি করেন, তখন একজনও তার সমালোচনা করে বলেন না যে, ধর্মকে জড়িয়ে এই ধরনের তথ্য-সূত্রহীন বক্তব্য বা এই লোকের এসব আজগুবি কথাবার্তার কারণে ইসলামের ক্ষতি হচ্ছে, মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন!

অন্যদিকে মিজানুর রহমান আহাজারীও যখন বলেন, 'পচিশ বছরের বিশ্ব নবী বিয়ে করলেন চল্লিশ বছরের এক 'বুড়ি মহিলা'কে, বিয়ে করেছেন সাইদেনা সাইদেতুনা খাদিজাকে, ওনার বয়স ছিল চল্লিশ, 'আগে দুইবার তালাক খাইছে', অনেকগুলো বাচ্চা জন্ম দিয়ে প্রৌঢ়া একটা নারী ছিল, এই মহিলাকে বিয়ে করলেন বিশ্ব নবী মুহাম্মদ, তাগড়া যুবক, তাও এমন যদি হতো এই 'মহিলার বিয়ে হয়নি', 'ইনটেক্ট' মহিলা–তাও তো না, ভার্জিন না, উইডো, বিধাব, হারবালা'– এসব অপশব্দ প্রয়োগ করে তখনও তেমন প্রতিবাদ দেখা যায় না।

আবার আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ যখন বলেন, 'নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র তার স্বামীকে শান্তি, তৃপ্তি দেয়ার জন্য। নারীর চুল দেখলে পাপ হয়, মুখ দেখলে, হাত ও পা দেখলে পাপ হয়, পুরা শরীরটাই পাপের বস্তু….' অদ্ভুত হলেও সত্য, তখনও তার এসব জঘন্য কথার প্রতিবাদ করতে কাউকে দেখা যায় না। ওয়াজ মাহফিলের নামে যা-তা বলে যাচ্ছে, না এখানে পবিত্র কোরআনের রেফারেন্স দিচ্ছে, না সহীহ হাদিসের তথ্যসূত্র তুলে ধরছে। বরং গানের সুরেসুরে আর নাচের দেহভঙ্গিমায় নারীর প্রতি এসব বিষোদগার করা হচ্ছে! ইসলাম ধর্ম যেখানে নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় স্থান দিয়েছে, সম্মানের জায়গা দিয়েছে, সেই ইসলামের বাণী শোনাতে এসে তারা কিভাবে নারীকে ভোগ্যপণ্য কিংবা দাসী হিসেবে উপস্থাপন করছে–এটি আমাদের বিবেচনা করতে হবে।

অথচ নারী-পুরুষের সম্পর্ক সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, 'মুমিন নরনারী একে অন্যের বন্ধু, এরা সৎ কাজের নির্দেশ দেয়, অসৎ কাজে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য করে।' সুরা তওবা, আয়াত: ৭১।

আবার নারী-পুরুষের অধিকার নিয়ে আল্লাহ বলেছেন, 'পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য।' সুরা, নিসা, আয়াত: ৩২।

মানবজাতির যে সম্মান ও মর্যাদার ঘোষণা ইসলামে দেওয়া হয়েছে সে সম্মান ও মর্যাদা লাভের ব্যাপারে নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ করা হয়নি।

আবার, ধর্ষণ নিয়ে নারীকে যেভাবে দোষারোপ করা হয়, নারীর ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়–এটিও ঘোরতর অন্যায় যেমন, যদি ধর্ষণ করা হয় তাহলে যার ওপর জোর করা হবে, তার (ধর্ষিতার) ওপর কোনো শাস্তি আসবে না, শাস্তি আসবে শুধু জোরকারীর (ধর্ষক) ওপর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে এক নারীর সঙ্গে জোরপূর্বক জিনা (ধর্ষণ) করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই মহিলার ওপর হদ (যেসব শাস্তির পরিমাণ ও পদ্ধতিও কোরআন-হাদিসে সুনির্ধারিত) তথা জিনার শাস্তি প্রয়োগ করেননি। যে জোরপূর্বক জিনা করেছে তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করেছেন [তিরমিজী]। অন্য বর্ণনায় আছে, 'সরকারি মালিকানাধীন এক গোলাম গনিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসীর সঙ্গে জোর করে ব্যভিচার (ধর্ষণ) করে। এতে তার কুমারিত্ব নষ্ট হয়। হজরত ওমর (রা.) ওই গোলামকে কশাঘাত করেন এবং নির্বাসন দেন। কিন্তু দাসীটিকে সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে কশাঘাত করেননি' [বুখারী]।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশ এবং ভারত উপমহাদেশে যেসব ওলী-আউলিয়ারা ইসলাম প্রচারে নিরলস ভূমিকা রেখেছেন, বর্তমানে পশ্চিমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলা, ইংরেজি, আরবি-ফারসি ভাষা মিশিয়ে 'জগাখিচুরি ভাষা' সৃষ্টি করে কিছু ওয়াজকারী মূলত তাদের পূর্বসূরীদের বিতর্কিত করছেন, ইসলাম প্রচারের নামে ইসলামের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।

এ নিয়ে ইসলামিক চিন্তাবিদ বা গবেষকদের সাথে আলোচনা করলে তারা জানান, বর্তমানে সমাজ থেকে একদিকে যেমন জ্ঞানী ও নির্ভীক আলেমরা আমাদের মাঝে থেকে চলে যাচ্ছেন এবং অপেক্ষাকৃত অল্প জ্ঞানীগণ কোরআনের 'ইলম' বা 'জ্ঞান' প্রচার করছেন, অন্যদিকে আমরা আজ যত ক্বারিকে দেখতে পাই তত প্রকৃত আলেমকে দেখছি না। দেখবেন, ক্বারীগণ (যারা কোরআন তিলাওয়াত করেন) যত জনপ্রিয় ফকিহগণ (ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ) কিন্তু ততটা নন। অধিকাংশ ক্বারীরা কোরআন পড়বে কিন্তু তা অনুধাবন করতে পারবে না, বাংলায় অর্থসহ ব্যাখ্যা দিতে পারবে না, পারে না।

আর তাদের কথাগুলোর যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় হাদিসের দিকে তাকালে, হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'আখেরী যামানায় অনেক ইবাদাতকারী হবে মূর্খ। আর অনেক ক্বারীরা হবে ফাসিক (অর্থাৎ কবীরা গোনাহে লিপ্ত)।' [কানযুল উম্মাল]

এমনি ভাবে হাদিসের মাধ্যমে জানা যায়, এমন কিছু ক্বারীর আবির্ভাব হবে যারা মানুষের মাঝে বিভিন্ন মজলিসে দুনিয়া কামানোর জন্য অর্থাৎ অর্থ ও টাকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে সুমধুর কন্ঠে কোরআন তিলাওয়াত করবে। [আবু দাউদ]

আবার আবূ যার (রাঃ) বলেছেন, 'আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটে একদিন উপস্থিত ছিলাম এবং আমি তাকে বলতে শুনেছি, 'এমন কিছু রয়েছে যেটির ব্যাপারে আমি আমার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের অপেক্ষাও অধিক ভয় করি।' তখন আমি ভীত হয়ে পড়লাম, তাই আমি বললাম, 'হে আল্লাহ্'র রসূল! এটি কোন জিনিস, যার ব্যাপারে আপনি আপনার উম্মাহ্-এর জন্য দাজ্জালের চাইতেও অধিক ভয় করেন?' তিনি [রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন, 'পথভ্রষ্ট 'আলিমগণ।' -মুসনাদ আহ্মাদ, হাদিস নং- ২০৩৩৫

দুঃখজনক হলো, সমাজ সভ্যতায় ভালো আলেমগণকে ইসলামের পাহারাদার হিসেবে উল্লেখ করলেও দুর্ভাগ্য, বর্তমানে কিছু লোক মাদ্রাসায় সাজেশান পড়ে আলেম সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছে ঠিক, কিন্তু তারা পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণ পড়েন না, প্রকৃত অর্থ জানেন না বিধায় আমাদের সমাজে পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত আলেমের সংখ্যা বেড়ে গেছে, দিনদিন বেড়েই চলেছে। তাদের অজ্ঞতায় সৃজিত জাল-যঈফ (বানোয়াট-দুর্বল) হাদিসের জন্য সাধারণ মুসলিম শির্ক ও বিদআত (পৌত্তলিকতা বা বহুঈশ্বরবাদ চর্চা-নতুনত্ব বা নবতর উদ্ভাবন) কী এটি চিনতে-বুঝতে পারছেন না বরং বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। আর এরাই বর্তমানে বলে বেড়ায় 'ধর্ম বুঝা কঠিন, মাদ্রাসায় না পড়লে কোন ভাবেই ধর্ম জানা যায় না, তারচে তারা যা বলে তা অন্ধভাবে অনুসরণ করতে'!

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, 'হে মুমিনগণ! কোনো পাপাচারী যদি তোমাদের কাছে বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা সে বার্তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে যাতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে না হয়।' সুরা হুজুরাত, আয়াত: ৬। আবার এ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, 'কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (সত্যতা যাচাই না করে) তাই বর্ণনা করে' [মুসলিম]।

আমাদের মনে রাখা উচিত, সহজ ও দলিলভিত্তিক ধর্ম 'ইসলাম ধর্ম'। আর ইসলাম প্রচার করতে হলে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর বিষয়াদির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করতে হবে, রেফারেন্সসহ তুলে ধরতে হবে। কোন পীর, ঈমাম কিংবা তথাকথিত আলেমের স্বপ্ন, ইচ্ছা, গণতন্ত্র, ভাল লাগা, আর না লাগার ওপর শান্তির ধর্ম ইসলাম নির্ভর করে না বরং বিবেদ সৃষ্টি করে। আর এ নিয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ পাক বলেন, তিনি ও রাসূল (সা.) ব্যতীত কাউকে অন্ধ অনুসরণ না করতে। (সুরা নাহল:১৬/৪৩, সুরা আ'রাফ:৭/৩, সুরা আহযাব: ৩৩/৬৭)

অর্থাৎ, আমাদের জনে জনে সচেতন হতে হবে। আধুনিক সভ্যতায় একশ্রেণির আলেম কী বলল, কী পরামর্শ তুলে ধরল–এটি বিশ্বাস করার আগে প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেই যাচাই-বাচাই করতে হবে। বাংলা অর্থসহ পবিত্র কোরআন পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে। সহীহ হাদিসগুলো জানতে হবে। যেকোনো আলেম গানের সুরেসুরে আর নাচের দেহভঙ্গিমায় বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে, কারণ ওপরের লাইনেই হাদিসের কথা উল্লেখ করেছি যে, 'একদল পথভ্রষ্ট আলেমদের নবী (সা.) দাজ্জালের চাইতেও অধিক ভয় করেন!' কতিপয় আলেম-ওলামার নামে একদল দাজ্জালের বিভ্রান্তের হাত থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে হলে নিজেকে সর্বপরি সচেতন করতে হবে এবং বিতর্কিত ওইসব আয়োজনকে বয়কট করতে হবে।

যেমন আমাদের মনে থাকার কথা, যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ-এর রায় ঘোষণা করেন, তখন একশ্রেণির দাজ্জাল ইসলামকে ব্যবহার করে ছবি এডিট করে 'সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে' বলে গুজব-মিথ্যাচার ছড়িয়ে দেশের সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে বিভ্রান্ত করেছে, ষড়যন্ত্র করে মানুষকে হত্যা করেছে, অগ্নিসংযোগ করে পুরো দেশকে মৃত্যুকূপে পরিণত করেছিল!

আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর-এর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।' সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৬।

আমি মনে করি, কতিপয় দাজ্জালের পরামর্শ, গুজব আর মিথ্যাচার বিশ্বাস করার আগে আপনার হাতের মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রতিটি বিষয়ের ওপর গুগলে সার্চ দিয়েও আপনি পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদিসের বাণীগুলো জেনে নিতে পারেন। ইসলামের অজস্র কনটেন্ট ইন্টারনেটজুড়ে ছড়িয়ে আছে, যেখান থেকে তাৎক্ষণিকভাবেও আপনি সঠিক তথ্য জেনে নিতে পারেন। ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক নানান গ্রন্থ-বই আছে, এগুলো থেকেও বিস্তারিত জানার আগ্রহ তৈরি করতে হবে।

মনুষ্যস্বভাবে গুণাহ'র স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে– কারোও কম, কারোও বা বেশি। কিন্তু অনেকে গুণাহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য খুব দ্রুত বা শর্টকাট পথ ও পদ্ধতি খোঁজার চেষ্টায় থাকে। আর তখনই তারা ভুল করেন এবং পথভ্রষ্ট আলেমদের দ্বারা ধোঁকাবাজীর শিকার হয়ে পড়েন।

অথচ, তাওবাহ হলো শুধুমাত্র 'বান্দা' এবং 'আল্লাহ'র মধ্যকার বিষয়।

এখানে 'তওবা'র মাঝখানে কিছুই থাকে না। মনে রাখতে হবে, পথভ্রষ্ট মানুষগুলো নিজেদের বিতর্কিত করার পাশাপাশি অন্যদেরও পথভ্রষ্ট-বিতর্কিত করে থাকে। কারণ, সাধারণ মুসলিম'রা যেহেতু কোরআন ও হাদিস পড়ে না, প্রকৃত অর্থ জানে না, তাই পথভ্রষ্টরা সহজেই কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা বিকৃত করে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করার সুযোগ পেয়ে থাকে। আর তাই, আপনার শিক্ষা-দীক্ষা আর তথ্য-উপাত্ত আপনাকে আলোর পথ দেখাবে, আপনার আলোয় আলোকিত হবে আপনার সন্তানসহ সমাজ-রাষ্ট্র। তাই আপনাকেই সবার আগে ধর্মীয়ভাবে জ্ঞান অর্জনসহ সচেতন হতে হবে।