জানিনা কোথায় গেলে মিলবে এসবের উত্তর

শারমিন জান্নাত ভুট্টো
Published : 22 Oct 2020, 04:51 PM
Updated : 22 Oct 2020, 04:51 PM

কয়েকদিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিভাগে 'প্রবাসীর চিঠি: বিনিয়োগ নাকি নিরাপত্তা' শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ হয়েছিল। যেখানে আমি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবাসীর সংবাদ সম্মেলনের কথা উল্লেখ করি।

খবরটি ছিল এরকম:

"আব্দুল হক নামে এক প্রবাসী দীর্ঘ ৪০ বছর সৌদিতে থাকার পর সারা জীবনের সঞ্চয় নিয়ে পরিবার-পরিজনের জন্য দেশে ফেরেন। শান্তিতে মাথা গোঁজার জন্য সঞয়ের টাকা বিনিয়োগ করে একটি আবাসিক এলাকায়, কেনেন ৫ কাঠার প্লট। সেখানে সাত তলা ভবন নির্মাণের জন্য 'সারা হাউজিং' নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সাথে ২০১১ সালে চুক্তিবদ্ধ হন।‍ চুক্তি অনুযায়ী ৩০ মাসের মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করে আব্দুল হককে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও 'সারা হাউজিং ও তার স্বত্বাধিকারী মুজিবুর রহমান' ৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তা হস্তান্তর করেননি। পরে নিরুপায় হয়ে আব্দুল হক আদালতের শরণাপন্ন হলে ওই ডেভেলপার কোম্পানি ও তাদের ভাড়া করা বাহিনী হামলা চালায় তার পরিবারের ওপর।"

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে মতামত বিভাগে ওই লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর প্রশাসনের একটি সাময়িক তৎপরতা চলে। অভিযুক্ত হাউজিং কোম্পানির পক্ষ থেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে মৌখিকভাবে কিছু আশ্বাসও দেওয়া হয়। তবু অভিযুক্ত সারা হাউজিং তাদের অপতৎপরতা থামায়নি। বরং তারা এখন ওই প্রবাসীকে বলছে, " আপনার ফ্ল্যাট আপনি করে নেন।"

প্রবাসী ভদ্রলোক পড়ে গেছেন বিপাকে। কেননা, তার তিন মেয়ে। এই তিন মেয়েকে ক্রমাগত এখন ওই হাউজিং কোম্পানির ভাড়াটে মাস্তানরা বিরক্ত করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে তারই এক মেয়ে।

আমার লেখার প্রেক্ষিতে ওই প্রবাসীর মেয়ে সামিয়া হক একটি চিঠি লিখে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দেশব্যাপি ধর্ষণ ও নারী নিপীড়ণবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেও ওই ডেভেলপার কোম্পানি যে, তাকে এবং তার তিন বোনকে 'টার্গেট' করে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হুমকি-ধামকি সেটি সামিয়া বলেছেন। আমাকে অনুরোধ করেছেন- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তার চিঠিটি পৌঁছে দিতে। আমি তার সেই চিঠিটি তুলে দিলাম-

প্রিয় পাঠক,

অনেক আশা-ভরসা নিয়ে বাবা দেশে নিয়ে এসেছেন আমাদের। যাতে করে দেশের সংস্কৃতিকে মনে ধারণ করে আমরা বেড়ে উঠি। কাজ করি মানুষের হয়ে দেশের জন্যে। শৈশব পুরোটা সৌদিতে কাটানোর কারণে ভাষাগত একটা সমস্যায় পরতে হয় দেশে এসে। তবে জানা ছিল না এর থেকেও কোন বড় বিপদ অপেক্ষা করছিল আমাদের। আমার বাবা তার সারাজীবনের সঞ্চয় নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন আমাদের নিয়ে বাকিটা সময় শান্তিতে কাটাবেন বলে। আর সে কারণেই আমাদের জন্য  প্রথমেই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে চাইলেন। অনেকদিন এদিক-ওদিক ভাড়া বাসায় থাকার পর নিজেদের আপন নীড় গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম আমরা। দীর্ঘ ৪৫ বছর বাবা বিদেশে থেকে সঞ্চয় করেছিলেন তা দিয়েই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছোট্ট একটি প্লট কিনলেন,স্বপ্ন নিজেদের একটি বাড়ি করার যাতে নিরাপদ ও নিশ্চিন্তে আমরা কাটিয়ে দিতে পারি সবাই মিলে।

ভরসা দেখিয়ে প্রাইভেট ডেভেলপার কোম্পানি সারা হাউজিং ও এর স্বতাধিকারী মুজিবুর রহমানের এর সাথে চুক্তি করা হলো। ২০১১ সালের চুক্তিনামা অনুযায়ী সারা হাউজিং ৩০ মাসের মধ্যে সাততলা ভবনের তিনটি ফ্লোর আমাদের বুঝিয়ে দেয়ার কথা। দিন গড়িয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর পার হতে লাগলো তবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত আর স্বপ্নের বাড়িটি বুঝিয়ে দেয়া হলো না আমাদের। তাই নিজেরাই কোনমতে একটি ফ্লোরে থাকার ব্যবস্থা করি আমরা। আর অন্যদিকে তারা আমাদের হক থেকে বঞ্চিত রেখে ঠিকই নিজেদের জন্য তৈরি করে নিলো তাদের ভাগের অংশটুকু আর সেখানে নিজেদের লোকদের ঢুকিয়ে দেয়া হলো যাতে আমাদের ওপর শকুনের মতো তীক্ষ্ণ নজর রাখতে পারে। অনেকটা বাধ্য হয়ে যখন আইনের শরণাপন্ন হলাম তৎক্ষণাৎই আমাদের ওপর আছড়ে পড়লো একের পর এক প্রলংয়কারী তাণ্ডব। প্রথমে আমাদের পরিবারের ওপর হামলা করলো সেই ডেভেলপার কোম্পানির ভাড়া করা গুণ্ডাবাহিনী। শুধু মারধর করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ আর বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিতে থাকে।

জীবনে এই প্রথমবারের মতো নিজেদের প্রচণ্ড রকম অসহায় আর বিপন্ন মনে হতে লাগলো। কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি, নিজ দেশে এসে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তার থেকেও বড় বিষয়, নিজ বাড়িতে থেকেও এতোটা অনিরাপত্তায় অমানসিক অশান্তিতে ভুগতে হবে এটা জানলে কখনো হয়তো দেশেই ফিরতাম না। আমরা তিনবোন ঠিকমতো ছাদে সময় কাটাতে পারি না কিংবা বারান্দায় দাঁড়াতে পারি না। নানাভাবে ইভটিজিং এর শিকার হতে হয় আমাদের। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করে যাতে আমরা চলে যাই এই বাসা ছেড়ে।

বহুবার প্রতিবাদও করেছি আমরা। কিন্তু তার প্রভাব এসে পড়েছে আমার বাবা-মার ওপর। একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে তাদের। হুমকি, মিথ্যা মামলা, মারধর; আমাদের আসলে আর কী দেখার বাকি আছে। ভেবেছিলাম থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হলে হয়তো অপরপক্ষ কিছুটা হলেও ভীত হয়ে তাদের দিক-গতি পাল্টাবে। তবে হয়েছে তার উল্টো। তারা নিজেদের ভাই বানিয়ে নিয়েছে থানা-পুলিশকে। কোথায় পুলিশ এসে সন্ত্রাসীবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে তা না তারা এসে আমাদের বারবার বোঝাতে লাগলো- যাতে বেশি ঝামেলা না করে মিটিয়ে ফেলি সবকিছু। 'ঘরে তিন কন্যা রেখে শত্রুর মুখোমুখি হতে হয় না' বলেও আমার বাবাকে উপদেশ দিতে থাকলো তারা। আমাদের জানা ছিলো না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে আজকাল সমঝোতাকারীর কাজও করে থাকে। মাঝে-মধ্যে মনে হতে লাগলো তবে কি নারী হওয়ার কারণে আমাদের এতো সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

দেশের প্র্রধানব্যক্তিটি নারী অথচ তারপরও আমরা নারীরা কতটা অবহেলা আর অনিরাপত্তায় দিন কাটাচ্ছি প্রতিনিয়ত তা ভাবতেই অবাক লাগে! কী ভয়ংকর অস্থিরতায় যে প্রতিটি ক্ষণ কাটাচ্ছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। নিজ ঘরে থেকেও আমাদের নিরাপত্তা নেই। প্রবাসের সুখ-আরাম, বিলাসিতাকে দূরে ঠেলে দেশে আসলাম এক মুঠো শান্তির আশায়, অথচ অশান্তি আর শনির দশা লেগেই আছে আমাদের পিছে। আমাদের জানা নেই, কোথায় একটু আশার আলো পাবো, কে আমাদের নিরাপত্তা দেবে, কিভাবে পাবো একটু বেঁচে থাকার স্বাদ? তবে কি ভুল ছিল দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত? নাকি নারী হওয়ার কারণে বঞ্চিত হচ্ছি অধিকার থেকে? জানি না কোথায় গেলে মিলবে এসবের উত্তর…।'

মেয়েটির চিঠি পড়ে তার অসহায়ত্ব আমি বুঝতে পারছি। দেশে থাকতে এরকম পরিস্থিতির যে মুখোমুখি হইনি তা নয়। লক্ষ্য করে দেখেছি যতো ধরনের বিপদই আসুক না কেন- শেষ পর্যন্ত সেটি নারী নিপীড়ণের উপর দিয়ে যায়। আর আমাদের পুলিশবাহিনীও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে একদমই বের হয়ে আসতে পারেনি।

সামিয়ার চিঠির শেষ লাইনের মতো আমারও বলতে হচ্ছে- 'জানিনা কোথায় গেলে মিলবে এসবের উত্তর…।'