ভারতকে পেছনে ফেলার কৃতিত্ব শেখ হাসিনা পাবেন

মর্তুজা হাসান সৈকতমর্তুজা হাসান সৈকত
Published : 22 Oct 2020, 08:19 AM
Updated : 22 Oct 2020, 08:19 AM

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ) তাদের 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক' প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ বছর মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনের দিক থেকে ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ ভারতকে ছাপিয়ে যাবে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ৩.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৮৮৮ ডলারে উন্নীত হতে পারে, এই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ১৮৭৭ ডলার। তারা আরও বলছে, এ বছর সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে শুধু গায়ানা ও দক্ষিণ সুদান।

যে ভবিষ্যদ্বাণী আইএমএফ করেছে, সেটা যে ভারতের জন্য সুখকর হবে না, তা অনুমেয় ছিল। হয়েছেও তাই। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডির মতো যে সমস্ত রাজনীতিকরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে কিছুদিন আগেও বাজে মন্তব্য করেছিলেন, কটুকথা বলেছিলেন; তাদের মুখে চপেটাঘাত হয়ে এসেছে এ প্রতিবেদন। বিরোধী নেতারা এ প্রতিবেদনকে সামনে এনে সরকারের তুমুল সমালোচনা করছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, 'গত ৬ বছরে বিজেপির বিদ্বেষমূলক জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির দুর্দান্ত সাফল্য হলো- বাংলাদেশ ভারতকে ছাপিয়ে যেতে চলেছে'।

অন্যদিকে ভারতের মতো একটা বিশাল অর্থনীতির দেশকে অর্থনৈতিক সূচকে টপকে যাওয়া বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হিসেবেই গণ্য হচ্ছে দেশ বিদেশে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু বাংলাদেশের এ উত্থানের প্রশংসা করে বলেছেন, 'এমার্জিং ইকোনমির যে কোনো দেশের এগিয়ে যাওয়া ভালো সংবাদ। বাংলাদেশ ২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে এগিয়ে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ৫ বছর আগে জিডিপিতে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল'।

যদিও আইএমএফ জানিয়েছে, আগামী বছর মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশকরোনা ভারতকে সাময়িকভাবে পেছনে ফেললেও সেটা স্থায়ী হবে না। ভারতকে চূড়ান্তভাবে পেছনে ফেলতে তাদের আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলে অনেকখানি সামনে এগিয়ে যাবে। তখন তাদের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ২৭৫৬ ডলার আর ভারতের ২৭২৯ ডলার।

মোট জিডিপির দিক থেকে বর্তমানে ভারত বর্তমানে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের একটি। মাত্র এক যুগ আগেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের অর্ধেক ছিল, এমন একটি দেশকে এত অল্প সময়ের ভেতরে পেছনে ফেলে দেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, তাই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিষয়টি অনেক বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে সত্যি কথা বলতে গেলে, হাঙ্গার ইনডেক্স, নারীর ক্ষমতায়ন, টিকাদান, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যু রোধ ইত্যাদি সূচকে বাংলাদেশ অনেক আগেই ভারতকে পেছনে ফেলেছিল। ভারত কেবল মাথাপিছু জিডিপি এবং মানব উন্নয়ন সূচক – এ দুটি ক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিল এতদিন।

গত ১৭ অক্টোবর দ্য ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষি খাতকে পেছনে ফেলে দেশটি এখন অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর। এই খাতেই তারা এখন লাখ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করছে যার ফলে দেশটি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ভারত শিল্প খাতকে চাঙা করতে হিমশিম খাচ্ছে আর মানুষ এখনো অনেক বেশি কৃষি খাতনির্ভর। এর বাইরে আরও কিছু সামাজিক সূচকও বাংলাদেশকে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে।

গত এক যুগে শেখ হাসিনার শাসনামল বাংলাদেশের এ বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উত্থানে মূল ভূমিকা পালন করছে। এই সময়কালে দেশের অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে গেছে, তিনগুণেরও বেশি বড় হয়েছে জিডিপি। নির্মাণ হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামো। অন্যদিকে, গত তিন-চার বছর ধরেই ভারতের অর্থনীতি ধুঁকছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে এসেছে, আর বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে প্রত্যাশার চাইতেও অধিক গতিতে। তদুপরি, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় চীনা বিনিয়োগকারীদের অনেকেই ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটাও ভারতকে পিছিয়ে দিয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপ। এসব ব্যাপার ভূমিকা রেখেছে ভারতের অবনমন আর বাংলাদেশের ঊর্ধ্বগমনে।

বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদরা আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, করোনা মহামারী পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটবে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক দ্রুত। হচ্ছেও তাই। অর্থনীতিকে এমন সচল ও চাঙ্গা রাখার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ভূমিকা পালন করেছে। জরুরি পরিস্থিতিতে বড় মাপের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দ্বার উন্মুক্ত করার মতো সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে তিনি বাজিমাত করেছেন। এর ফলে মহামারীকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত হয়েছে।

সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন নতুন রেকর্ড অর্জন করেছে বাংলাদেশ। রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার। ম্যানিলাভিত্তিক দাতা সংস্থা এডিবি জানিয়েছে, শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের সাফল্যে ভর করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। একই সঙ্গে কাটছে করোনাভাইরাস মহামারী সঙ্কট। ফলে আশা করা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে ৬.৮ শতাংশ। যদিও সরকার জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এমন সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করে ভারতের সংবাদপত্র দ্যা ইকোনমিক টাইমস বলেছে, করোনাকালে ভারতের সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ যখন ধীরে এগোচ্ছিল, সেই সময়ে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে।

আইএমএফ-এর এবারের প্রতিবেদন আরও একটি কারণে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেই এবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদী বন্যা আঘাত হেনেছে। এরপরও কৃষি খাত এখনো বিপর্যস্ত হয়নি, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে সেখানেও ব্যবস্থাপনা ভালো। মানে কেবল করোনাভাইরাস নয়, দীর্ঘমেয়াদী বন্যার ধাক্কাও সহ্য করে তবেই অর্থনীতিতে এ সাফল্য এসেছে। এর ফলে, সারাবিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি পরিষ্কার বার্তা দেওয়া গেছে যে, শত প্রতিকূলতাতেও এই দেশ এগিয়ে যাবে। সম্প্রতি বিভিন্ন দাতা সংস্থা দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে যেসব পূর্বাভাস দিচ্ছে, তাতে একটা বার্তা পরিষ্কার যে, দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় আছে।

শেষ করব বাংলাদেশ সম্পর্কে হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন এইচএসবিসি'র সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে প্রকাশিত একটি তথ্য দিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ যেখানে বাংলাদেশের পেছনে থাকবে। মূলত শেখ হাসিনার দক্ষ এবং যোগ্য নেতৃত্বের কারণে এক সময়ের কথিত 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আজ বিশ্ব দরবারে উদীয়মান অর্থনীতির রোল মডেল। মাত্র এক যুগ আগেও যে দেশের জিডিপি প্রায় দ্বিগুণ ছিল, তারাও পেছনে পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের কারণে। এ কৃতিত্ব শেখ হাসিনা অবশ্যই পাবেন। কৃতিত্ব তাকে দিতে হবেই।