বিশ্বায়ন ব্যর্থ, তাহলে পথ কোনটা?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 20 Oct 2020, 07:22 AM
Updated : 20 Oct 2020, 07:22 AM

অর্থনীতির পণ্ডিতরা আগে থেকেই বলছিলেন। এবার ক্যাথলিক বিশ্বের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের মুখেও শোনা গেল একই কথা। সাম্প্রতিক এক বাণীতে পোপ অভিবাসন, বর্ণবাদের পাশাপাশি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থিক অসাম্যের প্রসঙ্গটিরও অবতারণা করেছেন। পোপ বলেছেন, মহামারীর মতো সঙ্কটকালে বাজার অর্থনীতি অভ্রান্ত দাওয়াই না-ও হতে পারে। এই সময় ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকারও দাওয়াই নয়। বরং কোন উপায়ে কিছু মানুষের কুক্ষিগত সম্পদকে সমষ্টির কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নে কাজে লাগানো যায়, তাই বিচার্য হওয়া উচিত।

কিছুদিন আগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোও বলেছিলেন, মহামারী ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ও উন্নয়নের মডেলের ভুলগুলি দেখিয়ে দিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে মহামারীর মতো সঙ্কটকালে জীবিকা আয় ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা কোনও বিলাসিতা নয়, বরং তা জরুরি ও প্রয়োজনীয়।

নানা জনের কথায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত বিশ্বে একটা কথা পরিষ্কার: মুক্ত বাজার অর্থনীতি সকল মানুষের কল্যাণ করতে পারে না। এতদিনের বাজার অর্থনীতির পক্ষে গাওয়া বিশ্বায়নের গান শুধুই সামান্য কিছু মানুষের উন্নতি করার পথ দেখিয়েছে। কিন্তু এবার পুঁজি নিজেকে বাঁচাতে ঘুরে দাঁড়াবে কোন পথে? বিলিয়ান ডলার প্রশ্ন এটাই। এরকম সঙ্কট আগে কোনও দিন হয়নি। ২০০৮-এর মন্দা আর এবারের মন্দার পেছনে দুটি আলাদা কারণ, চরিত্র তাই এক নয়, অর্থনৈতিক কাজকর্ম স্থবির হয়ে যাওয়ার পরিমাণও স্তরভেদে ভিন্ন। তাই সমাধান একই ফর্মুলায় বা একই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হবে না। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ফিনান্স ক্যাপিটাল দেউলিয়া হয়, তাই ভাবা হয়েছিল নতুন করে আরও পুঁজি ঢাললেই আর্থিক ক্ষেত্র শুধরে যাবে। এবারের আক্রমণটা আরও গভীরে। গোটা বিশ্ব অর্থনীতিই বিচ্ছিন্ন। প্রতিটা দেশ নিজেরাই কী করে টিকিয়ে রাখবে তাদের ব্যবস্থা সেই আশঙ্কায় রয়েছে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে।

এর মধ্যে জার্মানি ৩৫৬ বিলিয়ন ইউরোর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা দেশের জিডিপি-র ১০ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশের সমস্ত সংস্থার শ্রমিক-কর্মচারীদের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মজুরি সরকার দেবে, ঘোষণা করেছে ব্রিটেন। বার্ষিক ৭৫ হাজার ডলার অপেক্ষা কম উপার্জনকারী প্রত্যেককে ১২০০ ডলার করে দিচ্ছে আমেরিকা। অর্থনীতিকে বাঁচাতে ও জীবন-জীবিকা উদ্ধারে নাগরিকের হাতে অর্থ দান, ডুবন্ত বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সাহায্য, প্রয়োজনে আংশিক জাতীয়করণের নীতি— এগুলো কিন্তু সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি নীতি।

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার তাহলে কোন পথে কীভাবে হবে? সেটা আরও কোটি কোটি বিলিয়ান ডলারের প্রশ্ন। কে দেবে ভর্তুকি? দিতে হবে সেই সরকারকেই। তাহলে কেন বলা হয় বাজার থেকে রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে নিক। বিপদের সামাল দেবে সরকার, ক্ষতির মাশুল দেবে সরকার, তারপর বিপন্ন উন্নয়নশীল দেশকে ধার দেওয়ার ব্যবসা করবে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, মার্কিন জোটের লবি, চীন, জাপানের মতো উন্নত দুনিয়া। সুদে আসলে তাদের ধার শোধ করতে কমপক্ষে ৬০% খরচ বাড়বে সর্বস্তরে। তাহলে কোথায় পেল সাধারণ মানুষ বিশ্বায়নের সুফল?

বিশ্বায়ন শুরু হয়েছিল এক দেশে কম খরচে বানিয়ে অন্য দেশের বাজার পাওয়ার জন্য। করোনা-পরবর্তী সময়ে সেই কম খরচে উৎপাদনের সুযোগ কমে যাচ্ছে, অথচ বাজার বাড়ছে না। সর্বোপরি সরকারকে সরিয়ে বেসরকারি পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে (বাজারের অদৃশ্য শক্তিকে মেনে নিয়ে) যেভাবে উন্নয়নের ডিসকোর্স রচনা করা হয়েছিল, সেই তত্ত্বের গোড়ায় আক্রমণ করল বর্তমান পরিস্থিতি। শেষে বেসরকারি পুঁজিকে সুসময়ে লালন-পালন আর দুঃসময়ে বাঁচাতে আসতে হচ্ছে জনগণের টাকা দিয়েই। রাষ্ট্রকেই বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে বাজার। তাহলে বিশ্ব লগ্নি পুঁজির সপক্ষে রচিত বিশ্বায়নের ভাবনাটাই তো বদল করা দরকার।

চ্যালেঞ্জের মুখে এখন সেইসব অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যা এতদিন ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের পথ প্রশস্ত করে সামাজিক কল্যাণের রাস্তা বন্ধ করেছিল। অর্থনীতির উপরতলার থেকে উদ্বৃত্ত ও সঞ্চয় চুঁয়ে পড়ার তত্ত্ব কতটা শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থান বাড়াতে পেরেছে? করোনাভাইরাস আক্রমণের আগেই আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে বেকারত্ব চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। অকল্যাণকর, পরিবেশ বিপন্ন করে গণ উন্নয়নকে বাধা দেয় যে-পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন, তাতে যে গোটা মানবসমাজ বিপন্নই হয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল করোনাভাইরাস। এখন সেই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হচ্ছে দেশের মানুষকে বাঁচাতে।

তাহলে বেসরকারিকরণের ধ্বজা ওড়ানোর আদৌ কোনও যুক্তি আছে কি? বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা লকডাউন সামাল দিতে না পেরে দেউলিয়া ঘোষণা করে সরকারি সাহায্য চাইছে কোটি কোটি বিলিয়ান ডলার। বলা হচ্ছে, ছোট-বড় সব ধরনের পুঁজিকে যত রকমে সম্ভব ঘাটতি পূরণের সাহায্য দিতে। বিভিন্ন দেশ তা দিচ্ছেও। প্রশ্ন হলো, কেন এই ভর্তুকি? জনগণের করের টাকায় সাহায্য না দিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই তাহলে সেই সংস্থাগুলি অধিগ্রহণ করে চালানো হচ্ছে না কেন? প্রতিযোগিতার বাজারে যদি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলে রাষ্ট্রীয় সংস্থার ক্লোজার মেনে নেওয়া যায়, তাহলে কেন সরকারের টাকায় সরকারের সংস্থা না চালিয়ে রুগ্ন, দেউলিয়া বেসরকারি সংস্থাকে অক্সিজেন দেওয়া হবে? আর সেটা করতে গিয়ে কেন দেশের সরকারের কোষাগার ক্রমশ ফাঁকা হতে হতে গোটা দেশটাই দুর্বল হবে?

আজ এই প্রশ্নের মুখে খোদ আমেরিকা। বুঝতে পারছে সকলেই যে বাজারসর্বস্ব অর্থনৈতিক নীতি কীভাবে সরকার ও জনগণকে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব করছে। এই করোনাভাইরাসের প্রকোপ এতটা তার কারণ তাদের সরকারের বাজারি নীতিতে নেই সাধারণ মানুষের জন্য সস্তায় স্বাস্থ্য, নেই সামাজিক সুরক্ষা। কোষাগারে শত কোটি বিলিয়ান ডলার নিয়েও নিজের দেশের মানুষের জন্য বিনামূল্যে তো দূরের কথা, সস্তাতেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। হার্ভার্ড-এর গবেষক থেকে মার্কিন মিডিয়া এখন সকলেই বলছেন, আমেরিকার এই মারাত্মক পরিণতির জন্য দায়ী জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশবিরোধী লগ্নি পুঁজির বাজারি অর্থনৈতিক নীতি।

শুধু শুধু বাজার থেকে সরে যাওয়ার সমন দেওয়া হয় সরকারি সংস্থা আর দুর্বল মানুষকে। যেন ভাবটা এই যে, তোমার যোগ্যতার অভাব, তাই তুমি টিকতে পারবে না, তার দায় কেন রাষ্ট্র নেবে? অথচ এই যুক্তি ভুলে লালন-পালন করা হয় বেসরকারি লগ্নি পুঁজিকে। দেশের বিপদে তারা সামান্যই ভূমিকা নেয়।

পুঁজিকেও যদি টিকতে হয় তবে বুঝতে হবে নিজেকে ঠকানোর দিন শেষ। বাজারের শক্তিই যদি নিরূপক হয় তাহলে তার জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ নীতি। 'যে জিতবে সেই হবে সিকান্দার' নীতিতেই পলায়নপর বেসরকারি পুঁজিকেও তাহলে সরে যেতে হবে। সেই জায়গা পুনর্দখল করুক রাষ্ট্র, তাতে রাষ্ট্র ও জনগণ কেউই বঞ্চিত হবে না। চীন কিন্তু সেটা করেই আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হতে পেরেছে। সে-দেশে বেসরকারি পুঁজিকে উৎসাহ দেওয়ার মানে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা নয়। চীনের রাষ্ট্রীয় সংস্থাও কাউকে জায়গা ছেড়ে দেয় না। মার্কিন ও সব ইউরোপীয় সরকার পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তাই তাদের বাজারও নিচ্ছে চীন।

পুঁজি ও সর্বস্তরের মানুষের শ্রমের উৎপাদনশীলতা সর্বোচ্চ করে রাষ্ট্রকে সামনে রেখে করোনা-পরবর্তী নতুন অর্থনৈতিক নীতি নিতে হবে। দুঃখের বিষয়, কোনও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাংক, মার্কিন মদতপুষ্ট অর্থনীতির প্রবক্তারা এই কথা বলবেন না, কারণ তাদের গবেষণার বিষয় ও বক্তব্য একটাই: যেভাবে সম্ভব রাষ্ট্রকে নিষ্ক্রিয় করে বেসরকারি পুঁজির মুনাফা বাড়ানো। রাষ্ট্রকে শুষে বাজার দখল—এটাই তাদের এক তরফা এজেন্ডা। এতদিন তাই তারা বলে এসেছেন, রাষ্ট্রকে গুটিয়ে নিতে, বাজারের অদৃশ্য শক্তির হাতে ছেড়ে দিতে হবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ!

আজ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছে কত বড় ভুল ছিল এই নীতি। তার জন্যেই আজ বিপন্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বর্তমান বাস্তবতা ছুঁড়ে দিয়েছে পাল্টা প্রশ্ন: আজ যদি রাষ্ট্র না থাকে তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে? পুঁজি কী করে বাজার ফিরে পাবে? সেইজন্যই তো বলা হচ্ছে, চাহিদা বাড়াতে সরকারি অর্থ ঢেলে সবকিছু সচল রাখার কথা। তার জন্য লাগবে শত শত ট্রিলিয়ান ডলার! কে দেবে? দেবে তো সেই রাষ্ট্র, যে টাকাটা শেষমেশ আসবে সেই জনগণের পকেট থেকেই!

করোনা-পরবর্তী বিশ্বায়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত, তাই সর্বাগ্রে পরিবেশের উন্নয়ন, সর্বস্তরের পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে এনে অসাম্য কমানো এবং উৎপাদনশীলতার নিরিখে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাজারের সম্প্রসারণ। কর্পোরেট বোর্ডরুম থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংকঋণের নামে জনগণের টাকায় ব্যবসা করা আর নয়; সরকারি সংস্থাকে রাজনৈতিক কৌশলে সরিয়ে মুনাফা বাড়িয়ে বাজারকে কুক্ষিগত করার নীতিতে উন্নয়ন স্থায়ী হয় না। আসল কথা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। নিরবিচ্ছিন্ন বিকাশের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চাই। কেবল দুর্বল শ্রেণির মানুষকে দু-চার মাস ফ্রি সাহায্য দিয়ে, দেশ বা বাজার কোনওটাই গড়ে ওঠে না।

তবে কি এই সংকট মোকাবিলার দাওয়াই হবে সমাজতন্ত্র? ধ্রুপদী সমাজতন্ত্র আজকের বিশ্বে প্রয়োগ করা কঠিন। আর সেটা হয়তো হবে না, পুঁজিবাদের সেবকরা তা হতে দেবেন না। কিন্তু এ কথা ঠিক যে করোনা-সংকট পুঁজিবাদের কারুকার্যময় ব্যান্ডেজ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তাহলে পরিত্রাণের পথ কী হবে?