জহুরুল ইসলাম: যে জীবন বদলে দিয়েছিল জনপদ

খন্দকার মাইনুল হাসান
Published : 19 Oct 2020, 01:59 PM
Updated : 19 Oct 2020, 01:59 PM

অনেকদিন হয়ে গেছে তার প্রয়াণের। তাই এ যুগের অনেকেই তাকে চেনেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে প্রায়ই দেশ-বিদেশের নানা শিল্পপতির কাজ নিয়ে মোটিভেশনাল লেখা-ছবি-ভিডিও দেখা গেলেও জহুরুল ইসলামকে নিয়ে প্রায় কোনও আলোচনাই হয় না। 

অথচ আজকের যে পরিকল্পিত ঢাকার কথা আমরা শুনি, তার অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

তার প্রতিষ্ঠিত জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ আমাদের কাছে অনেক আবেগজড়িত একটি নাম। কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ক্যাম্পাসের পরতে পরতে! এজন্য আমরা এ ক্যাম্পাসকে আমাদের 'সেকেন্ড হোম' বলি। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাদের কাছে পিতৃ-মাতৃতুল্য। দেশের অন্যতম সেরা মেডিকেল কলেজ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে বহুবছর ধরেই আমাদের প্রিয় এই প্রতিষ্ঠান।

এ লেখাটি মূলত একজন কর্মবীর- যিনি বদলে দিয়েছেন নিজ স্বপ্নের জাদুর স্পর্শে অনেক অনেক জীবন- সেই জহুরুল ইসলামকে স্মরণ করে।

জন্মগতভাবেই জহুরুল ইসলাম এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ধারক ও বাহক। মুঘল আমলের মধ্য ভাগে জহরুল ইসলামের পূর্বপুরুষ তিন ভাই  বাজেত খাঁ, ভাগল খাঁ ও দেলোয়ার খাঁ মুঘলশাহের দরবারি আমলা হয়ে এই এলাকায় আসেন। 

পরে বাজেত খাঁ-র নামানুসারে বাজিতপুর, ভাগল খাঁ-র নামানুসারে ভাগলপুর ও দেলোয়ার খাঁর নামানুসারে বর্তমান দিলালপুর নামকরণ হয়। জহুরুল ইসলাম ভাগল খাঁ-র পরিবারের ত্রয়োদশ বংশধর। তার জন্ম কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানার ভাগলপুরে ১৯২৮ সালের পয়লা অগাস্টে। তার পিতা আফতাব উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন জেলার পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৮ সাল থেকে টানা ১০ বছর বাজিতপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই জহুরুল ইসলামের স্বভাব ছিল  গরীব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করা। স্থানীয় স্কুলে প্রাইমারি পর্যন্ত পড়ার পর কিছুদিনের জন্য সরারচর শিবনাথ হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। সেখান থেকে স্কুল পরিবর্তন করে বাজিতপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন। লেখাপড়ার এক পর্যায়ে চাচার সাথে কোলকাতা চলে যান। সেখানে রিপন হাইস্কুল থেকে ইংরেজি মাধ্যমে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে বর্ধমান কলেজে ভর্তি হন। পরে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হয়ে মেধা থাকা সত্ত্বেও খরচ জোগার করতে না পারার কারণে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ আটকে যায় জহুরুল ইসলামের। কিন্তু তিনি আটকে থাকেননি। ১৯৪৮ সালে ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সিঅ্যান্ডবি-র ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তিন বছর চাকরি করেন। এরপর তিনি নিজে ছোটখাটো ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন।

শিক্ষাজীবন সাধারণ হলেও কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অসাধারন মেধার সাক্ষর রাখার সুযোগ হয়তো জহুরুল ইসলাম সাহেব পাননি। কিন্তু কর্মজীবনে তিনি ছিলেন অতুলনীয় কৃতিত্বের অধিকারী। বিন্দু থেকে সিন্ধু কিংবা চারাগাছ থেকে মহীরুহ প্রবাদটি সার্থকতা পেয়েছে তার কর্মজীবনে। 

ঠিকাদারির জীবন থেকে তিলে তিলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এ জনপদের সবচাইতে বড় শিল্পপতি হিসেবে। 

পূর্ব-পাকিস্তানে সম্ভবত হাতে গোণা কয়েকজনের মধ্যে তিনি অন্যতম বাঙালি শিল্প উদ্যোক্তা, যিনি পশ্চিমা শিল্পপতিদের সমান্তরালে হেঁটেছেন। তার সৃষ্টির পরিধি বিশাল। শিল্প কারখানার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বিদ্যাপিঠ, কৃষি খামার, ওষুধ তৈরির কারখানা, আধুনিক হাসপাতাল,ব্যাংক- আরও কতকিছু। 

এদেশে আবাসন ব্যবসার পথিকৃৎ তিনি। দেশের সীমানা পেরিয়ে আরব দুনিয়ায় গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন জনপদ, শহর আর উপশহর। তার এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে অর্জিত আয়ের সিংহভাগই ব্যয় করেছেন গণমানুষের কল্যাণে। 

অপরিকল্পিত,দূষণযুক্ত, রাস্তাবিহীন শহরের বিপরীতে তিনি প্রথম গড়ে তুলেছেন বেশ কিছু আবাসিক প্রকল্প- অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। তার প্রতিষ্ঠিত ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, ইস্টার্ন টাওয়ার, ইস্টার্ন ভিউ, ইস্টার্ন পয়েন্ট, ইস্টার্ন ভ্যালি, ইস্টার্ন নিকুঞ্জ- প্রভৃতির মাধ্যমে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন লাখ লাখ পরিবারকে।

শহরের আশেপাশে গড়ে তুলেছেন পল্লবী ইস্টার্ন মল্লিকা, আফতাবনগর আবাসিক প্রকল্প, রূপনগর আবাসিক, গোড়ান, বনশ্রী, নিকেতন, মহানগর, গারাডোগা, মাদারটেক, মায়াকুঞ্জ নামে আবাসিক প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ছোট-বড়-মাঝারি আকারের কয়েক হাজার প্লট আছে। এসব প্রকল্পে একাধিক মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, শিশুপার্ক, সুপার মার্কেটসহ নানা নাগরিক সুবিধা রাখা হয়েছে। বলা যায় যে ঢাকার নগরায়নে একটি বড় অংশের উন্নয়ন জহুরুল ইসলাম সাহেবের অবদান। 

তিনি প্লট ফ্ল্যাটের পাশাপাশি ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে তোলেন ইস্টার্ন প্লাজা, ইস্টার্ন মল্লিকা, ইস্টার্ন প্লাসের মতো অত্যাধুনিক শপিংমল। জহুরুল ইসলাম ঢাকার অদূরে সাভারে ১২ শ একর এবং পাশেই ১৫ শ একর জমি কিনে নিয়েছেন আবাসন ব্যবসার জন্য। তিনি দেশের পাশাপাশি আবুধাবীতে ৫ হাজার বাড়ি নির্মাণ, ইরাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অত্যাধুনিক ইট নির্মাণ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। ইরাকে বিখ্যাত সিটি সেন্টার ও আব্দুর কাদির জ্বিলানী (রহ) এর মাজার শরীফ কমপ্লেক্সের পাশে একটি আধুনিক মানের গেস্ট হাউজসহ অনেক স্থাপনা নির্মাণ করেন। এই সময় তিনি বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের শ্রমিক নেওয়ার পথ উন্মুক্ত এবং সুগম করেন। মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেন। তার নিজ জন্মস্থান বাজিতপুর হয়ে উঠেছে শিক্ষা,স্বাস্থ্য,মাঝারি শিল্পের নগরী, কৃষি খাতে এনেছেন আমূল পরিবর্তন।

তিনি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা সিটি করপোরেশন ভবন, হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনাল, জীবনবীমা ভবন, সাধারণ বীমা ভবন, টয়োটা  ভবনসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড ছাড়াও তিনি নাভানা গ্রুপ লিমিটেড, আফতাব অটোমোবাইলস, নাভানা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ঢাকা ফাইবারস লিমিটেড, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, দি মিলনার্স ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, ইস্টার্ন এস্টেটস লিমিটেড, ভাগলপুর ফার্মস লিমিটেড, এসেনশিয়াল প্রোডাক্টস লিমিটেড, ইসলাম ব্রাদার্স প্রোপারটিজ লিমিটেড, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল,আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড,আফতাব ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড গড়ে তুলেছেন। তার নিজ জন্মভূমি বাজিতপুরের মানুষদের  কর্মসংস্থানের জন্য বাজিতপুরে গড়ে তোলেন অর্ধশতাধিক ফার্ম।

শৈশবে জহুরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল 'সোনা'। যৌবনে পরিচিত কাছের মানুষের ডাকতো "জহুর ভাই" বলে। আর ব্যবসা ক্ষেত্রে সবার কাছে 'চেয়ারম্যান সাহেব' হিসেবে পরিচিতি পান জহুরুল ইসলাম সাহেব।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের জেলে আটক বাঙালি নেতা কর্মীদের মামলা,আহতদের চিকিৎসা ও পারিবারিক খরচ নিভৃতে বহন করেছেন। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খরচও তিনি ব্যক্তিগতভাবে বহন করেছেন।

আত্মপ্রচারে বরাবরই বিমুখ ছিলেন তিনি। এদেশের মানুষ হয়তো একারণেই তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না প্রায়। 

জহুরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণা অতি জরুরী। রাষ্ট্র,সমাজ আর মানুষের কল্যাণে তার অবদান প্রচারিত হতে হবে তার সুনাম ছড়িয়ে দিতে নয়- বরং মানুষকে উজ্জীবিত করতে- জন্মের যে ঋণ তা শোধ করতে হয় কিভাবে তা জানাতে।

এই জনপদে নানান সময়ে গড়ে উঠা আন্দোলন সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাই ভালো করে বলতে পারবেন রাজনীতির অঙ্গন থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে কিভাবে তিনি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন প্রতিটি কর্মযজ্ঞে। বাঙালির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল  অধ্যায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের হিংস্র থাবায় রক্তাক্ত হয়েছে এ জনপদ। শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখের বেশি নারী। জাতির জীবনের সেইসব  দুর্বিষহ দিনে জহুরুল ইসলাম পালন করেছেন তার পবিত্র ও সঠিক দায়িত্ব। এই জনপদে গড়ে তোলা তার শিল্প কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য সব মায়া ত্যাগ করে তিনি চরম ঝুঁকি নিয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন হায়েনাদের থাবা থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার কর্মযজ্ঞে শামিল হতে।

তিনি ১৯৭১ সালের ৩ জুন পাকবাহিনীর হাতে আটক হন এবং মুক্তি পাওয়ার পর ১০ জুন লন্ডন চলে যান এবং সেখানে 'সুবেদ আলী' ছদ্মনাম ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনার বড় অংকের অর্থের জোগান দেন। দেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্নভাবে গোপনে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের কাছে অর্থ পৌঁছে দিয়েছেন। এমনিভাবে তিনি সকল রাজনৈতিক অভিলাষ ও ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন গনতান্ত্রিক আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে নিভৃতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধ তখন পুরোদমে। এই বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখে শত্রু হননের নেশায় উন্মাদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে। অন্যদিকে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে ব্যস্ত বিচারপতি আবু সাঈদের নেতৃত্বে প্রবাসী বাঙালিরা। জহুরুল ইসলাম ছুটে গেলেন লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে দেখা করতে। তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন অর্থ- দেশ ,মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতায়।

জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ছিল জহুরুল ইসলাম সাহেবের বড় আবেগের জায়গা। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন এবং আমরা তার স্বপ্নের ফসল, ধারক ও বাহক। জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ আমাদেরও বড় বেশি আবেগের জায়গা।।জহুরুল  ইসলাম মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল এবং জহুরুল ইসলাম নার্সিং  কলেজ স্থাপিত হয় আফতাব-রহিমা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অধীনে। প্রথম দফায় ১৯৮৯ সালে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল স্থাপিত হয়, বর্তমানে যার শয্যা সংখ্যা ৫০০-রও বেশি। জহুরুল ইসলাম সাহেবের ইচ্ছা ছিল মেডিকেল কলেজের পাশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার ,যদিও সেটা জনশ্রুতি সম্ভবত।

জহুরুল ইসলামের একমাত্র ছেলে- মঞ্জুরুল ইসলাম (বাবলু) ও চার মেয়ে- সাইদা ইসলাম (বেবী) ,মাফিদা ইসলাম (শিমি), নাইমা ইসলাম (ইমা), কানিতা ইসলাম (কানিতা) 

জহুরুল ইসলাম মাত্র ৬৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।