ধর্ষণের প্রতিরোধ ও প্রতিকার

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 11 Oct 2020, 02:05 PM
Updated : 11 Oct 2020, 02:05 PM

এক.

বাংলাদেশ যেন আজ ধর্ষকের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হতে চলেছে। শহরে, গ্রামে, পাহাড়ে, সমতলে, ঘরে, বাইরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৃশংস নিপীড়ণের শিকার হচ্ছেন নারী। শিক্ষিত, কর্মজীবী, গৃহবধূ, শ্রমিক যে পরিচয়েরই হোক না কেনো ধর্ষকের নোংরা হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না কেউ। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শ্রেণির কোন ভেদাভেদ এক্ষেত্রে অন্তত দেখা যাচ্ছে না। নির্যাতনের শিকার সকলেরই এক পরিচয়- তারা নির্যাতনের শিকার। এ নির্বিচার ধর্ষণের কারণ খুঁজে বের করার সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে। কেন ধর্ষকরা দম্ভের সাথে পৈশাচিকতা দেখিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে, কেন এই সোনার বাংলাকে তারা বারবার রক্তাক্ত করছে হিংস্র বিভৎসতায় এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের সময় চলে যাচ্ছে।

আমরা সরকারের কাছে দ্রুত ন্যায্য বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যতদিন না হবে, ততদিন এই পিশাচদের আস্ফালন বন্ধ হবে না। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি যদি দেয়া যায়, তবেই পরবর্তী সময়ে আরেকজন অপরাধ করতে ভয় পাবে। এভাবে বিচার সুনিশ্চিতের মাধ্যমে কমতে পারে এই বর্বরতা।

দুই

কিন্তু প্রশ্ন জাগে মানুষ কেন ধর্ষকামী হয়ে উঠছে? কেনো ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গাইবার মতো বিকৃত মানসিকতার লোকজন দেখা যাচ্ছে অনলাইনে এবং অফলাইনে?

প্রথমত ধর্ষকামী মনোবৃত্তি দমনে পরিবারের একটি বড়ো ভূমিকা আছে। একটি শিশুর মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠে পারিবারিক পরিবেশ থেকেই। যে পরিবারের শিশু নারীর প্রতি অবমাননামূলক আচরণ আর বৈষম্য দেখে বড় হয়, সে নারীকে কখনোই সম্মান করতে শেখে না। এই কথার প্রমাণ আমরা ঘরে-ঘরে পাচ্ছি। পারিবারিকভাবে নারীর প্রতি নিপীড়ণ ও অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বড় হওয়া শিশুদের মাঝে নারীর প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ও বিভ্রান্তিমূলক আচরণ তৈরি হয়। কেবল পুরুষ শিশুটির বেলায় নয়, কন্যা শিশুর ক্ষেত্রেও একই প্রমাণ মেলে।  

যখন পরিবারের কোনো শিশু বাবাকে দেখে মায়ের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে, তখন কন্যা শিশুটি ধরেই নেয় তার জীবনেও এমনটিই ঘটবে। এই অসুস্থ মানসিকতাকেই সে জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা মনে করে বড় হতে থাকে। আর পুরুষ শিশুটি শেখে স্ত্রীর প্রতি এ ধরনের নিপীড়ণমূলক ব্যবহারই নিয়ম। বাড়িতে যখন মেয়ে আর ছেলের মধ্যে খাবার প্লেটে, শিক্ষায়, খেলাধূলায় এমনকি চলাফেরায়ও বৈষম্য করা হয়; তখন থেকেই ছেলে শিশুটি নিজেকে উন্নততর প্রজাতি ভাবতে  শুরু করে। এই অন্যায় আর ভুল ভাবনাই তাকে নারীর প্রতি হেয় ও সহিংসতামূলক আচরণ করতে শেখায়।

আমরা যদি ঘরের ভেতরে আরেকটু খবর নিয়ে দেখি, তবে যেসব দৃষ্টান্ত আমরা পাই তা রীতিমতো শিউরে ওঠার মতোই। বাড়ির ভেতরে স্বজনদের দ্বারা যৌন নিপীড়ণের শিকার হননি, এমন নারী প্রায় নেই বললেই চলে। শৈশবের এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা বিশ্বাসে পরিণত হলে, একদিকে পুরুষ শিশুটি যেমন নারীর সঙ্গে যথেচ্ছ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে; তেমনি কন্যা শিশুটিও একে নিয়তি ধরে নেয়।

তাই শিশুকালেই নারী-পুরুষ নয়; বরং উভয়কেই মানুষ হিসেবে সমানভাবে চিন্তা ও আচরণ করার শিক্ষাদানের দায়িত্ব পরিবারেরই। পরিবারে সঠিক শিক্ষা ও পরিবেশ পেলে নারী শিশুটি যেমন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, তেমনি পুরুষ শিশুটিও নারীকে সম্মান করতে শিখবে।

তিন

সমাজে নানাভাবে নারীকে নিগৃহীত হতে দেখি আমরা। নাটক-সিনেমায় নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখি অহরহ; কিন্তু তা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের দৃশ্যায়ন দেখা যায় হাতে গোণা। গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখি। এমনকি বর্তমানে বিজ্ঞাপনের ভাষাও হয়ে উঠেছে নারী-বিদ্বেষী। গণমাধ্যমের ভাষাতেও নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। একটি বহুল চর্চিত উদাহরণ দেয়া যাক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম ও বইপত্রে বলা হয়, 'দুই লক্ষাধিক নারীর ইজ্জত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে'। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক প্রথিতযশা গবেষকদের বইতেও আমি এমন বক্তব্য দেখেছি। বক্তৃতাতেও এমন কথা ব্যবহৃত হয় অহরহ। প্রশ্ন হচ্ছে, 'ইজ্জত' বা 'সম্ভ্রম' কি কারও শরীরে থাকে? এটি তো ব্যক্তিত্ব ও বোধের বিষয়।

আমরা মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত নারীর প্রতি বিভৎস নিপীড়ণকে পাকিস্তানি বা তাদের দোসরদের অপরাধ হিসেবে দেখি না, বরং নির্যাতনের শিকার নারীর 'ইজ্জত' বা 'সম্ভ্রম' হিসেবে দেখি। এই অসুস্থ মানসিকতা সমাজের সর্বস্তরে বিদ্যমান। ফলে অপরাধীর চেয়ে অপরাধের শিকার ব্যক্তির বিষয়টিই বারবার আলোচনায় আসে। বিচারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নির্যাতনের শিকার নারীর বিরুদ্ধে সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট বয়ান বা ন্যারেটিভ।

বিজ্ঞাপনে-গণমাধ্যমে-সাহিত্য-সিনেমায় এমন অসংখ্য ঘটনা দেখানো যাবে। এগুলোও পুরুষের মানসিকতায় নারীর অবস্থানকে হেয় করায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। যেহেতু জন-মনস্তত্ত্বের সঙ্গে গণমাধ্যম বা বিজ্ঞাপনের একটি সম্পর্ক আছে, সেহেতু এসব বিষয়ে আমাদের সচেতন দৃষ্টি দেয়া অত্যন্ত জরুরি। অবিলম্বে গণমাধ্যমের কর্তৃপক্ষ ও গণমাধ্যমকর্মীদের এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ। বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককেই ব্যাপারটি নিয়ে ভাবা উচিৎ। আশু পদক্ষেপ গ্রহণের সময় বয়ে যাচ্ছে।

চার

আরেকটি বড় জায়গা হচ্ছে, সংগঠন বা সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকে সমাজ বা তার সহযোদ্ধারা কোন চোখে দেখছেন। সমাজের প্রায় অধিকাংশ সংগঠনে বা সংস্থায় নারীকে আলংকারিক করে রাখা হয়। তার মেধা ও যোগ্যতাকে বা নেতৃত্ব দেবার সক্ষমতাকে অবজ্ঞা করা হয়। নারী কী ধরনের পোশাক পরবেন তাও ঠিক করে দিতে চায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর অন্তর্গত প্রতিটি উপাদান। পোশাক, পেশা, লেখাপড়া, চলাফেরার সময় নির্বাচন সবক্ষেত্রেই নারীর দিকে আঙুল তোলে পুরুষশাসিত এ সমাজ। স্বাধীন বাংলাদেশে নারীর স্বাধীনতা কিন্তু নেই। তার প্রতিটি কাজের জন্য তাকে কোথাও না কোথাও এক ধরনের জবাবদিহিতামূলক আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারীদের ক্ষেত্রেও এই চিত্র প্রায় একইরকম। 

নানা কৌতুক বা হাসি-ঠাট্টাচ্ছলে নারীকে 'বোকা', 'নিষ্কর্মা', 'ঝগড়াটে' বা শুধু শাড়ি-গয়নার লোভী একটি সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এটাও নারীকে অপমান-অপদস্ত করার একটি প্রক্রিয়া। দিনের পর দিন এগুলো দেখে নারী-পুরুষ উভয়েরই মানসিকতা এখন প্রায় একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে। নারীদেরও যখন এ ধরণের লেখা বা অভিনয় নিয়ে বেশ উৎসাহিত হতে দেখি, ক্ষেত্রবিশেষে তারা যখন এর প্রতিবাদ তো দূরের কথা, বরং সমর্থন দিয়ে কথা বলেন; তখন বড় মায়া হয়। নারী বুঝতেও পারছে না তাঁকেই হেয় করা হচ্ছে। অর্থাৎ সমাজে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ব্যাধির শিকার নারী নিজেও।

বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সহপাঠী, শিক্ষক, টিফিন-বিক্রেতা, স্কুলের সামনের ফেরিওয়ালা বা গেইটে দাঁড়ানো রোমিও কার হাতে না যৌন নিপীড়ণের শিকার হচ্ছেন নারী শিক্ষার্থীরা! স্কুলভ্যান চালক 'মামা' খামোখাই যেভাবে বগলে ধরে ভ্যানে ওঠান, তা তার বিকৃত বাসনাই চরিতার্থ করে। আমরা একজন নারীও কি বলতে পারব, আমরা ঘরে আপনজন দ্বারা কিংবা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বা কোথাও কোনদিন কোন যৌন হয়রানির শিকার হইনি? আমি অন্তত একজনও পাইনি। পাঠ্যপুস্তকে বা শিক্ষকের আলোচনায় নারীকে সম্মান করার বিষয়ে আলোচনা থাকতে হবেই।

কর্মক্ষেত্রে নারী প্রতিনিয়ত বৈষম্য আর অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। একই দক্ষতা, সময় ও শ্রম দিয়ে নারী পুরুষের অর্ধেক পারিশ্রমিক পাচ্ছেন অনেকক্ষেত্রেই। কর্মক্ষেত্রে অনেক সময়ই নারীকে চোখেই ধর্ষণ করে তার পুরুষ বস বা সহকর্মী। কর্মক্ষেত্রে যাবার পথে বাস কন্ডাক্টর থেকে সহযাত্রী পর্যন্ত- সকলের মনোরঞ্জনের বস্তুতে পরিণত হয়। ইচ্ছে হলেই যে কেউ নারীর শরীরের যে কোনো জায়গায় হাত দিয়ে দাঁত বের করে হাসতে পারে। যারা ভদ্র সেজে হাত দেন না, তারা অন্যের এই আচরণ দেখে মনে মনে আনন্দ পান। ফলে প্রতিবাদের সময় কেউ পাশে এসে দাঁড়ানও না। উল্টো নারীকে আরও হেয় করা হয়। কর্মক্ষেত্রে লিফটম্যান থেকে দারোয়ান পিয়ন সকলেই ছুঁতে না পারলেও কথায় হেয় করতে বা দৃষ্টিতে লেহন করতে বাদ রাখে না। হয়তো যতটা ঢালাওভাবে বলছি, তেমনভাবে সকলেই নন। তবে অনুপাতটি এতই আকাশ-পাতাল যে, তা উল্লেখ করার মতই না।

পাঁচ

পাহাড়ে দেখি, সেখানকার আদিবাসীরাই এখন সবচেয়ে দুর্বল। তাই আদিবাসী নারীরা কখনো সেনাবাহিনী, কখনো বা সেটেলার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন বলে খবরে আসে বা অভিযোগ ওঠে। কখনো নারীদের ধরে নিয়ে যায়, আর বছরের পর বছর তাদের আর খোঁজই পাওয়া যায় না। কল্পনা চাকমার কথা আমরা জানি। পাহাড়ের নারী বা তাদের পরিবার বেশিরভাগ সময়েই নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে পারেন না ভয়ে। আবার অনেক সময় বিচারের আশায় পুলিশের কাছে গেলেও প্রভাবশালীদের প্রভাবে অভিযোগটা নথিভুক্তও করা হয় না। দুর্বলের প্রতি সবলের এ অত্যাচার পাহাড় ও সমতলে একই রকম। কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো গ্রাম্য সালিশে, কখনো টাকা দিয়ে সমঝোতা, কখনো বা রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে ধর্ষিতা ও তার পরিবারের মুখ বন্ধ করিয়ে দেয়।

আরেকটি বিষয় হলো, নারীকে হেয় করে যেসব ধর্মীয় নেতারা ওয়াজ করেন, সেগুলো কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ শুনতে পারে না। ধর্মের নামে তারা নারীর বিরুদ্ধে যেসব কথা বলে, তা স্পষ্টভাবে ফৌজদারি অপরাধ। নারী সম্বন্ধে এমন সব কুৎসিত কথা, যা মুখে আনাও যায় না। ওয়াজের নামে এসব নারী বিদ্বেষী কুৎসিত বক্তব্য অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। এসব কথিত ধর্মীয় নেতাদের বয়ান শুনে পুরুষ নারীকে অবমাননা করতে আরও উৎসাহিত হয়। ফেসবুক-ইউটিউবে ছড়িয়ে থাকা এইসব জঘন্য আলোচনা বন্ধে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। যে সব ধর্মীয় নেতারা এইসব কথা বলে থাকে, তারা প্রত্যেকেই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং নারী সম্বন্ধে আরও কুৎসিত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন কেনো তাদের বিষয়ে নিশ্চুপ, তা আমাদের বোধগম্য হয় না। 

ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ, যা নির্মূল করতে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আইনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যেমন অত্যন্ত জরুরি, তেমনি সমাজে বিরাজমান ধর্ষকামী মনস্তত্ত্ব দমনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশও জরুরি।