সরকারি কর্তাদের ভ্রমণ বিলাস এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মর্তুজা হাসান সৈকতমর্তুজা হাসান সৈকত
Published : 1 Oct 2020, 09:32 AM
Updated : 1 Oct 2020, 09:32 AM

সরকারের সবুজ সংকেত পাওয়া বেশিরভাগ প্রকল্পে থাকে বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এ সুযোগটি রাখা হলেও বর্তমানে এটি মূলত প্রমোদ বা বিলাস ভ্রমণে পরিণত হয়েছে। এসব ভ্রমণে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান অর্জনের নামে কর্মকর্তারা অনেকেই এমন সব বিষয়ে এমন সব দেশে যান, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাস্যরসের জন্ম দেয়। অন্যদিকে সুনির্দিষ্ট কারণ আর উপযুক্ত কর্মকর্তা ছাড়া এমন ভ্রমণে শুধু যে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় তা নয়, বরং অপচয় হয় বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থেরও। এ যেন, 'সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল'– অন্যদিকে কর্মকর্তাদের অদ্ভুত সব কারণে বিদেশ ভ্রমণের খবর সোশ্যাল মিডিয়াতেও সমালোচনার খোরাক জোগাচ্ছে।

এমনও শোনা যায়, অনেকে কর্মকর্তা পরিবার–পরিজন নিয়েও এসব ভ্রমণে বিদেশে যান। যদিও এসব সরকারি সফরের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশের কোনো লাভ হয় না। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য এটি এক ধরনের আনন্দের উপলক্ষ্য তৈরি করে। অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি জ্ঞান অর্জনের জন্য এসব ভ্রমণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে অকারিগরি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ করিয়ে আনার নজিরও আছে বেশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প তো দূরের কথা অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ করিয়ে আনা হচ্ছে!

খবর নিয়ে জেনেছি, প্রায় প্রতিবছরেই সরকারি, আধা–সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বাবদ সরকারি কোষাগার থেকে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। গত ৫ অর্থবছরের হিসাব বলছে, চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া ১ হাজার ৪০৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৯৯৩টিতেই বিদেশ ভ্রমণ ছিল। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানই যৌক্তিকভাবে এ অর্থ খরচ করতে পারে না। যদিও মহামারীকালে সরকারের তরফ থেকে এ অর্থবছরে রুটিন ভ্রমণ পরিহারের পাশাপাশি অপরিহার্য ক্ষেত্রেও সব ধরনের (দেশ–বিদেশ) ভ্রমণ ব্যয় অর্ধেক দেয়ার নির্দেশ রয়েছে।

এর মধ্যেই সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় একটি প্রকল্পে কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠিয়ে ডিম ও সবজি খিচুড়িসহ অন্যান্য 'রান্না এবং প্রসেসিং' শিখতে ৫ কোটি টাকা চেয়ে বসে। এর পাশাপাশি একই বিষয়ে দেশে প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তাব দেয় আরও ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের। এমন হাস্যকর প্রকল্প নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ভেতরে গরীব মানুষকে হাত ধোয়া শেখানোর অন্য একটি প্রকল্পে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। অন্যদিকে, গরু–ছাগল পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডি) প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৫০ জনকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। জনপ্রতি খরচ ৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা মাত্র!

সরকারি কর্মকর্তাদের এসব আমোদ ভ্রমণ সম্পর্কে আরও খবর নিতে গিয়ে যা জানলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার অবস্থা। গতবছর চট্টগ্রাম ওয়াসা পূর্ব–মধ্য আফ্রিকার দরিদ্র দেশ উগান্ডায় (যেখানে পানি ও পয়োনিষ্কাশন সুবিধা প্রকট) কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিশাল বহর পাঠিয়েছিল প্রশিক্ষণের জন্য। সে সফরে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারাও পর্যন্ত উগান্ডা ঘুরে এসেছেন। এছাড়া পুকুর খননে দক্ষতা অর্জন করতে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, লিফট কিনতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সুইজারল্যান্ড ও স্পেন যাওয়ার মতো ঘটনাও হাস্যরসের খোরাক জুগিয়েছে।

তবে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার জন্ম দেয় গত বছরের জুলাই মাসের একটি ঘটনা। ওই বছর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি দল যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ও মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা নাসা আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। তাদের পুরস্কৃত করতে নাসার পক্ষ থেকে ফ্লোরিডায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল দলটিকে। বিজয়ী দলের সদস্যদের সাথে যাওয়ার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তারও ভিসার আবেদন করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা থাকার কারণে নাসার আমন্ত্রণ পাওয়া বিজয়ী দলের চার সদস্যের কেউই যাওয়ার অনুমতি পায়নি। বিজয়ী প্রতিযোগীরা নেই, তাই কি বলে দেশের প্রতিনিধি থাকবে না? এমনটা মানতে পারেননি তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। প্রতিযোগীদের ছাড়াই সহযোগী হিসেবে যাদের যাওয়ার কথা ছিল, সেই ৮ জন কর্মকর্তা সরকারি খরচে ঘুরে এসেছেন মার্কিন মুলুক থেকে।

অবশ্য সরকারি কর্মকর্তাদের অহেতুক বিদেশ সফরের কারণে জনগণের অর্থের অপচয়ের বিষয়টি এখন সর্বজনবিদিত। তবে শিউরে ওঠার মতো তথ্য হলো– একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ যাওয়া, নলকূপ খনন শিখতে একাধিক কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ করার মতো নজিরও অহরহ তৈরি করছেন এসব কর্তাব্যক্তিরা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বিদেশ সফর অপ্রয়োজনে অথবা অযৌক্তিক কারণে হচ্ছে। আবার অনেক সময় সফরে যাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে অত্যধিক পাশাপাশি টাকার অঙ্কও অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে সেখানে।

এসব অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করার তাগিদ স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকেও বেশ কয়েকবার এসেছে। কারণ, কিছুদিন পরপর বিদেশ ভ্রমণের এমন ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে বিব্রত বোধ করে সরকারও। গত ডিসেম্বরে একনেকের এক সভায় বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এসব অহেতুক ভ্রমণ বন্ধ করতে হবে। এমনকি, এবার বাজেটের পর অর্থমন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্রও জারি হয়েছে। কিন্তু তাতেও প্রকল্পের টাকায় কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণকে রোধ করা যাচ্ছে না। কর্মকর্তারা তাদের দক্ষতা আর প্রশিক্ষণের উদ্যমে কোনোভাবেই মরিচা পড়তে দিতে চাইছেন না।

নীতিমালা অনুযায়ী, দাপ্তরিক কাজে শর্তসাপেক্ষে বছরে ৪ বার এবং সর্বোচ্চ ১০ দিন করে বিদেশে অবস্থান করতে পারেন সরকারি কর্মকর্তারা। তবে কোনো কোনো কর্মকর্তার বছরে ১০–১২ বারেরও অধিক বিদেশ সফরের রেকর্ড রয়েছে। এটা এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, অধিকাংশ সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই প্রকল্পের টাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন বা প্রশিক্ষণের নামে সরকারি কর্মকর্তারা প্রমোদ ভ্রমণে দলবেঁধে বিদেশে যাবেন।

এইসব ভ্রমণে বিদেশে গিয়ে যে সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা খিচুড়ি রান্না শিখতে কিংবা উন্নত পরিবেশন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে চেয়েছিলেন তারা কি দেশে ফিরে তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খিচুড়ি রান্না বা পরিবেশন করতেন? অথবা যে দেশ পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিলে ভরপুর, সেই দেশের যেসব সরকারি কর্তারা পুকুর খননের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দলবেঁধে সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করতে গিয়েছিলেন, তারা দেশে ফিরে কি পুকুর কাটা তদারকি করতে নেমেছেন? মোটেই না। করোনাকালীন সময়ে চাকরি হারিয়ে লাখ লাখ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরীব মানুষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের গতি মন্থর, সরকার আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যায় নিপতিত, সেই সময়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয়ের খবর যখন সংবাদমাধ্যমে আসে তখন ক্ষোভে, কষ্টে, লজ্জায় এমনিতেই মাথা নিচু হয়ে যায়।

তবে তার মানে এই নয় যে, সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে যাবেন না। অত্যাবশ্যকীয় কাজে প্রশিক্ষণের জন্য, অথবা বিশেষ কোনো বিষয়ে কারিগরি বা ব্যবস্থাপনার জ্ঞান আহরণে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর করার বিষয়টি অত্যন্ত যৌক্তিক। তাছাড়া, উন্নয়ন করতে গেলে প্রকল্প প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন অপরিহার্য। প্রকল্প ছাড়া বিদেশি সহায়তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আরেকটি ব্যাপার হলো, বিদেশি অর্থায়নের বেশিরভাগ প্রকল্পে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকেই। তাই আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা আছে এমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাইরের দেশ থেকে ট্রেনার নিয়ে এসে উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ অনেকাংশে রোধ করা যাবে।

কারণ, অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, বিদেশ ভ্রমণের লোভে এমন কর্মকর্তাও বিশেষ জ্ঞান অর্জনের ট্যুরে চলে যান, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যার প্রাথমিক ধারণাই দুর্বল। আবার ফিরে এসে তিনি অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছেন, তারও উদাহরণ কম। অন্যদিকে, কারো কারো ভেতরে বিদেশ ভ্রমণ এক ধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে। কেউ যাচ্ছেন কেবল দেশ ভ্রমণ অথবা বিনোদনের উদ্দেশ্যে। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, যেসব সফরে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তাদের দিতে বলা হয়েছে সেগুলোতেও সিনিয়র কর্মকর্তারা চলে যাচ্ছেন।

এজন্য অহেতুক ও ঘন ঘন এসব বিদেশ ভ্রমণে লাভ-ক্ষতি কী হচ্ছে, প্রকৃত প্রয়োজনীয় ব্যক্তিরা যাচ্ছেন কিনা, পাশাপাশি খরচের বিষয়গুলো যথাযথ অডিট এবং লোভনীয় টিএ-ডিএ কমিয়ে আনাসহ বিনা কারণে বিদেশ পাঠানোর নীতি পরিবর্তন করে একটি নীতিমালা তৈরি করা গেলে পরিস্থিতির উন্নয়ন হতো বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি, যেসব কর্মকর্তা পিকনিক মুডে বিদেশে গিয়ে আমোদ ফুর্তি করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায়, সরকার যেমন জনগণের আস্থা হারাবে তেমনই ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকবে প্রশাসনের পুরো সিস্টেম।