কোভিড সময় এবং একজন খালেদা জিয়া

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 30 Sept 2020, 03:37 PM
Updated : 30 Sept 2020, 03:37 PM

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দোষী সাব্যস্ত করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আদালত কারাগারে পাঠায়। মামলাটি ১/১১ এর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক দায়ের করা। তার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ছাড়াও আরও ৩৪টি মামলা রয়েছে যার বেশিরভাগই ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকার কর্তৃক করা। 

গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আকস্মিকভাবে চিকিৎসার জন্য বেশ কিছুটা সময় লন্ডন অবস্থান করেন খালেদা। তখন অনেকে এটা ভেবে নিয়েছিলেন, মামলার রায় এড়াবার জন্যই হয়ত সরকারের সাথে গোপন সমঝোতার অংশ হিসেবে তিনি লন্ডন চলে গেছেন। 

খালেদার লন্ডনে অবস্থান যত দীর্ঘায়িত হতে থাকে জনমানসের একাংশের মনে সে ধারণা তত বদ্ধমূল হতে থাকে। তাদের মনে হতে থাকে বৃদ্ধ বয়সে তিনি হয়ত জেলে যাবার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। আদালতের রায় মোকাবেলা করবার প্রস্তুতি নেন। তার এ ফিরে আসা খালেদা জিয়ার 'আপসহীন নেত্রী'র যে ইমেজ বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলেছে, তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। 

কী কারণে খালেদা দেশে ফেরার ঝুঁকি নিয়েছিলেন? তিনি কি ভেবেছিলেন সরকার তাকে গ্রেপ্তার করলে মানুষ ক্ষিপ্ত হবে? দেশে গণআন্দোলন গড়ে উঠবে? তার গ্রেপ্তার জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া বিএনপিতে গতি সঞ্চার করবে? নেতাকর্মীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে তার মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে? বিএনপি খালেদার মুক্তি আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে পারবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রসমূহ খালেদার মুক্তির জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করবে? এ সমস্ত কিছুর ফলে, তিনি বিজয়ীর বেশে কারাগার থেকে বের হয়ে আসবেন? 

এর কোন কিছু ভেবে যদি তিনি দেশে ফিরে থাকেন, তাহলে বলতে হবে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পরেও খালেদা গত ১০-১২ বছরে রাষ্ট্র কাঠামো এবং রাজনীতিতে যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা বুঝে উঠতে পারেননি। আরো বুঝতে পারেননি আস্তে আস্তে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির- সরকার, দল এবং আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে- 'গভীর রাষ্ট্রে' রূপান্তরের বিষয়টিও। 

একইভাবে তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি- ৯/১১ পরিবর্তিত পরিস্থিতি থেকে আজকে ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন আমেরিকার রূপান্তর, রাশিয়া-চীনের উত্থান, ভারতে হিন্দুত্ববাদের জয়-জয়কার, প্রিন্স সালমানের সৌদি সমাজের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা- ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ফলে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে তার স্বরূপটিও। 

এমনকি দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে খালেদা যে দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, সেই দলটির বর্তমান স্বরূপও তিনি বুঝে উঠতে পেরেছিলেন কিনা—সেটিও একটি দ্ব্যর্থবোধক প্রশ্ন। আর এ না বুঝতে পারার ফলেই, এ দলের উপর ভরসা করেই তিনি দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

যে দলের উপর ভরসা করে তিনি দেশে ফেরেন, সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার মুক্তির ব্যাপারে এ দলটি কোনও আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগই নেয়নি। যে বিএনপি নানা অজুহাতে বহু হরতাল ডেকেছে, জামায়াতের সাথে পেট্রোল বোমা নির্ভর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পথে দুইবার গিয়েছে, সেই দলটি খালেদার মুক্তির দাবিতে প্রতীকি অর্থে হলেও কেন আধাবেলা হরতাল ডাকল না, সেটা বোঝার জন্য হয়ত আমাদের আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। 

মুখে আইন আদালতের উপর আস্থাহীনতার কথা বললেও বিএনপি খালেদার মুক্তির বিষয়টাতে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছে বিচার ব্যবস্থার উপর। আবার বিএনপির আইনজীবীরা খালেদার মামলার ব্যাপারে সঠিক আইনগত পদ্ধতি অবলম্বন করছেন কিনা, এ বিষয়টা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে। 

খালেদার মুক্তির ব্যাপারে বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা, সঠিক আইনগত পদ্ধতি অবলম্বন নিয়ে প্রশ্ন ওঠা ইত্যাদি নানবিধ কারণে অনেকের মনে হয়েছে খালেদাকে নিয়ে বিএনপির নেতৃত্ব আসলে কী চাচ্ছে।

এমতাবস্থায় খালেদার পরিবার দলকে পাশ কাটিয়ে তার মুক্তির ব্যাপারে সরকারের কাছে ক্রমাগত আবেদন-নিবেদন করতে থাকে। পাশাপাশি খালেদার জামিনের ব্যাপারে নেতাদের কেউ কেউ সরকারের নানা মহলে ধরনা দিতে থাকেন । কোন কিছুতেই যখন কোন কিছু হচ্ছিল না, বিএনপির সমর্থকরা যখন আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার পর তখন হঠাৎ করেই ২৫ মার্চ এক নির্বাহী আদেশে সরকার খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে মুক্তি দিয়ে দেয়। 

এ আদেশে আপাত কোন শর্ত উল্লেখ না থাকলেও অনুমান করা যায়- নেপথ্যে তার সক্রিয় রাজনীতি না করা এবং বিদেশ না যাবার শর্ত রয়েছে। ছয় মাস তিনি সব শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পরিবারের মাধ্যমে আবার সাজা স্থগিতের মেয়াদ বাড়াবার আবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য আবার তা অনুমোদন করেন। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে আর কোন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকে সরকারের বেঁধে দেওয়া সব শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করে রাজনীতি করতে দেখা যায়নি। এদেশের বহু রাজনীতিবিদের বছরের পর বছর জেল খাটার নজির রয়েছে। এর বিপরীতে এটা পরিষ্কার যে, খালেদা জেলে থাকতে চাচ্ছেন না। এর জন্য যা যা শর্ত মানতে হবে, সব মানতে তিনি রাজি। এমনকি যে পরিচয়ে তিনি পরিচিত, অর্থাৎ রাজনীতিবিদ, সেটা বিসর্জন দিয়ে হলেও তিনি জেলের বাইরে থাকতে চান। জেলের বাইরে থাকবার জন্য যেকোনও বিষয়েই তিনি আজ আপস করতে ইচ্ছুক। 

কোভিড-১৯ এর এ দুঃসময়ে সরকারের নানা ব্যর্থতার সমালোচনা খালেদা করতে চান না। কেননা, এতে তাকে আবার জেলে ফিরে যেতে হতে পারে। যেকোনও মূল্যে জেল থেকে দূরে থাকবার চেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একমাত্র এরশাদই করেছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে রাজনীতিতে নানা সময়ে আপস করা সত্ত্বেও বিএনপি এতদিন পর্যন্ত তার  যে "আপসহীন" ইমেজটি ধরে রাখতে পেরেছিল, জেল জীবন এড়াবার জন্য খালেদা নিজেই আজকে সেটা ভেঙ্গে দিতে দ্বিধা করলেন না। 

রাজনীতিতে '/আপসহীন' কোন ভালো ইমেজ নয়। পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে 'আপসহীনতা' ঔদ্ধত্য ও অহমিকা হিসেবেই চিহ্নিত হয়। দেশ-বিদেশের সমস্ত বড় বড় রাজনীতিবিদই নানা সময়ে আপস আর সমঝোতার মধ্যে দিয়েই রাজনীতি করেছেন। লেনিন, স্তালিন, মাও, আব্রহাম লিঙ্কন, গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাহ থেকে শুরু করে কেউই এর ব্যতিক্রম নন। 

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে খালেদা নিজেও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিবিসি বাংলার (১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০) রিপোর্ট অনুযায়ী ১/১১ সেনা কর্মকর্তাদের সাথে সমঝোতা করেই বড় ছেলে তারেক রহমানকে লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন তিনি। এখন দেখা যাক, ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে বিএনপি খালেদা জিয়ার 'আপসহীন' ইমেজ নির্মাণ করেছিল।     

সময়টা ১৯৮৬ সাল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনের দল এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাত দলের নেতৃত্বে সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। অনেকেই ভাবছিলেন এরশাদের পতন বোধহয় আসন্ন। এদিকে সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এরশাদের অধীনে নির্বাচনে কেউ যাবে না, মোটামুটি সবার এরকমই সিদ্ধান্ত। 

এসময় পনের দলের এক মিটিং বসে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা নিয়ে। ওই সভায় হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপসহ (মো) আরো কয়েকটি দল বলে বসে যে তারা নির্বাচনে যাচ্ছে। সভায় উপস্থিত অনেকে এতে স্তম্ভিত হয়ে যান। সভা তখনই ভেঙ্গে যায়; একই সাথে ভেঙ্গে যায় পনের দলীয় জোটও। 

পনের দলীয় জোট হয়ে যায় ৮ দলীয় জোট। বাসদ, ওয়ার্কাস পার্টি, প্রয়াত নির্মল সেনের শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলসহ পাঁচটি দল জোট থেকে বেরিয়ে নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। বিএনপিসহ সাত দলীয় জোট আন্দোলনে থাকবার এবং নির্বাচন বর্জন করবার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। 

খালেদা জিয়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখবার ঘোষণা দিয়ে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে তাদেরকে "জাতীয় বেঈমান" হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিএনপি খালেদা জিয়াকে 'আপসহীন নেত্রী' হিসেবে আখ্যায়িত করে। জনগণের 'পালস' বুঝে খালেদা জিয়াকে এভাবে ব্র্যান্ডিং—বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দেয়। 

খালেদা জিয়ার নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তকে জনগণের একটা বড় অংশ ইতিবাচকভাবে দেখে। কিন্তু এর পরেও সাত এবং পাঁচ দলীয় জোট নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি। পরবর্তীতে ৮ দল বিশেষত আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে এরশাদ বিরোধী ব্যাপক আন্দোলনও তারা গড়ে তুলতে পারেনি। 

এখানে উল্লেখ্য যে, আজকে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াত সেদিন ৮ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১০টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের ৪ দশমিক ৬ শতাংশ পায়। কিন্তু পরবর্তী.তে খালেদা জিয়া সেই এরশাদ এবং জামায়াতের সাথে জোট করলেও তার 'আপসহীন নেত্রী' ইমেজের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি; বাঙালি মানসে দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় মুসলিম জাতীয়াতাবাদী চেতনার প্রবল উপস্থিতির কারণে। 

বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত- এ তিনটি দলই কম বেশি এ চেতনাকে ধারণ করে। জামায়াত আরও এক কদম এগিয়ে এ চেতনার সাথে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যার শরীয়াহ নির্ভর 'ইসলামপন্থার' রাজনীতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র এবং সমাজের মৌলিক রূপান্তর ঘটাতে চায়। 

আওয়ামী লীগ সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ বিনির্মাণের চেষ্টা করলেও সে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমাজের মৌলিক রূপান্তরের জন্য যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দরকার, তা গড়ে তোলার কোনও উদ্যোগ নেয়নি। তারা ক্ষমতায় আছে বা থেকেছে, এতেই তারা সন্তুষ্ট। সমাজে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনার সুগভীর উপস্থিতির বিপরীতে জনগণের মানস চেতনার আমূল পরিবর্তনের জন্য যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার, এ বিষয়ে তারা শুধু উদাসীনই নয় বরং বিষয়টি তারা কখনো উপলব্ধি করেছে কিনা, এটি প্রশ্ন সাপেক্ষ।

অপরদিকে, মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারা যাতে সমাজে অব্যাহত থাকে এর জন্য ডান এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরা আন্তোনিও গ্রামসির ভাষায় যাকে বলে নীরব বিপ্লব (passive revolution), সে বিপ্লবের ধারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে নানা মাধ্যমে জারি রেখেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের দখলে না থাকলেও তাদের লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের বড় অংশের মানস কাঠামতে নিজেদের প্রাধান্য অব্যাহত রাখা। এর মধ্যে দিয়ে সামাজিক কাঠামগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। 

এ প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ টানা দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষমতায় থাকবার পরেও তারা এতটাই সফল যে, দলগতভাবে খোদ আওয়ামী লীগকেই আজ এ শক্তির সাথে সমঝোতা করে রাজনীতি করতে হচ্ছে। দলটির নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশই শুধু নয়, এমনকি সমর্থক বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা পরিচিত তারাও আজকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের আলোকেই দেশ, সমাজ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বোঝাপড়া, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। 

এমনকি, বামপন্থিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও মার্কসবাদী তকমা গায়ে লাগিয়ে উত্তর- আধুনিকতবাদের পরিভাষা ব্যবহার করে জিন্নাহর মুসলিম জাতীয়াতাবাদী তত্ত্বের একটা শক্ত বুনিয়াদ সমাজে গড়ে তোলবার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন। বস্তুত, মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের চেয়ে বামপন্থিদের এ অংশটির দ্বিজাতি তত্ত্বের আধুনিকায়নের উদ্যোগ- তরুণ সমাজের অগ্রসর অংশ দাবিদারদের মাঝে বেশি গ্রহণীয় এবং আকর্ষণীয়। 

মুসলিম জাতীয়তাবাদ, 'ইসলামপন্থা' এ সমস্ত রাজনীতির চূড়ান্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯৯০ এর গণঅভ্যুথানের পর অনেকেই যখন ধরে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে, তখন সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এটি ছিল একটি বৈপ্লবিক বিষয়। 

বাংলাদেশের মত একটি অতি রক্ষণশীল মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের সরকার প্রধান একজন নারী হবেন সেটা আশির দশকেও অনেকের কাছেই ছিল কল্পনার বাইরে। তদুপরি খালেদা ছিলেন বিধবা। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সেসময় বিধবাদের অবস্থান ছিল পারিবারিক এবং সমাজিক কাঠামোর একদম প্রান্তে। সেরকম সামাজিক কাঠামতে একজন বিধবা নারীর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষতাসীন ব্যক্তি হয়ে উঠা- পরোক্ষভাবে নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 

বিধবা নারীদের সাদা শাড়ি পরার সনাতন ধর্ম সংস্কৃতি-জাত যে দীর্ঘ ট্র্যাডিশন ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি সমাজে ছিল, ক্ষমতাসীন হয়ে খালেদা নিজের জীবনে তা ভেঙ্গে ফেলেন। বিধবা নারীদের নিজেদের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে ফেলবার ক্ষেত্রে এটিও একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। সমাজ বিধবা নারীদের ক্রমান্বয়ে রঙিন কাপড়ে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। 

সমাজে নারী নেতৃত্ব বিরোধীতার যে মানসকাঠামো, সেটি গড়ে তুলতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলগুলি। খালেদা জামায়াতসহ নারী নেতৃত্বকে হারাম ঘোষণা করা, মাঠে ময়দানে নারী-নেতৃত্বের বিরুদ্ধে হুঙ্কার তোলা প্রায় সব নেতাকেই তার নেতৃত্বে রাজনীতি করতে বাধ্য করতে পেরেছিলেন। এসবের পাশাপাশি, বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ১৯৯১ সালে নির্বাচিত হয়ে আসবার পর তার রাজনীতিবিদ থেকে 'স্টেটসম্যান' হয়ে ওঠার সুযোগও সামনে চলে এসেছিল। কিন্তু তিনি সে সুযোগ কাজে লাগাননি। 

রাজনীতিতে মহেন্দ্রক্ষণ বা সুযোগ সব সময় আসে না। আর এ সুযোগ ঠিকমত কাজে লাগাতে না  পারলে রাজনীতিতে পতন অনিবার্য হয়ে যায়। প্রথম মেয়াদে পাঁচ বছর শাসন শেষে জাতি আশা করেছিল ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক  সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিবেন। কিন্তু তিনি তা না করে, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের আয়োজন করেন। ফলে, তিনিও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এরশাদের সাথে একই কাতারে নাম লেখান। 

সেই একই ভুল খালেদা আবার করে বসেন তার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবার পর ২০০৬ সালে। একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ১৯৯৬ সালের মতই প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিনকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনের উদ্যোগ নেন তিনি।  অর্থাৎ, ১৯৯৬ সালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেননি তিনি। আর এই শিক্ষা নিতে না পারার ব্যর্থতার মাশুল এখন দিতে হচ্ছে তার দলকে। এখান থেকে বিএনপি আদৌ বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

খালেদা জিয়ার ২০০১-২০০৬ শাসনকালে প্রতি বছরই বিশ্বে দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ চিহ্নিত হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশ প্রথম শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হলেও খালেদা সেখান থেকে দেশকে বের করে আনতে পারেননি। বরং ওসময় দুর্নীতির শাখা প্রশাখার আরো ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

দলীয় বুদ্ধিজীবীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে নানাভাবে এ দুর্নীতির পক্ষেই সাফাই গাইতে থাকেন। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশাপাশি পুত্র তারেক রহমানের 'হাওয়া ভবন' দলীয় রাজনীতির বিকল্প কেন্দ্র হয়ে উঠে। একই সাথে ভবনটি তখন দুর্নীতির মূল আখড়া হিসেবেও দেশবাসীর কাছে পরিচিতি লাভ করে। 

তারেক রহমানকে রাজনীতিতে নিয়ে আসবার মধ্যে দিয়ে দলে খালেদার একক নেতৃত্বের অবসান ঘটে। তারেককে কেন্দ্র করে একটি সমান্তরাল ক্ষমতা কাঠামো তৈরি হয়। এটি রাজনৈতিকভাবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা থেকে তাকে দুর্বল করে ফেলে। কেননা আওয়ামী লীগ যেখানে পরিচালিত হচ্ছিল হাসিনার একক নেতৃত্বে; সেখানে বিএনপিতে তখন অভ্যন্তরীণ ভাবে খালেদার নেতৃত্বের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে তারেকের নেতৃত্বে আরেকটি ক্ষমতা কেন্দ্রের উদ্ভব হবার ফলে। 

তারেকের নেতৃত্বে বিএনপি আরও অধিকভাবে 'ইসলামপন্থা'র দিকে ঝুঁকে পড়ে। ৯/১১ পরবর্তী বিশ্বে 'ইসলামপন্থী'দের  সাথে আঁতাত যে বিএনপির জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে এটা খালেদা হয় বুঝে উঠতে পারেননি, অথবা পারলেও সেখান থেকে দলকে বের করে আনতে পারেননি। 'ইসলামপন্থী'রাও তখন যেকোনও উপায়ে তারেক এবং বিএনপিকে ব্যবহার করে তাদের নিজেদের রাজনীতিকে অগ্রসর  করে নেবার প্রচেষ্টা নেয়। 

জামায়াত বিএনপিকে তাদের যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির আন্দোলনে কাজে লাগায়। জিয়াউর রহমান 'ইসলামপন্থী'দের রাজনীতি করবার সুযোগ করে দিলেও- বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি থাকার ফলে এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, জামায়াতের সাথে এক প্ল্যাটফর্মে রাজনীতি করা তার নিজের জন্য বিপদজনক হবে। এর বিপরীতে, 'ইসলামপন্থী'দের সাথে নিয়ে রাজনীতি করতে গেলে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব দিকে বিছিন্ন হয়ে যাবার যে ঝুঁকি রয়েছে, খালেদা সেটা বুঝে উঠতে পারেননি। 

তেমনিভাবে বুঝতে পারেননি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের হটকারী সিদ্ধান্তের ফল কী হতে পারে। ১৯৮৬ সালে নির্বচন প্রতিহত করতে না পারবার অভিজ্ঞতা থাকবার পরেও খালেদা আবার বিএনপিকে সে পথে নিয়ে যান। খালেদার অনুপস্থিতে সেই বিএনপিই ২০১৮ সালে, ২০১৪ এর তুলনায় প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে যায়। 

নির্বাচনে ১টি মহিলা আসনসহ মাত্র সাতটি আসন পাওয়া সত্ত্বেও দলটি সমর্থকদের হতাশ করে দিয়ে সংসদে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং অনেকটাই অনুগত বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বিএনপির এ ভূমিকা দলের অনেক নেতাকর্মীকেই ভয়াবহভাবে ক্ষুদ্ধ করে। 

সরকারের সাথে নানা বিষয়ে বর্তমান বিএনপির আপস, সমঝোতা আর আনুগত্যের যে ভূমিকা তা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের আর কোন প্রধান বিরোধী দলের মাঝে দেখা যায়নি। বিএনপির বর্তমান ভূমিকা যেমন জনগণের মাঝে বিস্ময় তৈরি করেছে, তেমনি জনগণ বিস্মিত হয়েছে দুই দুইবার ক্ষমতাসীন হবার পরেও খালেদার জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের রহসা উন্মোচন বা বিচারের উদ্যোগ না নেওয়ায়।  

বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক বা দলীয় বুদ্ধিজীবীদের মাঝেও এ বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখা যায় না। দলীয় বুদ্ধিজীবীরা জিয়া এবং খালেদা জিয়া সম্পর্কে মূলত স্তুতিমূলক লেখালেখিতেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এতে যে বিষয়টা বোঝা যায় সেটা হলো, হয় জিয়া হত্যাকাণ্ডের মত জটিল বিষয় নিয়ে তাদের গবেষণা করবার যোগ্যতা নেই, নতুবা তারা নিজেরাও চাচ্ছেন না বিষয়টা আলোর মুখ দেখুক।

দলীয় এবং দলীয় বৃত্তের বাইরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষকদের নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনুসন্ধানের ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটা সার্বিক ধারণা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়েছে। অপরদিকে, খালেদা জিয়ার নিজের অনাগ্রহের ফলেই জিয়া হত্যার বিষয়টি  হয়ত আর কোনদিন আলোর মুখ দেখবে না। খালেদাসহ বিএনপির সবাই, তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদের চাপে পড়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার সামরিক আদালতে জিয়া হত্যার যে সংক্ষিপ্ত গোপন বিচারের আয়োজন করে, সেটাকেই মেনে নিয়েছেন।   

খালেদা তার স্বামীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্ময়কর নীরবতা নিয়ে যেমন অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে,  তেমনি প্রশ্ন রয়েছে ১৯৭১ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তার অবস্থানকালীন সময় নিয়েও। কোন এক রহস্যময় কারণে এ বিষয়টি নিয়েও তিনি কখনো মুখ খুলেননি। তিনি তখন বন্দি ছিলেন, না স্বেচ্ছায় অবস্থান করেছেন—এ বিষয়টা নিয়ে তার পক্ষে-বিপক্ষের সমর্থকরা দ্বিধা বিভক্ত। ইতিহাসের কঠিন সত্যের মুখোমুখি হবার চেয়ে যে বয়ানটি বেছে নিলে তাদের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হবে, সেটাকেই তারা বেছে নিতে আগ্রহী।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ব্যাপক মাত্রায় স্ক্যান্ডালের জন্ম দিয়েছিলেন এরশাদ। সেরকম ব্যাপক মাত্রায় না হলেও খালেদার ব্যক্তি জীবন নিয়েও কিছুটা গুজব, গুঞ্জন ডালপালা মেলে। এসব গুজব, গুঞ্জন তার অনুসারীদের চেয়ে তার বিরোধী মতের লোকজন শুনতে এবং প্রচার করতে বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু সমাজ কাঠামোতে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ধারার শক্ত অবস্থানের কারণে কোন রকম গুজব, গুঞ্জন দ্বারা খালেদার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ধস নামানো যায়নি। 

নানান প্রতিকূল অবস্থা যার ক্যারিয়ার নস্যাৎ করতে পারেনি, সেই তিনি-ই জীবন সায়াহ্নে এসে সরকারের সাথে চরম আপসকামিতায় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগে আমরা দেখেছি বেঁচে থাকতেই রাজনৈতিক নিস্ক্রিয়তার জন্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মত রাজনীতিবিদ জনমানস থেকে সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছিলেন। খালেদার এ নিস্ক্রিয়তার কাল যত দীর্ঘ হতে থাকবে, জনমানস থেকে ততই তিনি বিস্মৃত হতে থাকবেন।

তবে, কোভিড১৯ এর তাণ্ডবকালে প্রায় নিঃসঙ্গ খালেদা যে কাজটি করতে পারেন সেটি হলো, তার কৈশোর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যাপিত ব্যক্তিক এবং রাজনৈতিক জীবনের পরম্পরা নিয়ে নিজে অথবা কোনও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে দিয়ে শ্রুতিকথনের মাধ্যমে নির্মোহ আত্মজীবনী লিখে রাখা। নিজের সম্পর্কে নির্মোহ হতে পারাটা মানব জীবনের সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজসমূহের একটি। কিন্তু জীবনের পরিণত সময়ে এসে তিনি যদি তা করতে পারেন এবং ঘটনার ঊর্ধ্বে উঠে অকপট উচ্চারণে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে যান তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির অকথিত, অজানা অধ্যায়গুলির দালিলিক প্রমাণ হিসেবে বইটি কালোত্তীর্ণ হতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ইতিহাস নিয়ে উৎসাহীদের তখন বারবার বইটির কাছে ফিরে আসতে হবে।

পাদটীকা

চলমান সময় যেহেতু সব সত্যকে ধারণ করতে পারে না, তাই খালেদা তার মৃত্যুর দশ বা বিশ বছর পরে বইটি যাতে প্রকাশ হয় এমন ব্যবস্থাও করে যেতে পারেন।