ক্ষমতার দাপট ও ধর্ষণ

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 29 Sept 2020, 09:13 AM
Updated : 29 Sept 2020, 09:13 AM

করোনাভাইরাসের পাশাপাশি নারী নির্যাতন ও ধর্ষণও যেন বাংলাদেশে মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন কোনও দিন নেই যেদিন সংবাদপত্রে ৪-৫টি ধর্ষণের ঘটনার খবর প্রকাশিত হচ্ছে না। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, গত অগাস্ট মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৪৯ জন নারী ও শিশু। এরমধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩২ জন। বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনার খবরই কিন্তু সংবাদপত্রে আসে না। সামাজিক মর্যাদাহানিসহ বিভিন্ন কারণে ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া হয়। আর সংবাদপত্রে যেসব ঘটনা প্রকাশিত হয়, তাও এখানে সীমাবদ্ধ থাকে। হয়তো বড়জোর মামলা হয়। কিন্তু এসব মামলার নিষ্পত্তি হয় খুবই কম। আর বিচার, সাজা? এমন রেকর্ড খুবই কম!

ধর্ষণ ঘৃণ্য অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অথচ আমাদের দেশে এই ঘৃণ্য অপরাধটাই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই, নেই আইন কার্যকর করার কোনও বিশেষ ব্যবস্থা। ক্ষমতার দাপট, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিচার প্রক্রিয়া নারীবান্ধব করতে না পারাসহ সামাজিক-রাজনৈতিক উদাসীনতার সুযোগে ধর্ষকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ এই ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর আগে খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে ঘরে ঢুকে প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, নারীরা স্বামীর সঙ্গে থাকলেও নিরাপদ নয়, এমনকি ঘরে থাকলেও নয়। নারী আজ ছাত্রলীগ, অচেনা দুর্বৃত্ত, এমনকি পুলিশের কারণেও নিরাপত্তাহীন!

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে, অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে, সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে যাদের রুখে দাঁড়ানোর কথা, প্রতিবাদ করার কথা, ক্ষমতাসীন দলের সেই নেতাকর্মীরাই এই ধর্ষণের মচ্ছবে তাল মেলাচ্ছেন। নিজেরাই ধর্ষক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ ক্যাম্পাসে ধর্ষণ বা দলগত ধর্ষণের ঘটনা গত তিন দশক ধরেই ঘটছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে। তারা এতটাই বেপরোয়া থাকে যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে—এমনটি তারা মনে করে না। তাইতো তারা স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের দুঃসাহস দেখায়। ১৯৯৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে দলগত ধর্ষণ করে ছাত্রদল নেতা সীমান্ত, মিতুল ও জাপানসহ কয়েকজন। পরিসংখ্যান বিভাগের সামনের জঙ্গলের মধ্যে তারা গণধর্ষণ করে। ঘটনার পর তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান এবং ছাত্রীর বাবাকে ডেকে 'সমঝোতা' করে দেন। এ ঘটনায় ওই ছাত্রী ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান; আর কোনো দিন তিনি ক্যাম্পাসে ফেরেননি। এমনকি ছাত্রীর বাবাও কাঁদতে কাঁদতে ক্যাম্পাস চত্বর ছাড়েন। এই ঘটনার পর ১৯৯৫ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে অর্থনীতি বিভাগের সামনে থেকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে আগে অভিযুক্ত ছাত্রদল নেতা সীমান্ত। এই ঘটনায়ও সীমান্তের কোনো বিচার হয়নি।

১৯৯৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনায় দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরির স্বঘোষিত ঘোষণায় সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই মানিক বিএনপি আমলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সেসময় প্রায় ছয় মাস বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে মানিক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর আর মানিককে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এরপর ২০০০ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাঁধন নামে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করা হয়। তখনও ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে তাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে। এরপর থেকেই থার্টি ফার্স্ট নাইটে ছাত্রীদের হলের বাইরে আসা বন্ধ করা হয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও কোনো তরুণীকে থার্টি ফার্স্টের কর্সূচিতে অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

২০১৭ সালে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি এইচ এম জাহিদ মাহমুদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন ছাত্রলীগ নেত্রী ফাতেমাতুজ জোহরা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই ছাত্রী জাহিদ ছাড়াও মুজিবুর রহমান অনিকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন।

যার ক্ষমতা আছে সে এক ধরনের বিচারহীনতার সুবিধা ভোগ করে৷ সেই সুবিধা তাকে নানা অপকর্মে প্ররোচিত করে৷ এর মধ্যে ধর্ষণ একটি৷ এর জন্য বর্তমান অবক্ষয়গ্রস্ত দলীয় রাজনীতি সবচেয়ে বেশি দায়ী। ক্ষমতার সুবিধা নিতে দলে দুর্বৃত্ত-অপরাধীরা নেতৃত্বের আসন পর্যন্ত বাগিয়ে নেয়। যখনই কারো অপরাধের খবর ফাঁস হয়ে হয়ে যায়, তখন বলা হয়, সে আসলে আমাদের দলের কেউ নয় অথবা অনুপ্রবেশকারী। এটা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব। ক্ষমতায় থাকা একটা দলের কেউ যখন খুন-ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে, তারপরও দল লজ্জিত হয় না। কোনো অনুতাপও দেখা যায় না। দলে যেন এ ধরনের দুর্বৃত্তরা স্থান না পায়, সে ব্যাপারে সতর্কতা ও কঠোর অঙ্গীকারও দেখা যায় না। আসলে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই পচে গেছে। যে রাজনীতি মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, মানুষের পাশে থাকবে— তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন দুর্বৃত্ত হয়ে উঠছে, খুন-ধর্ষণ-চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করছে। আসলে পুরো রাজনীতিই বর্তমানে দুর্বৃত্তকবলিত হয়ে পড়েছে। অপরাধীদের প্ল্যাটফরম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। যেকারণে মাদক ব্যবসা, অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অর্থপাচার, খুন, রাহাজানির অভিযোগে তারা গ্রেফতার হন, ধর্ষণের ঘটনায় আসামি হন। আজ আদর্শিক চর্চা নেই বলেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত দুর্বৃত্তরা একের পর এক ধর্ষণ ঘটাচ্ছে।

আর আমাদের জাতীয় নেতারা পরম যত্নে এই দুর্বৃত্ত উৎপাদনের কারখানটাকে চালু রেখেছেন। নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য যেখানে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার কথা, সেখানে তারা এই কাজটি না করে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন, তাদের অপরাধ মুছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন। প্রখ্যাত ইয়াবা ব্যবসায়ী হন সেলিব্রিটি নেতা, জাহাঁবাজ মাফিয়া গডফাদাররা পর্যন্ত বড় কোনো অপরাধ না ঘটালে দলের সদস্যপদও হারান না। এমনকি ধরা পড়লেও আইন-আদালত-প্রশাসন তাদের পক্ষেই ভূমিকা পালন করে। এই দুর্বৃত্তরাই রাজনৈতিক দলের হাত ধরে সাদা পাঞ্জাবি পরে একদিন জনপ্রতিনিধি হয়ে যান। সব বড় রাজনৈতিক অপরাধীর প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে এমন অনেক লুকানো অপরাধের গল্প, নষ্ট রাজনীতির পাপ!

যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করার কোনও সুযোগ নেই। ধর্ষণের ফলে শুধু একটি নারীই ধর্ষিত হয় না, ধর্ষিত হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র সমাজ। কারণ, ধর্ষণ মানবতার অপমান। পুরো সভ্যতার জন্যই মানহানিকার। খুনের ক্ষমা আছে, ধর্ষণের নেই৷‌ অপরাধ স্বীকার করলে খুনিকে ক্ষমা করা যেতে পারে৷‌ তার সংশোধনের সুযোগও গ্রাহ্য৷‌ ধর্ষণকারীর বেলায় সেটা খাটে না৷‌ কঠোরতম শাস্তি তাকে পেতে হবে৷‌ দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন এ কথাই ঘোষণা করেছে৷‌

কী করলে ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়? সে আলোচনার গোড়াতেই ঝাড়ু-বোলানো কথাগুলো বাদ দেওয়া দরকার। 'সমাজ না বদলালে অবস্থা বদলাবে না' আর 'কোনও দিন ধর্ষণ কমবে না' এ দু'টো একই কথা। দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট বলেছিলেন, হাড়-শয়তানদের সমাজেও সুশাসন সম্ভব। এই সমাজেও ধর্ষণ কমানো যাবে, যদি যথাযথ বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। আর তা করতে চাইলে ভাবতে হবে, কেন ধর্ষণের ঘটনাগুলোর দ্রুত বিচার হয় না।

আমাদের থানা, পুলিশ, আইন, তদন্ত, বিচারপ্রক্রিয়া কোনো কিছুই নারীর প্রতি সংবেদনশীল নয়। বরং তা অনেকটাই ধর্ষকবান্ধব। প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগী নারীকেই ধর্ষণ-প্রমাণের যাবতীয় দায় বহন করতে হয়। ভুক্তভোগীর প্রতি অশালীন মন্তব্য, সাক্ষ্য সংগ্রহে গাফিলতি, তদন্তে দেরি, প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে অথবা ভুক্তভোগীর কাছে টাকা না পেয়ে মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল ইত্যাদি নানা অসংগতি রয়েছে। বিচার পাওয়ার গোটা প্রক্রিয়াটিই এমন জটিল করে রাখা হয়েছে যাতে মেয়েটি ভয় পেয়ে, হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। এসব নিয়ে গত তিন দশক ধরে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে, অনেক সুপারিশ-বিধি-পদ্ধতি জারি করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ তাতে কমেনি। ধর্ষকের শাস্তিও নিশ্চিত করা যায়নি।

আমরা চাই অবিলম্বে ধর্ষণের মহামারী বন্ধ হোক। সরকারের প্রথম এবং প্রধান এজেন্ডা হোক দেশ থেকে ধর্ষণ বন্ধ করা। এ জন্য সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ঘোষণা করতে হবে। স্বামী, ভাই, বাবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কিংবা ঘরে ঢুকে নারীকে দলগতভাবে ধর্ষণ করা হবে, আর সরকার বসে বসে আঙুল চুষবে, তা হতে পারে না, হতে দেয়া যায় না।