প্যান্ডোরার বাক্স হাতে একজন জলি তালুকদার

Published : 23 Sept 2020, 07:23 AM
Updated : 23 Sept 2020, 07:23 AM

সিপিবির কেন্দ্রিয় কমিটির সম্পাদক জলি তালুকদার অনশন ভেঙ্গেছেন। অবশেষে কেন্দ্রিয় কমিটির সভাপতি, যিনি প্রথমে জলি তালুকদারের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলেছিলেন, তিনিসহ অন্যান্য নেতারা আগামী প্রেসিডিয়াম সভায় তার আবেদন আমলে নেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।  

শুধু এই প্রতিশ্রুতিটুকু আদায় করতে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, সংগ্রামী এবং সিনিয়র একজন নেত্রীকে অনশন পর্যন্ত হাঁটতে হয়েছে। তার মুখের কথা কেউ আমলে নেয় নাই। উল্টা দলীয় মিছিলে অভিযুক্ত জাহিদ হোসেনের হয়রানিমূলক আচরণের প্রতিবাদ করার শান্তিনগর শাখার সম্পাদককে শোকজ করেছে দলটি। শুধু তাই নয়, জলি তালুকদার কেন অনশন করে তার হয়রানির কথা জানান দিলেন, কেন তিনি দলের ইমেজের কথা ভাবলেন না, কেন নিজেদের মধ্যে গোপনে মিটিয়ে নিলেন না, সেটা নিয়েও অনেক নেতা-কর্মীকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। অনেকে ভিকটিম ব্লেইমিং করেছেন, জলি তালুকদারকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করেছেন। সমতার আদর্শ নিয়ে কথা বলা একটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের এহেন মনোভাব বিস্ময়কর হলেও অপ্রত্যাশিত নয় মোটেও।

আজ সিপিবির এ চরিত্র উন্মোচিত হলো বলে, অন্য রাজনৈতিক শিবিরের লোকজনের আনন্দিত হওয়ার কিছু নাই। সবজায়গাতেই কমবেশি একই অবস্থা। খোঁজ নিলে 'ঠগ বাছতে গা উজার' হবে। রাজনীতি নারীর জন্য সহজ জায়গা নয়। রাজনীতি মূলত পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী। জানি, আমাদের একজন নারী প্রধানমন্ত্রী আছেন, নারী স্পিকার আছেন, নারী মন্ত্রী আছেন। কিন্তু তাতে নারীর জন্য রাজনীতি সহজ হয়ে যায়নি। সার্বিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীরা আসলেই কোথায় আছেন? কতোটুকু স্বাধীন ও মুক্তভাবে তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন? নারী হিসেবে কতোটা নির্ভয় ও নিপীড়ন মুক্ত তারা? এতোদিন ধারণা ছিল, অন্তত বাম দলগুলোতে নারীরা স্বস্তিতে আছেন, নিরাপদে আছেন। কিন্তু জলি তালুকদার সেই প্যান্ডোরার বাক্সটা খুলে দিলেন।

সমতার আদর্শে সম্পদের বণ্টন যতোটা মুখ্য, জেন্ডার সমতা ততোটা নয়। তাই বাম দলগুলোও শেষপর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিকই। নারী সহকর্মীকে 'সেক্স অবজেক্ট' হিসেবে না দেখা, নারী কর্মীর হয়রানির অভিযোগকে আমলে নেওয়ার চর্চাও তাই অনুপস্থিত। সিপিবির একজন সিনিয়র নেত্রীকেই যদি যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে দিতে এতো কাঠখড় পোড়াতে হতে হয়, তবে অন্যন্য জুনিয়র নারী কর্মীদের কী অবস্থা সহজেই অনুমেয়। 

বামদলগুলোতে নারী কর্মীর সংখ্যা কতো? আর কমিটিগুলোতেই বা কতোজন নারী পদ-পদবী পান? উত্তরটা আমাদের জানাই, হাতে গোনা কয়েকজন। তারচেয়ে ডান, বুর্জোয়া দলগুলোতে বরং নারী নেতা-কর্মীর সংখ্যা বেশি। তাদের গুণগত মান বা যোগ্যতা নিয়ে কথা থাকতে পারে, কিন্তু মেইল ডমিনেটেড এই সমাজে সংখ্যাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে যাই হোক,  কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যে তেজোদ্দীপ্ত,  ধারালো  মেয়েদের বাম মিছিলে দেখা যায় শ্লোগানে ক্যাম্পাস মুখরিত করতে, তাদের পরবর্তীতে আর কেন্দ্রিয়  রাজনীতিতে সচরাচর পাওয়া যায় না কেন? তারা কি নিজেরাই সরে যায়, নাকি শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে সরে যেতে বাধ্য হয়? 

বামদলগুলোতে যৌনহয়রানির ঘটনা নতুন নয়, এই সত্যটা উন্মোচনের সুযোগ করে দিলেন জলি তালুকদার। বহুদিন ধরেই নারী কর্মীদের ভিতরে এই অভিযোগটা ছিল। অনেকেই ভুক্তভোগী। কিন্তু দলীয় ইমেজের কথা ভেবে হয় নিজেই চুপ করে সরে গেছেন, নয়তো চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসবই জানা গেল জলি তালুকদারের সাথে সংহতি জানানো অনেক প্রাক্তন ও বর্তমান নারী কর্মীর লেখা থেকে। এতোদিন প্রকাশ করতে চাইতেন অনেকেই, শুধু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মানুষের অভাব ছিল। জলি তালুকদার সেই কাজটিই করলেন। 

ডান, বাম নির্বিশেষ, সকল রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব যৌন নিপীড়ন-বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। এবং সেই নীতিমালা তৈরির কাজটিতেও নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।  যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোতে নারী কর্মীদের 'সেক্স অবজেক্ট' হিসেবে দেখা বন্ধ না হবে, নারী কর্মীদের যৌন হয়রানি বন্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতির চর্চা না হবে, রাজনীতির চোখে জেন্ডার লেন্স না উঠবে, ততোদিন সমতার আদর্শ, সমতার স্বপ্ন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। বামদলগুলো ভেবে দেখবেন আশা করি।