স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেন টাকার খনি

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 22 Sept 2020, 11:53 AM
Updated : 22 Sept 2020, 11:53 AM

আমাদের অফিসের কাজ করে ছেলেটি। বয়স ১৫/১৬ হবে হয়ত। চেহারাটা খুব মায়া মায়া। অধিকাংশ সময় ওর নাম ধরে ডাকতে পারি না। নাম মনে থাকে না। আমি ডাকি বাবা বলে। প্রয়োজন হলে বলি, চা খাওয়াতে পারবি বাবা? পানি খাওয়াতে পারবি বাবা? আগে ছিল দুজন, নাম মনে থাকে না বলে টেবিল ক্যালেন্ডারে লিখে রেখেছিলাম। কিন্তু মুশকিল হল কার নাম কোনটি তা গুলিয়ে ফেলতাম। আমার চাহিদা কম। যতদূর সম্ভব নিজের কাজ নিজেই করার চেষ্টা করি। তাই মাঝে মধ্যে কিছু একটা বললে বিপুল আগ্রহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাচ্চা ছেলে, খুব সরল সোজা কথা বলে, ভালো লাগে আমার।

সে ছেলেটি গতকাল একটি ছবি দেখিয়ে বলল, দেখেন স্যার কী সুন্দর নূরানী চেহারা! দেখলে মনে হয় পায়ে ধইরা সালাম করি। আমি ছবিটি সামান্য লক্ষ করে বললাম, ঠিক তো বলেছিস, সুন্দর বাবা বাবা চেহারা। ছেলেটি বলল, কী চাকরি করে জানেন স্যার? গাড়ির ড্রাইভার।

বললাম, তাতে কী! ড্রাইভার হলে কি সুন্দর, নূরানী, বাবা বাবা চেহারা হইতে পারে না? কম্পিউটারে কাজ করতে করতেই উত্তর দিচ্ছি আমি।

একটি সংবাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছেলেটি বলল, এই ড্রাইভারের ঢাকায় তিনটা বাড়ি আছে স্যার। পড়ছেন নিউজটা? আমি ততক্ষণে অনলাইনে নিউজটি পড়তে শুরু করেছি- 'স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেকের ঢাকায় বাড়ি আছে তিনটি'। আমার ভেতর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি সংবাদটি পড়ে। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির কথা শুনতে শুনতে বিষয়টি এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। রোববার বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া এবং তার পরদিন দেশের সব পত্রিকায় আব্দুল মালেকের ছবিসহ সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, 'পেশায় আবদুল মালেক গাড়িচালক। চাকরি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢাকায় তার দুটি সাততলা ভবন, নির্মাণাধীন একটি দশ তলা ভবন, জমি, গরুর খামার খুঁজে পেয়েছে।' তারা বলছে, 'এখনো এই খোঁজ শেষ হয়নি।' র‍্যাব-১ রোববার আবদুল মালেককে তুরাগের বামনারটেক এলাকার একটি সাততলা ভবন থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ জাল বাংলাদেশি টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল উদ্ধার হয় বলে দাবি তাদের। ( আবদুল মালেক বিদেশি পিস্তল কেন রাখতে যাবে তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। ঠিক আছে পিস্তল থাকলে ম্যাগাজিন থাকবে, কিছু গুলিও থাকবে স্বাভাবিক কিন্তু জাল টাকাও কেন থাকবে বুঝলাম না। সে কি জাল টাকার ব্যবসাও করে? সে প্রসঙ্গে অবশ্য সংবাদে কিছু বলা হয়নি। যাক সে প্রসঙ্গ) তার পরিচয় দিতে গিয়ে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, 'আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের একজন গাড়িচালক ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। অষ্টম শ্রেণি পাস আবদুল মালেক ১৯৮২ সালে প্রথম সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। বছর চারেক পর অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে যোগ দেন। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক ছিলেন। ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।' (কিসের ভয় দেখাতেন সে প্রসঙ্গেও কিছু ব্যাখ্যা দেননি র‍্যাব কর্মকর্তা)।

আবদুল মালেক কত সম্পদের মালিক জানতে চাইলে র‍্যাব সূত্রগুলো বলছে, 'তার (আবদুল মালেক) স্ত্রী দুজন। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ এলাকার দক্ষিণ বামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তরপাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাত তলার দুটো আবাসিক ভবন আছে। নাম হাজী কমপ্লেক্স। এতে ফ্ল্যাট সংখ্যা ২৪টি। ওই ভবনের সামনে আছে ১০-১২ কাঠার আরেকটি প্লট। ভবনের তৃতীয় তলায় তিনি সপরিবারে থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। বড় মেয়ে 'বেবি'র নামে দক্ষিণ কামারপাড়ার ৭০ রাজাবাড়ি হোল্ডিং-এ ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ইমন ডেইরি ফার্ম নামে একটি গরুর ফার্ম আছে। এতে ৫০টি বাছুরসহ গাভি আছে। এর বাইরে ২৩, ফ্রি স্কুল রোড, হাতিরপুলে পৈতৃক সাড়ে চার কাঠা জায়গার ওপর দশতলা নির্মাণাধীন ভবন আছে। ভাই আবদুল খালেকের সঙ্গে বিরোধের কারণে ভবনটির নির্মাণকাজ আদালতের নির্দেশে বন্ধ আছে।'

সংবাদ সূত্র বলছে, অধিদপ্তরের এই গাড়িচালক কাগজে-কলমে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়ি চালক। যদিও মহাপরিচালক নিজে অন্য একটি গাড়িতে চড়েন এবং এর চালকও আলাদা। এরপরের তথ্যটুকু পড়ে মনে হবে আমরা সত্যি যেন মগের মুল্লুকে বাস করছি। পড়ুন, এই আবদুল মালেক মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দ হওয়া একটি পাজেরো জিপসহ তিনটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। অধিদপ্তরের একটি পিকআপ তার খামারের দুধ বিক্রি এবং মেয়ে জামাইয়ের ক্যানটিনে মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ব্যবহারের জন্য ব্যবহার করেন একটি মাইক্রোবাস।'

বাহ! কী রাজকীয় হালচাল! ফেসবুকে আবদুল মালেকের বাড়ির দরজার ছবি ভাইরাল হয়েছে। রাজদরবারের মতো সে দরজা। (আসলে এরচেয়েও জাঁকজমকপূর্ণ দরজা দেশের ধনীদের বাড়িতে আছে। মালেকের দরজা নিয়ে বেশি বিস্মিত হলে ওরা আমাকে বলবে, 'ফকিন্নির পুত এর চাইতে দামি দরজা তো তুই চোক্ষে দেখস নাই') ভাইরাল হয়েছে এমনকি তার বাথরুমের কমোডের ছবিও। দামি লাল রঙের কমোডের ছবি পোস্ট করে অনেকে লিখেছেন, 'কালো টাকায় লাল কমোড'।

এসব ভাবা যায়? এটা কীভাবে সম্ভব করলেন আবদুল মালেক তা ভেবে যখন আমি নিজেই অবাক হচ্ছি সে সময় ছেলেটি অবাক হওয়া চোখে জানত চাইল, স্যার, এক শ হাজারে এক লাখ টেকা হয়? কত টেকায় এক কোটি টেকা হয়?

বললাম, এক শ লাখে…

এ ক শ লা খে! টেনে টেনে উচ্চারণ করল ছেলেটি।

এত সম্পদের মালিক কি করে হলেন গাড়িচালক? জানতে চাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, তিনি বরাবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্য পেয়েছেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী রাবেয়া খাতুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইব্রেরিতে কাজ করেন। আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ড্রাইভারস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজেই সংগঠনের সভাপতি পদে বসেছেন। গাড়িচালকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি তার নিয়ন্ত্রণে। চিকিৎসকদের বদলি ও পদোন্নতি এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগে তার হাত আছে বলে অভিযোগ আছে। এক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেই তিনি তার পরিবারের সাতজনকে চাকরি দিয়েছেন।

তদন্তে কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্যে এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন আবদুল মালেক। তারা ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনে কর্মরত একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল তার। টাকার বিনিময়ে কয়েকজন সাংবাদিককেও হাত করেছিলেন আবদুল মালেক। ২০০৯-১০ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে শতাধিক লোককে নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে হাত আছে মালেকের বলে জেনেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কেরানি আবজালের ধনসম্পদ নিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হওয়ায় দুদক মামলা করেছিল তার নামে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৭ জুন পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। একটি মামলায় অবৈধভাবে অর্জিত ২৬৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং আরেকটি মামলায় আবজালের বিরুদ্ধে ২০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়। গত বছর জানুয়ারিতে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদসহ আইনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার একপর্যায়ে পালিয়ে যান আবজাল দম্পতি।

২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের সম্পদ জব্দ (ফ্রিজ) করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আদালতের আদেশে আবজাল দম্পতির স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পদ হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়।

আবজালের স্থায়ী নিবাস ফরিদপুরে। ফরিদপুর শহরের সোহরাওয়ার্দী সরোবরের পূর্ব পাশে সাড়ে ১০ শতাংশ জমির ওপর আবজালের একটি দোতলা বাড়ি আছে। আবজাল ফরিদপুরে আধুনিক নকশায় তৈরি ওই বাড়িতেই থাকতেন। ওই বাড়িতে এলে ফরিদপুরের প্রভাবশালী লোকজনের সম্মানে ভোজেরও আয়োজন করতেন তিনি।

টাকার খনি আছে না কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তা নিয়ে আমি বড় ফাঁপরে পড়ে যাই। কেরানি, ড্রাইভাররা যদি এত বিপুল সম্পদের মালিক হতে পারেন তাহলে বড় কর্তারা কী করেছেন তা সহজে অনুমেয়। তবে সবাই যে টাকার পাহাড় গড়তে পেরেছেন তা কিন্তু নয়। সমস্যা হয় এ ধরনের লোকদের যাদের চোখের সামনে লুটপাট হতে দেখেও নিজে তাতে সম্পৃক্ত হতে পারেন না, প্রতিহতও করতে পারেন না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার শপথ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নিজস্ব উদ্যোগেই 'শুদ্ধাচার' ও এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'আমরা দেশে একটি ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই এবং আপনাদেরকেই এই শুদ্ধাচারের পরিকল্পনা করতে হবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে। এই পরিকল্পনা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছাতে ও তা সফলভাবে কার্যকর করতে হবে। 'আর যারাই এটা করতে পারবে, তাদের পুরস্কৃত করা হবে।' গত বৃহস্পতিবার 'অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্ট (এপিএ)-২০২০' স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার পিতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১২ সালে শুদ্ধাচার কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছিলেন। তার লক্ষ্য কতটুকু সফল হয়েছে বা হবে তা সময় বলে দেবে। তবে এমন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি জাতিকে তিনি অনেকটা একা কতটুকু টেনে তুলতে পারবেন তা জানি না। কারণ জাতির পিতার সে আক্ষেপ তো আমরা ভুলিনি, ' মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।'

এর মধ্যে চোরের সংখ্যা কি কমেছে দেশে?