রাজনৈতিক কড়চায় আল্লামা শফী

পুলক ঘটকপুলক ঘটক
Published : 30 Jan 2012, 08:31 AM
Updated : 23 Sept 2020, 07:40 AM

আল্লামা আহমদ শফীর পদত্যাগ সংক্রান্ত নিউজ করার জন্য তার দীর্ঘকালীন ছাত্র, সহকর্মী, অনুসারী ও সংগঠকদের টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করে একে একে কথা বলছিলাম। দুপুর একটার দিকে একজন বলল, "পদত্যাগের নিউজ করবেন, না ইন্তেকালের সংবাদ দিবেন? অবস্থা ভাল নয়, মনে হয় টিকবে না।" সন্ধ্যায় শেষপর্যন্ত মৃত্যু সংবাদই লিখতে হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর আগে তাকে হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসার মুহতারিম পদ থেকে অপসারণের জন্য তার অনুসারীরা যা করেছেন তা মর্মান্তিক।

মৃত্যুর আগের দিন মধ্যরাত ১টা পর্যন্ত প্রায় সম্বিতহীন একজন শতবর্ষী মানুষকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে নানাভাবে চাপাচাপি এবং অপদস্ত করা হচ্ছিল। বিষয়টি আমাকে অনেকেই বলেছেন। কিন্তু সময় তখন এমন যে, তারা দালাল হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়েই হোক অথবা জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীদের কাছে বিরাগভাজন হওয়ার ভয়েই হোক, মিডিয়ায় নাম প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছিলেন না। এমনই অবস্থা! আমি যে আমেরিকান মিডিয়ায় কাজ করি সেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে সংবাদ পরিবেশনের সময় কোনো বেনামি সোর্স থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই প্রতিবেদনে বিবিসি-র রেফারেন্স দিয়েছিলাম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আল্লামা শফীর পক্ষের একজন শিক্ষককে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা বলেছে, "শতবর্ষী আহমদ শফী খুবই অসুস্থ ছিলেন এবং তার কোন কিছু চিন্তা করার বা বোঝার মত পরিস্থিতি ছিল না। একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষকে বিক্ষোভের মুখে জোর করে বৈঠকে রেখে একতরফা সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।" রাত ১টার পর মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির বৈঠক শেষ হলে শাহ শফীকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

প্রশ্ন হল, হাটহাজারীতে দেশের বৃহত্তম ওই কওমি মাদ্রাসায় ছাত্রদের স্বার্থবিরোধী নতুন কি ঘটেছে যার জন্য তারা এতবড় বিক্ষোভ গড়ে তুললেন? দেশের মাদ্রাসাগুলোতে এই ধরনের ছাত্র বিক্ষোভের অতীত ইতিহাস নেই। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, যিনি তাদের 'বড় হুজুর'– যিনি কওমি মাদ্রাসার ইতিহাসে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন। যার তৎপরতায় মাত্র ১৮/১৯ বছর বয়সে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পাশের সমমান স্বীকৃতি পেয়েছেন। হাটহাজারীর ওই মাদ্রাসার জন্য রেলের জমি বরাদ্দসহ বহুবহু সুবিধা তিনি শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। তার দাবিতে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের ইসলামীকরণসহ কি-না করেছে সরকার! যেসব কারণে আমরা আওয়ামী লীগকে আদর্শচ্যুত বলে সমালোচনা করি। কিন্তু যাদের জন্য সরকার এসব করেছে, তারা কি কৃতজ্ঞ? 'কওমি জননী'-র মৃত্যুর পর তারা হয়তো একবার হলেও তার অবদান কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে, কিন্তু তার জীবদ্দশায় নয়। এখানেই রাজনীতি। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে 'ভেঙে ফেলা'-র জন্য যে দলের প্রতি তারা মর্মে মর্মে ক্ষুব্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক লিগ্যাসি যে দলের সঙ্গে মিশে আছে, যে দলকে তারা ভারতের দালাল হিসেবে আখ্যা দেয়, সেই দলের নেত্রীর কাছে তারা সুযোগ সুবিধা নিতে পারে– কিন্তু তা স্বীকার করতে তাদের মন কখনো সায় দেবে না।

আমরা বারবার বলেছি, হেফাজতের সঙ্গে ঐক্য করা শুধু 'অনৈতিক' নয়, এটা আওয়ামী লীগের ভুল পলিসি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বার্থে আপাত সুবিধাকেই বড় বিবেচনা করেছে, যদিও শেষ বিচারে লাভ হয়নি। শেখ হাসিনাকে 'কওমি জননী' অভিধা দিয়ে শফী হুজুর তার লোকজনের কাছে সমর্থন হারিয়েছেন। তিনি তার লোকজনকে শেখ হাসিনার সমর্থক বানাতে পারেননি, এটা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগকে হেফাজত হতে হবে, হেফাজত কখনো আওয়ামী লীগ হবে না। আবারও 'আওয়ামী মুসলিম লীগে' ফিরে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য মুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু মুসলিম লীগের আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠা শতবর্ষেও সফল হয় না।

হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসায় শফী হুজুর এবং তার পুত্র মাওলানা আনাস মাদানীকে সরানোর জন্য ছাত্ররা যে বিক্ষোভ করেছে, তা সেই মৌলিক রাজনীতির জায়গা থেকেই হয়েছে। নইলে মাদ্রাসার কর্তৃত্ব নিয়ে ম্যানেজমেন্ট লেভেলে যে বিরোধ তাতে ছাত্রদের এত বিপুলভাবে যুক্ত হওয়ার কারণ নেই। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংস্কৃতিতে সরকারের সঙ্গে যার সম্পর্ক ভাল, যিনি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার জন্য সুযোগ সুবিধা এনে দিতে পারেন প্রতিষ্ঠানে তিনিই কর্তৃত্ব করেন। মাওলানা আনাস মাদানী সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে অনেক সুবিধা এনে দিয়েছেন এবং এনে দিতে পারেন। উপরন্তু তিনি আল্লামা শফীর পুত্র। সব বিবেচনায় তার কর্তৃত্ব মেনে নিতে ওই মাদ্রাসায় সংশ্লিষ্টদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কথা একটাই, "বড় হুজুর এবং তার পুত্রের আওয়ামী লীগের সঙ্গে মাখামাখি বেশি। এটা ভাল লাগে না।" তাদের সম্পর্কটা যদি বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে হতো, তাহলে তাদের অসন্মানিতভাবে বিদায় করার তৎপরতা দেখতে হতো না। জীবনের শতবর্ষ পেরিয়ে নিজের শিষ্যদের কাছেই এতটা হতমর্যাদা হয়ে শেষবিদায়ে ঢলে পড়তে হতো না মওলানা শফীকে।

'ইসলামী চিন্তাবিদ' হিসেবে পরিচিত শাহ আহমদ শফী মনে করতেন মেয়েদের ক্লাস থ্রি-ফোরের বেশি পড়ানোর দরকার নেই। হলি আর্টিজানে বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য দেখিনি। তবে চাপাতিবাহিনীর একের পর এক হামলার সময় তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, "ব্লগারদের হত্যা করা ওয়াজিব।" সঙ্গত কারণেই তার এবং তার অনুসারীদের সঙ্গে চিন্তাশীল প্রগতিশীল মানুষের লড়াই অনিবার্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ শফীকেই আদর্শ মনে করেন। তাদের কাছে পেতে বিএনপি, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি সবসময় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে। আওয়ামী লীগও তাদের হারাতে চাইবে বলে মনে হয় না। বহুমাত্রিক টানাটানিতে হেফাজত ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু তালেবানী চিন্তাধারা ম্রিয়মান হবে না। বৃহত্তর তালেবানি প্লাটফর্ম গড়ে ওঠাও অসম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের ভবিষ্যত গন্তব্য অনিশ্চিত।