প্রণব মুখার্জি: বাংলাদেশের বন্ধু, ভারতীয় রাজনীতির ‘চাণক্য’

অনিমেষ চক্রবর্তী
Published : 20 Sept 2020, 01:36 PM
Updated : 20 Sept 2020, 01:36 PM

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে যতজন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রণব মুখার্জির সঙ্গেই যে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ইতিহাস, রাষ্ট্র বিজ্ঞান আর আইনে মাস্টার্স শেষ করে কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে তুলে এনেছিলেন রাজনীতির শীর্ষে, হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। যখন খুব অসুবিধায় পড়েছেন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নিজে দল করার চেষ্টা করলেন, আবার ফিরলেন। সেই খারাপ সময় কাটাতে পেরেছেন তার মেধা চেনাজানা আর প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে। ভারতীয় রাজনীতিতে এতটাই গুরুত্ব ছিল তার সেজন্য কেউ তাকে আলাদা করতে পারেনি। বেশিদিন কেউ তাকে চেপে ধরে রাখতে পারেনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। পরে পাঁচ দশকের রাজনীতির পথ পরিক্রমায় ২০১২ সালে হয়েছিলেন ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি। তবে মেয়াদ শেষে অবসরের পর আর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াননি তিনি। প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি হওয়া পর্যন্ত জীবন উত্থান-পতন ও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। কংগ্রেস যখন ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে ওই সময় থেকে প্রণববাবু ছিলেন রাজনৈতিক পরিপক্বতার তুঙ্গে। তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। সবাইকে নিয়ে রাজনীতির চেষ্টা করেছিলেন বলে তাকে ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য নামে অভিহিত করা হয়। যে কোনও সংকটময় মূহূর্ত উত্তরণে তার তৎপরতায় বারংবার ঋদ্ধ হয়েছে ভারতের রাজনীতি। কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়েই তিনি ভারতের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো এমনকি বিজেপি নেতাদেরও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। প্রণব মুখার্জি হচ্ছেন একমাত্র ভারতীয় বাঙালি যিনি সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ছাপ রেখেছিলেন।

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে প্রয়াত প্রণব মুখার্জির হৃদ্যতা প্রায় চার দশকেরও বেশি। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণববাবুর প্রথম বিদেশ সফরও ছিল বাংলাদেশে। এমনকি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যাবতীয় প্রোটোকল ভেঙে তাকে রাষ্ট্রপতি ভবনেই আতিথ্য দিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা-মন্ত্রী এমনকি অনেক সাধারণ পেশাজীবীরাও যখনই দিল্লিতে গিয়েছেন, একবার নিয়ম করে রাষ্ট্রপতি ভবনে ঘুরে যেতে ভোলেননি। আইয়ুব বাচ্চুর ব্যান্ড এলআরবি এবং চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদকেও রাষ্ট্রপতি ভবনে সসম্মানে আতিথেয়তা দিয়েছেন প্রণব মুখার্জি। এমন আরও অজস্র উদাহরণ রয়েছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক সিরিজের তৃতীয় খণ্ড 'দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস' ভারতের সীমা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলেরও মনোযোগ কেড়েছে। এর আগে তিনি লিখেছেন 'দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস' ও 'দ্য টারবুলেন্ট ইয়ারস'। তিনটি বইয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ইন্দিরা গান্ধী পরিবার এবং ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশের সাথে প্রণব মুখার্জির বন্ধুত্বের সূচনা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে। তার আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস–এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন 'মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ' নামে। অধ্যায়টি তিনি শুরু করেছেন ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ অগাস্ট পাকিস্তান ও ভারত ডমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। এরপর পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, 'ভারতে যখন এসব ঘটছিল, তখন পাকিস্তানের পূর্বাংশে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ ঘটনাই ১৯৭১ সালে উপমহাদেশের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাকিস্তানের জন্য বছরের শুরুটা ইতিবাচক হলেও বছরের শেষে দেশটি ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল দুটি পৃথক ভৌগোলিক অংশের সমন্বয়ে, যার মাঝখানে ছিল ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামে তারা দুটি দেশে পরিণত হয়'। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে বাঙালির উপর চালানো নির্যাতন নিপীড়নের কথাও লিখে গেছেন ভারতের প্রয়াত এই রাষ্ট্রপতি। তার লেখায় বাঙালির ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে কী প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল তারও ব্যাখ্যা এসেছে। এসেছে ২৫ মার্চের কালরজনীতে নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা। ৩০ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারতের লোকসভায় নেওয়া প্রস্তাবটি ছিল এ রকম: 'পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে লোকসভা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সেখানে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ন্যায়সংগতভাবে যে রায় দিয়েছে, সেই রায়ের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানোর বদলে পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছে। এই লোকসভা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করছে এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি অবিলম্বে নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে'। বাংলা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, '১৫ জুন বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। একজন সদস্য জানতে চান, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। উত্তরে আমি জানাই, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে'। প্রিয়দর্শিনী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। তিনি লিখেছেন, 'সে সময় থেকেই ইন্দিরা গান্ধী আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমাকে প্রথম আন্তসংসদীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য মনোনীত করেন। সেই বৈঠকে আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা, যাতে তারা যে যার দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের সরকারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন। হতে পারে এই বৈঠকে আমার ভূমিকার কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি খুশি হয়েছিলেন। কেননা, এরপর একই দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠান।' প্রণব মুখার্জি ১৯৭২ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯৭৬ সালে ইন্দিরার মন্ত্রিসভার সদস্য হন। ভারতের সুমন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের প্রতি প্রণব মুখার্জির দুর্বলতা অপরিসীম; অনেকটা জ্যোতি বসুর মতোই। জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি ছিল বারদিতে, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের পাশেই। সেই অর্থে তিনি ছিলেন বাঙাল। প্রণববাবু আপাদমস্তক ঘটি তার আদি বাড়ি দীঘাতে। তবে বিবাহসূত্রে তিনিও বাংলাদেশের জামাই'। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে আন্ত-আঞ্চলিক সংযোগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ভারতে কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়। আর যখন অকংগ্রেসি সরকার আসে, তখন সম্পর্ক ভালো হয়। প্রণব মুখার্জি এই ধারণা অনেকটা অসত্য প্রমাণ করেছিলেন। তার সময়ে বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তরণ ঘটে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে কলকাতা থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন। সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে সাহায্য নিয়ে শরণার্থীদের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠাতেন।

বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয় নারকীয় পঁচাত্তরের পর শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে নির্বাসিত ছিলেন। সেই সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, 'শেখ হাসিনা আমার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু এবং আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত সহায়তা করেছিল।' সে সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, 'প্রকৃত ঘটনা হলো, যখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা তাকে ত্যাগ করছিলেন, আমি তাদের ভর্ৎসনা করে বলি, যখন কেউ বিপদে পড়েন, তখন তাকে ত্যাগ করা অনৈতিক'।

১০ অগাস্ট নয়াদিল্লিতে সরকারি বাসভবনের বাথরুমে পড়ে গিয়ে প্রণব মুখার্জি মাথায় আঘাত পান। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর এক পর্যায়ে কোমায় চলে যান তিনি। প্রায় দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশ তার আজন্ম এই বন্ধু ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রয়াত প্রণববাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট 'জাতির পিতা' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাদের সবসময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন। যে কোনও প্রয়োজনে তিনি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশে ফেরার পরেও প্রণব মুখোপাধ্যায় সহযোগিতা করেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। আবার সংকটে পড়লে তিনি সাহস জুগিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৩ সালে প্রণব মুখার্জির হাতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।