সমন্বয়ী সাধনার মরমী সাধক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন

গৌতম রায়
Published : 19 Sept 2020, 04:13 PM
Updated : 19 Sept 2020, 04:13 PM

পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যাপনা করতেন পিতামহ উপেন্দ্রনাথের সহপাঠী ইতিহাসাচার্য সুরেন্দ্রনাথ সেন। তার মাধ্যমে আমাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় বাংলার লোকসম্পদের মুকুটহীন সম্রাট মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের। সেইসূত্র ধরেই লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক হিসেবে কেবল বাংলাতেই নয়, গোটা বিশ্বে যিনি কিংবদন্তীর মর্যাদায় উপনীত হয়েছেন, তার সাথে একটা পারিবারিক সম্পর্ক, আত্মার আত্মীয়তা তৈরি হয়েছিল। লোকায়ত আঙ্গিক কিভাবে সংস্কৃতির দরজাকে উন্মুক্ত করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের, মনোমালিন্যের উর্ধ্বে মানবতাকে স্থাপন করেছে, তা উপলব্ধি করতে গেলে বিস্মৃতপ্রায় মনীষী মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন এবং তার কর্মপ্রবাহের চর্চা একান্ত জরুরি।

দেশভাগের অল্প কিছুদিনের মাথায় মনসুরউদ্দিন শ্রীহট্ট জেলার মুরারিচাঁদ কলেজে বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। জনবসতির বিন্যাসে এই জেলাটিতে মুসলিম প্রাধান্য হলেও লোকায়ত চর্চায় সমন্বয়ী সংস্কৃতির একটা অনবদ্য প্রভাব এখানে প্রবল। বিশেষ করে শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলার লোকসঙ্গীতগুলোর ভিতরে হিন্দু সমাজের সামাজিক আঙ্গিক, রীতিনীতি, আদবকায়দার একটা জোরদার প্রভাব রয়েছে। হিন্দু সমাজ জীবন সম্পৃক্ত উপমার ও একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে সিলেটের লোকসঙ্গীতের ভিতরে।

সিলেটের লোকসঙ্গীতে রাধাকৃষ্ণের বহুল ব্যবহারকে মনসুরউদ্দিন, হাফিজের রচনার সাকীর বহুল ব্যবহারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাধাকৃষ্ণের প্রতীক কিভাবে সিলেটের লোকসঙ্গীত তথা লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে আপামর বাঙালি সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলিমের একটি সোপান হয়ে উঠেছে, তা প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন। শ্রীচৈতন্যের প্রভাব সিলেট সন্নিহিত অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, বাঙালি সংস্কৃতিকে যেভাবে ঋদ্ধ করেছে, বহুত্ববাদী ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে, সেইদিকেই সারস্বত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে মনসুরউদ্দিন ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ।

শ্রীচৈতন্যের পিতা উড়িষ্যার জাজপুর থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী জমিদারতন্ত্রের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কিভাবে প্রাণটুকু সম্বল করে সিলেটে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার প্রেক্ষিত বাঙালি সংস্কৃতির সন্মিলিত প্রবাহমান ধারাকে পরিপূর্ণতার দিকে প্রবাহিত করে, লোকায়ত ধারার সাথে কর্মসংস্কৃতির আঙ্গিককে সংযুক্ত করেছে, সেদিকে বিদ্যোৎসাহী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের ভেতর দিয়ে মধ্যকালীন ভারতের প্রবাহমান ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার এক ঐতিহাসিক সূত্র মনসুরউদ্দিন বাংলা তথা গোটা মানবসমাজের সামনে হাজির করেছেন।

শ্রীচৈতন্যের বাল্যকালের একটা বড় সময় যে সিলেটে কাটে, এটা আজকের দিনের বাঙালি প্রায় ভুলেই গেছে। সন্তানদের বিদ্যাচর্চার আরও বেশি সুবিধার তাগিদেই শ্রীচৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্র আবার নবদ্বীপে ফিরে গেলেও সিলেটের সর্বাঙ্গীন পরিবেশে শ্রীচৈতন্যের একটি প্রভাব জোরদারভাবে থেকে যায়। পরবর্তীতে তার বৈষ্ণবধর্মের প্রসারের তালে তালে সিলেটকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণবধর্মের মানবিক ধারা, বিশেষ করে জাতপাতের বিরুদ্ধতার বিষয়টি খুব গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। বহু বৈষ্ণব সাধকের মিলিত স্রোত একাধারে সামাজিক অঙ্গনকে প্লাবিত করে সংস্কৃতির অঙ্গনেও জাতপাতের, ধর্মের বেড়া ভেঙে সংস্কৃতির অঙ্গনকে একটা প্রবাহমান বিকল্প ধারাতে অভিষিক্ত করেছিল। এই অভিনিবেশ পর্ব, বাংলার রাজনীতির এক বিয়োগান্তক কালে অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন মনসুরউদ্দিন।

হিন্দু-মুসলিমন উভয় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি যখন হাজার বছরের প্রবাহমান ধারার  বহুত্ববাদী, সমন্বয়ী চেতনাকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ আর মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধোঁয়াশার জালে ঢেকে দিয়ে , দেশভাগকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখেছিল, সেই সময়কালে, সংস্কৃতির গহীনে সম্প্রীতির সুরের এই অনুসন্ধানের ভিতর দিয়ে মনসুরউদ্দিন এক ঐতিহাসিক সেতুবন্ধনের কাজ করেছিলেন, যে কাজে তার সব থেকে বড় আশীর্বাদক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। 

পাঁচের দশকে মহান ভাষা আন্দোলনের পর, মুসলিম লীগের 'মুসলিম জাতীয়তাবাদে'-র কফিনে পেরেক পোতার যে কর্মকাণ্ড বাঙালি শুরু করে, সিলেটে লোকসঙ্গীত ঘিরে সম্প্রীতির এই আবাদপর্ব, যা মনসুরউদ্দিনের কার্যত একক চেষ্টায় দিনের আলো দেখেছিল, তারও একটা বিশেষ অবদান আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমিকাতে ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী দর্শন সমৃদ্ধ চেতনার সংমিশ্রণে মনসুরউদ্দিনের অবদান ঐতিহাসিক।

সিলেট অঞ্চলে একটা সময়ে কীর্তন ঘিরে সমন্বয়ী সংস্কৃতির কি অসামান্য চর্চা হয়েছিল তার দিকে বাঙালি সমাজের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন। তার প্রদর্শিত এ ধারাকে সমৃদ্ধ করার দিকে পরবর্তীকালের গবেষকদের আমরা খুব একটা উৎসাহী হয়ে উঠতে দেখি না। হিতেশরঞ্জন সান্যাল বাংলার কীর্তনের ইতিহাস ঘিরে ঐতিহাসিক গবেষণা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তার গবেষণাতে কীর্তনের বিবর্তনে শ্রীহট্ট এবং সন্নিহিত অঞ্চলের ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং অবদান প্রায় অনুল্লিখিতই থেকে গেছে। 

শ্রীচেতন্যের সমসাময়িক কাল থেকে কীর্তন এবং সেই ভক্তিরসের গানে রাধাকৃষ্ণের মিলনব্যাখ্যান, যা সিলেটের জন্মসূত্রে মুসলিমদের সৃষ্ট নানা ধরনের লোক সঙ্গীত এবং লোকায়ত ধারার সাথে মিশে আছে, মনসুরউদ্দিন প্রথম সেই ধারার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও হিতেশবাবুর মতো প্রত্যক্ষ ভাবে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষও তাঁর ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিতে প্রায় গুরুত্বই দেননি বলা যেতে পারে।

শান্তিদেব ঘোষ তার জীবনে প্রথম যখন ছেঁউড়িয়াতে মহাত্মা লালনের আখরাতে যান, তখন সেখানে লালন রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা সম্পৃক্ত একটি গান পরিবেশিত হচ্ছিল। লালনের গানে এই সমন্বয়ী চেতনার কথা, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার নিরিখে শান্তিদেব প্রায়ই বলতেন। মনসুরউদ্দিন সিলেটের লোকসঙ্গীতে বৈষ্ণব রসাস্বাদিত কীর্তনের কথা পাঁচের দশকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেও, আটের দশকে করা হিতেলরঞ্জনের কীর্তন সংক্রান্ত গবেষণাতে তা অনুল্লিখিত ই থেকে যায়। অথচ এই ভাঙাভাঙি, ভাগাভাগির বিরুদ্ধেই নিজৃর সংস্কৃতি চেতনাকে চিরদিন পরিচালিত করে গেছেন মহাত্মা মনসুরউদ্দিন।

সিলেটের প্রথাগত শিক্ষার পরিমণ্ডলে থাকা মানুষজন বা যারা প্রথাগত শিক্ষার তেমন সুযোগ পাননি, তাদের ভেতরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমভাব কিভাবে জাতধর্মের বেড়াকে অতিক্রম করে মানবধর্মের ভিতকে শক্ত করেছে, তা বোঝার জন্যে মনসুরউদ্দিন বার বার হাছন রাজার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন।

মনসুরউদ্দিন বলতেন, "গান যখন সুর ও বাদ্যযন্ত্রযোগে গীত হয়, তখন আনন্দের খোরাক হয়। কে তখন নদীর উপরে নৌকায় বসিয়া গ্রামের গভীরে কিংবা আপন বাসস্থানে বসিয়া নিশীথে গান শুরু করে তখন হিন্দু- মুসলমান ভেদাভেদ দূর হয়।" ('হারামণি, সপ্তম খণ্ডের ভূমিকা। পৃষ্ঠা- চৌদ্দ) ।

লোকায়ত ভঙ্গিমাতে সম্প্রীতির সুর অনুসন্ধাই ছিল মনসুরউদ্দিনের জীবনের প্রধান ব্রত। তাই তাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "তোমার গ্রাম্য গীতিসংগ্রহের অধ্যাবসায় সফলতা লাভ করুক, এই আমি কামনা করি।" 

১৯৩৭ সালের ২৩ জুলাই মনসুরউদ্দিনকে লেখা এই আশীর্বাণীতে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একটি বারের জন্যেও লোকায়তধারার সৃষ্টিশীল সংগ্রহকে- দলিত গীতি, মুসলমানি গীতি বা হিন্দু গীতি, এমন কোনো কৌণিক অবস্থানজনিত শব্দবন্ধের ভিতরে পুড়ে রাখেননি। আজ লোকায়ত ধারাকে যখন ধর্ম, বর্ণ, জাত পাতের বেড়াতে আবদ্ধ করে ফেলে, শাসক একটা রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার পথে হাঁটতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন, এইরকম একটি সময়ে মনসুরউদ্দিনের সাধনার ধারা এবং সেই ধারার গতিপথ নির্দেশিকায় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক 'গ্রাম্য গীতিসংগ্রহ' ব্যবহারের যে অনুপম সাক্ষর, তা মানবতাকে ধর্মমোহ, জাত্যাভিমান থেকে শতযোজন দূরে রাখার একটি মহৌষধ হিসেবেই বিবেচিত হয়।

লোকসঙ্গীতের মূল উৎসকে বহতা নদীর সঙ্গে চিরদিন তুলনা করতেন মনসুরউদ্দিন। মানুষের প্রবাহমান ধ্যানধারণার যুগক্রমানিক ধারা উপধারাই লোকসঙ্গীতের ভেতর দিয়ে সংস্কৃতির সিংহদুয়ারকে উন্মুক্ত করে দেয়। সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার এই সজ্ঞা 'বিনুর বই'-তে নিরুপিত করেছিলেন, এ যুগের ভলতেয়ার অন্নদাশঙ্কর রায়। মনসুরউদ্দিনের গোটা জীবনের সাধনাও সেই ধারাতেই প্রবাহিত হয়েছে। ধনীর দুয়ার থেকে অন্ত্যজের দহলিজ , কোনও ক্ষেত্রই যে সংস্কৃতির ঘরদুয়ার-কে উন্মুক্ত বাতাস প্রবাহিতের ক্ষেত্রে ব্রাত্য নয়, বাংলা তথা বাঙালি সংস্কৃতির এই মূল সুরটিই যেন নিজের একতারাতে একমনে গোটা জীবন ধরে বাজিয়ে গিয়েছেন মনসুরউদ্দিন।

যুগ-যুগান্তের চিন্তার বিবর্তন কিভাবে লোকসঙ্গীতের ভিতর দিয়ে সংস্কৃতির মূল ধারাতে সম্প্রীতির বীজকে মহীরুহে পরিণত করেছে, মনসুরউদ্দিনের মতো এতো নিবিড়, পরিশ্রমসাধ্য গবেষণার ভিতর দিয়ে, খুব কম গবেষকই তা তুলে ধরেছেন। মেলে দিয়েছেন আপামর সুধীবৃন্দের কাছে।

সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের সংযোগ কিভাবে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চেতনাকে প্রভাবিত করে বহুত্ববাদী সাধনার ধারাকে আমাদের বাংলাতে পুষ্ট করেছে, সেটি হাতে কলমে দেখিয়েছিলেন মনসুরউদ্দিন। প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানবজীবনের বারমাস্যার মিশেল, সমাজতত্ত্বের সার্বিক চিত্রকলাকে কেবল চিত্রায়িত করে না, তাকে বাঙ্ময় করে তোলে, ভাস্বর করে তোলে। মৌনতার এই মুখর হওয়ার পটচিত্র অনুপুঙ্খভাবে বাংলার সমাজচিত্রের ধারাবিবরণী রচনার সংকল্পে মনসুরউদ্দিনের মাপের আন্তরিক কাজ খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। লোকসঙ্গীত কিভাবে লৌকিক জীবনে কায়িক শ্রমের স্থানিক ভার লাঘব করে , মানুষের মনের ভার লাঘব করে, তা বোঝার ক্ষেত্রে মনসুরউদ্দিনের সংগ্রহ, গবেষণা এবং বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

তার এই গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্তে খুব সহজেই পৌঁছানো যায় যে, মনস্তত্ত্বের পাঠে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান যে কাউন্সেলিং ইত্যাদি প্রথার উপর নির্ভর করে থাকেন, সেইসব প্রথার একদম আদিভিত্তি বাংলার লোকসঙ্গীতের সমন্বয়ী চেতনা প্রসূত ধারাতে আদি অনন্তকাল ধরে আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে নবতম ধারা, মনোবিজ্ঞানে যে মনস্তাত্ত্বিক বিচার বিশ্লেষণকে, আধুনিক প্রজন্মের চিকিৎসকেরা দেশে-বিদেশে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, সেই ধারার আদি সুর বাংলার লোক সঙ্গীতেই আছে। বাংলার লোকসঙ্গীতে বহুত্ববাদীধারার পাশাপাশি আধুনিক মনোবিজ্ঞান প্রসূত দৃষ্টিভঙ্গির উপজীব্য বিষয়ের যে উজ্জ্বল উপস্থিতি, সেটি প্রথম সারস্বত সমাজের সামনে মেলে ধরেছিলেন মহাত্মা মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন।

আত্মনিবেদিত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ছিলেন মনসুরউদ্দিন। সম্প্রীতির স্বার্থে নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে তিনি নিয়োজিত করেছিলেন। তাই লালন চর্চার ক্ষেত্রে জন্মসূত্রে হিন্দু এমন মানুষদের ঐতিহাসিক অবদানের কথা তিনি সব সময়েই মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করতেন। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িককালে, নবজাগরণের অব্যবহিত পরবর্তী প্রবাহমানতায়, বহুত্ববাদী সাধনার প্রাসঙ্গিকতাকে অনুভব করে, মহাত্মা লালনের জীবন এবং সঙ্গীতকে চর্চার ভিতর দিয়ে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে, অবিভক্ত বাংলার হিন্দু সমাজের ভূমিকা এবং অবদানের কথা মনসুরউদ্দিন সব সময়েই অত্যন্ত কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করতেন।

বিশ শতকের সূচনা লগ্নে লালনের কর্মভূমি অবিভক্ত নদিয়া জেলাতে মুসলমান জনসংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও, বিভাগোত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রবাহমানতায় শ্রীচৈতন্যের প্রেমাপ্লুত বৈষ্ণব ধ্যানধারণা কতোখানি প্রজ্জ্বল ছিল, অত্যন্ত ইতিহাস সচেতনভাবে সে কথা মনসুরউদ্দিন বলেছেন।

লালনের সৃষ্টিতে লোকায়ত হিন্দু দর্শন এবং লোকায়ত ইসলামীয় দর্শনের, বিশেষ করে সুফী তরিকার সংমিশ্রণ, বাংলার সামাজিক প্রেক্ষেপটের সমন্বয়ী চেতনাকে কিভাবে সঞ্জীবিত করেছিল, সুধী সমাজের কাছে তা অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি। কেবল সিলেট জেলাতেই নয়, অবিভক্ত নদিয়ার যে অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাধিক্য প্রবল, অর্থাৎ, রাজনৈতিক বা ভৌগোলিকভাবে আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের কুষ্টিয়া অঞ্চল, সেখানে প্রেমের প্রতীক হিসেবে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালিদের কাছে রাধাকৃষ্ণ এবং সেই যুগলের প্রতিভু হিসেবে শ্রীচৈতন্যের ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতার কথা মনসুরউদ্দিন অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছিলেন।

মনসুরউদ্দিন একজন অত্যন্ত নীতিনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। পবিত্র ইসলামের ধ্যানধারণার প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। তা বলে পবিত্র ইসলামকে ব্যবহার করে কেউ যদি কোনো বিদ্বেষমূলক ধারণা ছড়ায়, তা কখনো, কোনো ভাবে মনসুরউদ্দিনের দ্বারা সমর্থিত হয়নি। পবিত্র ইসলামকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে কেউ যদি সম্প্রীতির চেতনাকে আঘাত করে, হিন্দু- মুসলমানের যৌথ সাধনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়, তার বিরুদ্ধতায় নিজের কলম, ধী শক্তি, মননশীলতাকে সবসময়ে ব্যবহার করেছেন মনসুরউদ্দিন।

জাতীয় আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রবাহমানতায় গত শতকের তিনের দশকের শেষপ্রান্ত থেকেই হিন্দু ও মুসলমান, উভয় ধর্মের ভিতরেই একটা বড় অংশের মানুষ, ধর্মকে কৌণিক চেতনায় রাজনৈতিক স্বার্থে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। এই ধারা প্রচলনে হিন্দু এবং মুসলমান, উভয় সমাজেরই মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অংশ তাদের আঘাতের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিতে শুরু করলো হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সাধনার ক্ষেত্রটিকে। এই পর্যায়ে চরমভাবে আক্রান্ত হতে শুরু করলো ধর্মের লোকায়ত আঙ্গিকগুলো।

১৩০৫ বঙ্গাব্দে মাওলানা রেওয়াজউদ্দিন একটি বাউল বিধ্বংসী ফতোয়া জারি করেছিলেন। তার পরপর আরো কিছু মাওলানা এ ধরনের বেশ কিছু ফতোয়া জারি করেন। এ ধরনের ফতোয়া জারির পিছনে সাম্প্রদায়িক চেতনার থেকে বেশি সক্রিয় ছিল হিন্দু এবং মুসলমান সমাজের সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলির প্রভাব। বিশুদ্ধ হিন্দু বা বিশুদ্ধ মুসলমান চেতনাকে অনুসরণ করবার তাগিদে সেদিন যেসব ফতোয়া জারি হয়েছিল, সেগুলির ভিতরে সাম্প্রদায়িক অভিষ্পা খুব একটা ছিল না। ছিল নিজের নিজের ধর্মের ভিতরে বিশুদ্ধতা রক্ষায় কৃতসংকল্প হয়ে ওঠে। এ প্রবণতার ভিতরে মৌলবাদী চেতনা প্রাথমিকভাবে প্রবল ছিল, সেভাবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। তবে ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষার মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যে অচিরেই সাম্প্রদায়িক তাগিদে পর্যবসিত হয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

হিন্দু সংস্কারবাদীদের ভেতরে যারা বেশি আগ্রাসী ছিলেন (যেমন শশদর তর্কচূড়ামণি ইত্যাদি)  ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রশ্নে, তাদের থেকে রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, শ্রীরামকৃষ্ণ,কেশবচন্দ্র সেন, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখের প্রভাব সংশ্লিষ্ট সমাজের উপর অনেক বেশি পড়েছিল। ফলে বঙ্কিমের মতো মানুষ, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতাকে সাম্প্রদায়িক অভিমুখ দিতে খুব সক্রিয় হলেও, সেই সক্রিয়তার প্রভাবে অরবিন্দ ঘোষের মতো দুই-চারজন হিন্দু বাঙালি যুবকই বেশি প্রভাবিত হলেন। আপামর বাঙালি হিন্দু যুবকদের ভিতরে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখের যুক্তিবাদ এবং সমন্বয়ী চেতনাই বেশি প্রভাব বিস্তার করলো।

অপরপক্ষে মারাঠা ভাবাবেগে এ বঙ্কিমের ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের কৌশলটি অনেক বেশি প্রকট হয়ে উঠলো। বাল গঙ্গাধর তিলকের মতো স্বদেশপ্রেমীরা জাতীয়তাবাদকে পর্যবসিত করলেন ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদে। হিন্দু যে প্রবল উৎসাহে মুসলমানের পবিত্র মুহররমের শোভাযাত্রা দেখে শ্রদ্ধা জানায়, সেই প্রবণতাকে বিনষ্ট করতেই তিলক প্রচলন করলেন পুনেতে- প্রথম বারোয়ারি গণপতি উৎসব। পরে তা অবিভক্ত ভারতের অন্যতম বড়ো বাণিজ্যনগরী বোম্বাই ( আজকের মুম্বাই )-তে ছড়িয়ে পড়লো।

ওহাবী, ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাবে বিশুদ্ধ ইসলামের তাগিদে উনিশ শতকে যেসব বাউল ধ্বংসের ফতোয়া, সেই ফতোয়াগুলো একদম পরিবর্তিত আকার নিয়ে, সেদিনের মৌলবাদী প্রবণতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বিষের মিশেল করে ঝরে পড়লো মওলানা আবু বকর প্রমুখ একাংশের ইসলামীয় প্রচারকদের বাউল বিরুদ্ধতার মধ্যে দিয়ে। ধর্মের লৌকিক আবেদনকে সাম্প্রদায়িক মেজাজে পরিণত করবার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই নীতিনিষ্ঠ মুসলমান হিসেবেই গর্জে উঠেছিলেন মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন।

মওলানা আবু বকর প্রমুখের মিশনারী ঢঙে মহাত্মা লালন ফকির, ঝিনাইদহের পাগলা কানাই, ইদু বিশ্বাস প্রমুখ সন্তদের বিরুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী আগ্রাসন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন মনসুরউদ্দিন। পাঁচের দশকে সদ্য দেশভাগের পর একদিকে যখন মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন- অপর দিকে মহান ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ 'বাঙালি জাতীয়তাবাদে'র বিজয় বৈজয়ন্তীর উড্ডীয়ন পর্ব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্ব স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির পথে ধীরে ধীরে পদচারণার শুভ সূচনা, এই পর্বে লোকায়ত সংস্কৃতিতে মৌলবাদের, সাম্প্রদায়িকতার থাবা বসানোর প্রচেষ্টার কেবল প্রতিবাদের ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিরোধের প্রাচীর নির্মাণেও মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন।

১৯৮৭ সালের ১৯ শে সেপ্টেম্বর ঢাকাতে মনীষী, মুক্তবুদ্ধির উপাসক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশে তার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে কিংবদন্তী লোকসংস্কৃতি গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরীর মতো মানুষ আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পর কার্যত এপারের লোক সংস্কৃতিবিদদের ভেতরে একজনও মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিনকে স্মরণ করেছেন বলে মনে হয় না। অথচ আজকের ভারতীয় উপমহাদেশে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের এই ঘোরতর সঙ্কটে মনসুরউদ্দিনের মতো মানুষের জীবন এবং কর্মধারা আলোচনা, মানুষের হৃদয়বৃত্তিতে সম্প্রীতির ধারা সিঞ্চনে প্রবল সহায়ক একটি শক্তি হয়ে উঠতে পারে।