মাওলানা শফী, হেফাজত ও আওয়ামী লীগ

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 Sept 2020, 02:00 PM
Updated : 19 Sept 2020, 02:00 PM

হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী ১০৩ বছর বয়সে মারা গেলেন। মাত্র আগেরদিনই তিনি ছাত্রবিক্ষোভের মুখে 'অসুস্থতা'র কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তার ছেলে আনাস মাদানিকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। সংগঠনে তার কর্তৃত্বের অবসান হওয়ামাত্র তিনি সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে চট্টগ্রামে, পরে তাকে ঢাকায় আনা হয়। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো যায়নি।

গত ছয়-সাত বছর ধরে শাহ আহমদ শফী দেশের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন এবং বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর পর তার বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে মাঠে নেমে 'বড় হুজুর' মাওলানা আহমদ শফী সারা দেশে পরিচিতি পান।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৫ মে এই হেফাজতে ইসলাম বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে মতিঝিলে লক্ষ লক্ষ কর্মীসমাবেশ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সিপিবি অফিস, বায়তুল মোকাররমের দোকানপাট ও কয়েকটি সরকারি অফিসে আগুন জ্বালিয়ে সরকারের আসন্ন পতনের লক্ষ্যে তারা বহ্নি উৎসব করেছিল। সেদিন তাদের মিত্র ছিল সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ধারণা করেছিলেন, হেফাজতি অভ্যুত্থান দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যাবে। কিন্তু সরকারের পতন ঘটেনি। গভীর রাতে পুলিশ দিয়ে হেফাজতকর্মীদের ঢাকা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তখন নিরাশ হয়েছিলেন বিএনপি ও হেফাজত উভয় নেতৃত্বই।

এরপর পাশার দান পাল্টে যায়। সরকার উদ্যোগ নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে আপস করে এবং সেই আপসের ধারাবাহিকতায় তাকে রেলওয়ের ৩২ কোটি টাকার জমি উপহার দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরে ক্রমশ আওয়ামী লীগ ও হেফাজত পরষ্পরের কাছে এসেছে। হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে, কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। ইসলামের চেতনার দোহাই দিয়ে আদালত থেকে মূর্তি অপসারণের দাবি জানিয়েছিল হেফাজত। তাও মানা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতাতেই নির্বাচনের প্রাক্কালে ঢাকায় সমাবেশ করে হেফাজতের 'বড় হুজুর' ৯৮ বছর বয়সী মওলানা আহমদ শফী, যাকে বাংলাদেশে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রতিভূ হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকেই, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে 'কওমি জননী' আখ্যা দিয়েছেন। প্রকাশ্যে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে শেখ হাসিনাও এই বন্ধুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

মাওলানা আহমদ শফীর মৃত্যু এবং দেশের কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী হবে–তা নিয়ে জল্পনা চলছে। অনেকের মতে, মাওলানা আহমদ শফীর অনুপস্থিতিতে এই দলটিতে নেতৃত্ব নিয়ে বিভেদ বাড়বে। মাওলানা শফীর পক্ষে-বিপক্ষে দ্বন্দ্ব চলছিল অনেকদিন ধরেই। তাকে এবং তার ছেলেকে দল থেকে বাদ দেওয়াটা সেই দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। এর আগে দলের প্রভাবশালী সদস্য বাবুনগরীকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব কয়েক বছর ধরেই চলছিল। মাওলানা শফীর মৃত্যুতে যা আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আওয়ামী লীগ। কেননা আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত মাওলানা আহমদ শফীর সঙ্গে একটা আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছিল। কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ করে তাদের বাগে রাখতে পেরেছিলেন। গত ৬ বছরে হেফাজতকে সরকারবিরোধী কঠোর কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করতে বা সরকারের কোনো সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগকে চিন্তায় থাকতে হবে। কে বা কারা নেতৃত্বে আসবেন, তারা কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করবেন, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের কতটুকু কী বনিবনা হবে, সে প্রশ্নগুলো থাকছেই।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় অবক্ষয় হচ্ছে, এখন হেফাজতের মতো একটি ধর্মভিত্তিক দল ও দলের নেতাকে নিয়েও ভাবতে হয়। আলোচনা করতে হয়। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি ও মানুষের ভাবাদর্শে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। ধর্মকে আত্মপরিচয়ের একমাত্র উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্যক্তিগত ও সমাজিক আচার, রাজনীতি থেকে শুরু করে সবখানে ধর্ম প্রধান ভূমিকা পালন করছে। যদিও বাংলাদেশের শুরু থেকেই রাজনীতিতে ধর্ম বড় একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে, তবে সেটা ছিল অদৃশ্য। মূলত আশির দশকের পরে আফগান যুদ্ধের একটা প্রভাব বাংলাদেশে পড়ে। বাংলাদেশ থেকে তখন আফগানিস্তান এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধ, পরবর্তীকালে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের একটা আদর্শগত প্রভাব পড়তে থাকে। অমুসলিম হঠাও কিংবা ইহুদি-নাসারা-আমেরিকাকে খতমের চেতনা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। ভারতের চণ্ড পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রভাবে ভারতবিরোধী মনোভাবও বাড়তে থাকে। মূলত ২০০১ সালের পর থেকে রাজনীতির মাঠ বদলে যায়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মূলধারার রাজনীতির ঠিক পাশে বিশাল কিন্তু অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোও দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে বড় করে দেখতে শুরু করে। ধর্মের রাজনীতিকে আদর্শগতভাবে মোকাবেলা করা পথ থেকে সরে এসে নিজেরাই ধর্মভিত্তিক দলের বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করতে শুরু করে। একইসঙ্গে চলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলার চেষ্টা।

স্বাধীনতার আগের এ অঞ্চলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ ঘটে মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন ও এর ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধে এই রাজনীতি আপাত পরাজিত হয়। কিন্তু সেই রাজনৈতিক ভাবধারা ও চিন্তাচেতনার মানুষগুলো ধুয়ে-মুছে যায়নি। বরং তারা নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের বিকাশ এবং একাত্তরের পরাজয়ে প্রতিশোধ নিতে মরিয়া চেষ্টা চালাতে থাকে। তাদের জন্য মহাসুযোগ আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট। জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের সঙ্গে এই পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় রাজনীতির অনুচররা মিলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ কালপর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক শক্তি কেবল নতুন করে পায়ের তলায় মাটি পায় তা-ই নয়, সেই মাটি শক্তপোক্ত করারও প্রভূত সময় পায়। প্রয়োজনীয় পেট্রনও পেয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধীরাও সগৌরবে পুনর্বাসিত হয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার অধিকার ও রসদ ফিরে পায়। একটু একটু করে পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ 'ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি' এবং 'ধর্মাশ্রয়ী বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ রাজনীতি' এই দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম ধারাটির নেতৃত্বে নানা আপস সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ-ই থেকে যায়। আর দ্বিতীয় ধারাটির নেতৃত্বে আসীন হয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি।

এদিকে জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আদর্শিক রাজনীতির বিপর্যয়ের সুযোগে দেশে দেশে ধর্মীয় ভাবধারার রাজনীতি ক্রমেই বিকশিত হতে থাকে। অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিমুখী রাজনীতি দুর্বল হতে থাকে। এই সুযোগে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে অত্যন্ত সুসংগঠিত একটি দলে পরিণত হয়। তাদের বিশাল অর্থভাণ্ডার, অন্ধবিশ্বাসী কর্মী-বাহিনী তৈরি হয়। অন্য দিকে, বিএনপি ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তাবাদ ও ভারত বিরোধিতার ভিত্তিতে দেশের মানুষের একটি বড় সমর্থন পায়। বিএনপি ও জামায়াত দুটি পরস্পর পরিপূরক শক্তিতে পরিণত হয় এবং তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে যথেষ্ট ভোগান্তি শুধু নয়, এমনকী পরাজিত করতেও সক্ষম হয়। এটা অবশ্য আওয়ামী রাজনীতিরই সীমাবদ্ধতা। কারণ আওয়ামি লীগের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নেই এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার তাগিদও তাদের মধ্যে তেমনভাবে লক্ষ করা যায়নি।

জামায়াত-বিএনপিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই আদর্শিক রূপান্তরের পথে পা বাড়ায়। জামায়াতের বাইরে একটি ধর্মভিত্তিক দলকে তারা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে এবং তার সঙ্গে সখ্য গড়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল গ্রহণ করে। হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে আওয়ামী লীগের জন্য তেমন এক ভরসার নাম। আওয়ামী লীগের আশা, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হেফাজতের বিপুল কর্মীরা তাদের পক্ষে থাকবে। আর তারা পক্ষে থাকলে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক বিরোধিতাও কম মোকাবিলা করতে হবে।

যদিও এটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ভাবাদর্শকে ভাবাদর্শ দিয়েই লড়াই করতে হয়। সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় মৌলবাদী ভাবাদর্শ লালন করছে এবং মৌলবাদী সংগঠন জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও একইভাবে এই মৌলবাদী দলগুলোকে তোষামোদ করে চলার নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে প্রধান রাজনৈতিক স্রোত মৌলবাদের অনুকূলেই প্রবাহিত হচ্ছে।

অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সংবিধানে সংশোধনী এনে এই দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান করেন। যুক্তি-বুদ্ধি-প্রগতিবিরোধী এই দলগুলো পুরোনো ও নতুন নতুন নামে রাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপে অবস্থান করছে। আর সরকার কোনো অজানা সমীকরণের কারণে তাদের কাছেই আত্মসমর্পণ করছে। এই বিষাক্ত চক্র থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার কোনো পথই কী আমাদের খোলা নেই?