করোনাভাইরাস নয়, মূল সমস্যাটি হচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জ

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনশেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
Published : 19 Sept 2020, 08:02 AM
Updated : 19 Sept 2020, 08:02 AM

মানুষের পৃথিবীতে মহামারী আগেও এসেছে; যেমন, প্লেগ, ম্যালেরিয়া, কলেরা, যক্ষা, স্প্যানিশ ফ্লু ইত্যাদি এবং এসব মহামারীতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। তবে করোনাভাইরাস এবং একবিংশ শতাব্দীর ভাইরাসগুলো এসেছে প্রাণীদের কাছ থেকে। আর এটি নিয়েই আতঙ্কিত হওয়ার যেমন কারণ আছে; তেমনি ভাবনা-চিন্তার বিস্তর অবকাশ আছে। কেননা, প্রামাণিক তথ্য উপাত্ত বলছে যে, নগরায়ন, শিল্পায়ন ও হাই-টেক সভ্যতার ভয়াবহ দূষণ প্রকৃতিতে বিরাজমান বাস্তুতন্ত্র এবং হাজার বছর ধরে চলমান বাস্তুসংস্থানকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় সেটি মানুষের জীবনযাপন, ফসল উৎপাদন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগ-ব্যাধির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদের হাতে আর মাত্র ১০ বছর সময় আছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আবহাওয়া পরিবর্তনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে কমানো না গেলে, গরম এতটাই বেড়ে যাবে যে, অনেক প্রজাতির প্রাণী এই গরম সহ্য করতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এতে ওই প্রাণীসমূহ ও তাদের সঙ্গেকার ভাইরাসগুলো চলে আসবে মানুষের মধ্যে। ফলে বিপদ বেড়ে যাবে কয়েকগুণ বেশি। কয়েক বছর পর পর করোনাভাইরাসের মত প্রাণঘাতী ভাইরাসের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হোমো স্যাপিয়েন্সদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, নতুবা মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা হয়ে উঠতে পারে বেশ কষ্টকর। পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও মহামারীতত্ত্ববিদেরা এমনই আশংকা করছেন। সেজন্য বলা হচ্ছে, মূল সমস্যা হচ্ছে আবহাওয়া পরিবর্তন, করোনাভাইরাস নয়।

ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন জানিয়েছেন যে, এই শতাব্দীর ৭৫ শতাংশ সংক্রামক রোগ মানুষের মধ্যে এসেছে জীবজন্তুর কাছ থেকে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, পৃথিবীর প্রায় ৮ শ' কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য বন উজাড় হচ্ছে, পাহাড় কাটা হচ্ছে, নদী ভরাট করা হচ্ছে। ফলে জল ও স্থলের পশু, পাখি ও মাছেদের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর যে সকল প্রাণী বেঁচে থাকছে, বনাঞ্চল সীমিত ও সংকুচিত হওয়ার কারণে তারা মানুষের নিকট সান্নিধ্যে চলে আসছে। এর ফলে মানুষের বসতি থেকে বহু দূরে বসবাসরত প্রাণীদের মধ্যে যে ভাইরাসগুলো ছিল, সেগুলো চলে আসছে মানুষের মধ্যে।

উল্লেখ্য যে, মানুষের জনসংখ্যা ১ শ' কোটি হতে হাজার বছর লেগেছে। কিন্তু গত ২ শ' বছরে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৭ গুণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৮ শ' কোটি। জনসংখ্যা এত দ্রুত বেড়েছে সংক্রামক রোগের টিকা ও ওষুধ আবিষ্কার, পাস্তুরায়ন ও প্রিজারভেটিভ দিয়ে দুধ ও অন্যান্য খাদ্য সংরক্ষণের প্রযুক্তি, রাসায়নিক সার ও কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের বিপুল বৃদ্ধি ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির মাধ্যমে। পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাবার জন্য আমাদের অনেক জমি প্রয়োজন। এজন্য পশু-পাখি-সাপ, বাদুড় ও পোকামাকড়েরা যে বনাঞ্চলে থাকে, সেই বনাঞ্চলের বিপুল অংশ ধ্বংস করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এতে পশুপাখিরা চলে আসছে মানুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই মানব সমাজ একের পর এক সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এই তালিকায় আছে সার্স, বার্ড ফ্লু, নিপাহ ভাইরাস, ইবোলা, মার্স ও সর্বশেষ করোনাভাইরাস। এই সকল সংক্রামক রোগের সবগুলোই এসেছে প্রাণীদের কাছ থেকে। বিশেষ করে সার্স ও করোনাভাইরাস – এ দুটি সংক্রামক ব্যাধিরই উৎপত্তিস্থল চীন এবং এগুলো বাদুড় থেকে এসেছে বলে সংক্রামক রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন।

চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস, আর উহানে আছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ 'ওয়েট মার্কেট' বা মাছ-মাংস ও জীবন্ত পশু-পাখির বাজার। এই পাইকারি বাজারে নানা ধরনের জীবিত ও মৃত মাছ, কচ্ছপ, মুরগী, শুয়োর, কুকুর, সাপ, গন্ধগোকুলসহ হিংস্র জন্তু-জানোয়ার ও এদের মাংস কেনাবেচা হয়। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে চীনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ 'ওয়াইল্ড লাইফ' বা হিংস্র জীবজন্তুর কেনাবেচা এবং এসব প্রাণীদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। কেননা, বিশাল এই পাইকারি বাজারে হিংস্র প্রাণীরা মানুষের খুব কাছাকাছি চলে আসায় প্রাণীদের মধ্যকার ভাইরাস চলে আসে মানুষের মধ্যে। তারপর চীন থেকে সেটি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।

ইবোলা, সার্স, বার্ড ফ্লু ও মার্স-এর বিস্তার থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দক্ষতা ও হাই-টেক মেডিক্যাল গবেষণার কারণে। প্রকৃতি পূর্বেকার সংক্রামক ব্যাধির মধ্য দিয়ে বার বার যে বার্তা দিয়েছিল, বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দ যদি তাতে কর্ণপাত করতেন, যদি উন্নয়ন-উন্মত্ত মানব জাতি নিবৃত্ত হত অরণ্য, নদী ও পাহাড় ধ্বংস করা থেকে, যদি বৈশ্বিক জনগোষ্ঠী নভোমন্ডল ও সাগর দূষণ কমিয়ে হ্রাস করতে পারত বিষাক্ত গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, তাহলে হয়ত আমাদের করোনাভাইরাস মহামারীর কবলে পড়তে হতো না।

করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারী হচ্ছে মানুষের লোভ, হাই-টেক সভ্যতার হাই-ভোল্টেজ দূষণ ও নির্বিচারে বন্য প্রাণী হত্যা করার পরিণতি। একটি মহামারী যে পৃথিবীকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে, সেটি কি আমরা জানতাম না? সাধারণ মানুষ জানতেন না বা তাদের জানার কথাও নয়। তবে মহামারীতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, ও চিন্তাবিদেরা তো সেটি জানতেন। বিল গেটস ২০১৫ সালে এ বিষয়ে সাবধান করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস ২০১৮ সালে সারা বিশ্বকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন, ভয়াবহ এক মহামারী খুব দ্রুত মানবজাতিকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। বিল গেটসের কথা বাদ দিলাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিবের কথাকেও আমলে নেওয়া হল না। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে, ভাইরাস প্রতিরোধ বিষয়ক গবেষণায় অর্থ ব্যয় না করে, শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ব্যস্ত হয়ে রইল যুদ্ধ, বাণিজ্য, ও উন্নয়ন নিয়ে। ফলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়ে এগিয়ে এল।

করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারীতে সারা পৃথিবীর যানবাহন, কল-কারখানা যখন বন্ধ, তখন দেখা গেল যে, বিশ্বের সকল দেশ মিলে বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়া সম্মেলন করে গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ যতটা না কমাতে সক্ষম হয়েছে, লকডাউনের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাস পেয়েছে তার চেয়ে বেশি।

গত ৩ থেকে ৪ শ' বছরে মানুষের উৎপাদন ব্যবস্থা, যোগাযোগ, অবকাঠামো, শিক্ষা-গবেষণা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, যুদ্ধাস্ত্র, শিল্প, কৃষি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটা উন্নত হয়েছে যে, মানুষ তার সভ্যতার কয়েক হাজার বছরে সেটি করতে পারেনি। তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আধুনিক সভ্যতার এই সৌধ নির্মাণ করতে গিয়ে মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে এবং করছে। ফলে দূষণ, উষ্ণায়ন, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি ও দাবদাহের মতো করোনা মহামারী এসে আবির্ভূত হয়েছে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে।

বিশ্বব্যাপী 'লকডাউনে'র মধ্যে মানুষজন যখন গৃহবন্দী, তখন ভারতের ব্যস্ত শহর মুম্বাইয়ের রাস্তায় দেখা গেল একদল ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে; ইংল্যান্ডের শান্ডিনডো শহরের জনশূন্য রাস্তায় ঘুরতে দেখা গেল পাহাড়ি ছাগলদের; দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী কেপটাউনের ফাঁকা রাস্তায় পেঙ্গুইন দেখা গেল; আর থাইল্যান্ডের লুপবুরি শহরে লকডাউনের সুযোগে রাস্তায় বেরিয়ে এল হাজার হাজার বানর। মহামারীর আতংকে যখন রাস্তাঘাট, সমুদ্র সৈকত, পর্যটন কেন্দ্রসমূহ জনমানবশূন্য, তখন বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের কলাতলী পয়েন্টে দেখা গেল ডলফিনের নৃত্য; মেক্সিকোর সমুদ্রতটে রোদ পোহাতে দেখা গেল অসংখ্য কুমিরকে; দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রগার ন্যাশনাল পার্কের রাস্তায় শুয়ে শুয়ে মনের সুখে রোদ পোহাতে দেখা গেল সিংহ ও সিংহীর দলকে। বিলুপ্তপ্রায় গন্ধগোকুল মালাবার সিভেটকে কেরালার রাস্তায় ঘুরতে দেখে বোঝা গেল।

যে পৃথিবীটাকে সৃষ্টিকর্তা জলচর ও স্থলচর প্রাণী, পোকা-মাকড়, জোনাকী ও অসংখ্য পাখির নির্ভয় ও আনন্দময় বিচরণের জন্য সৃষ্টি করেছেন, সেই পৃথিবীর প্রায় পুরোটাই মানুষ দখল করে নিয়েছে। ফলে মহামারীর ভয়ে প্রাণীজগতের হোমো সেপিয়েন্সরা যখন গৃহবন্দী, গাড়ি-ট্রেন-লরি-জাহাজ, নভোযান ও কল-কারখানা বন্ধ; তখনই বিভিন্ন দেশের ব্যস্ত নগরীর রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে ময়ূর, পেঙ্গুইন, হাতি, ও হরিণ; সমুদ্র সৈকতে রোদ পোহাচ্ছে কুমির-কাঁকড়া ও কচ্ছপ; বায়ু ও পানি ফিরে পাচ্ছে তার পূর্বেকার বিশুদ্ধতা; ভারতের শহর থেকে দেখা যাচ্ছে বরফ-শুভ্র নিলাভ হিমালয়; প্রকৃতি তার নির্মল বিশুদ্ধতা, বর্ণিল-বৈচিত্র্য, সহজাত স্নিগ্ধতা, ও সাবলীল সৌন্দর্য নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

মানুষকে বুঝতে হবে যে, প্রকৃতিকে জয় করে নয় বা পরিবেশকে ধ্বংস করে নয়; বরং প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে, অনাদিকাল ধরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার যে সহজাত নিয়মের মধ্য দিয়ে চলমান রয়েছে, তাকে মান্য করেই তাদের বেঁচে থাকতে হবে। নইলে বার বার পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতিশোধের মুখোমুখি হতে হবে সমগ্র মানব জাতিকে।