একটি সুসংবাদ: অস্ট্রেলিয়ায় খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণ চলছে!

শুভংকর বিশ্বাস
Published : 30 Jan 2012, 06:37 AM
Updated : 18 Sept 2020, 11:01 AM

পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম যে, হাজারখানেক সরকারি কর্মকর্তাকে খিচুড়ি রান্নার কলাকৌশল শিখতে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। "স্কুল ফিডিং" কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণের জন্য তাদেরকে বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এর আগেও বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং, আমি নিশ্চিত, খিচুড়ি রান্নার উন্নত কৌশল আমাদের দেশের খিচুড়ি শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের পরিচালক জনাব রুহুল আমিন খান বলেন, এই কর্মসূচির আওতায় কীভাবে কাঁচামাল কিনতে হয়, কীভাবে খিচুড়ি রান্না করতে হয় এবং তা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন। আর প্রাথমিকভাবে এরজন্য বাজেট চাওয়া হয়েছে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা। যদিওবা গত বছর কিছু কর্মকর্তা ভারতের কয়েকটি স্কুল পরিদর্শন করেন এবং সেখানে কীভাবে খাবার রান্না হয় তা প্রত্যক্ষ করেছেন, তবে প্রস্তাবিত কর্মসূচির অধীনে কর্মকর্তারা কোন দেশ বা দেশসমূহ ভ্রমণ করবেন তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আর এখানেই আমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে ও দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা অত্যাধুনিক রন্ধনশালায় স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খিচুড়ি রান্না শেখানো হয়। আপনারা জানেন যে, রন্ধন একটি কঠিন শিল্প। খিচুড়ি রান্না? সে তো আরও কঠিন। চালের সাথে ডালের অনুপাত, তার সাথে পরিমাণমতো মসলা মেশানো, ঝাল-তেল-নুনের রসায়ন, প্রয়োজনীয় আঁচ নির্ধারণ করা, সঠিক পাত্র নির্বাচন ইত্যাদি অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া। আর যদি তা ছোট-ছোট বাচ্চাদের জন্য হয়, তাহলে এইসব দ্রুত বর্ধনশীল শরীরের জন্য খিচুড়ির মধ্যে সবজি বা মাংস দিতে হয় ও একটু নরম করে রান্না করতে হয়। তাছাড়া বয়সভেদে বিভিন্ন সবজি নির্বাচনও চাট্টিখানি কথা নয়। আলু, ফুলকপি, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, বরবটি, এমনকি শাকপাতাও খিচুড়ির পুষ্টিগুণকে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি করে ও স্বাদকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।

অস্ট্রেলিয়ার পার্থে খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ করার জন্য অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকমণ্ডলী সবজি খিচুড়ি রান্নার কৌশল কোম্পানির প্রচারণার জন্য প্রকাশ করেছেন। প্রথমে চাল (কালোজিরা, চিনিগুড়া বা বাসমতি হলেও চলবে) ও ডাল (মুগ ও মুসরীর সম-মিশ্রণ) ১:১ অনুপাতে মিশিয়ে ভালো করে ধুতে হবে। তারপর পরিমাণমতো বিভিন্ন শ্রেণির সবজি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ধুয়ে কাটতে হবে। মসলার মধ্যে আদা ও রসুনের পেস্ট, লবন, জিরা গুড়া, ধনিয়া গুড়া, হলুদ গুড়া ও শুকনা মরিচের গুড়া, সাথে একটু পাঁচফোড়ন লাগবে। স্বাস্থ্যকর সানফ্লাওয়ার তেল ও সামান্য ঘি খিচুড়ির স্বাদ করে অতুলনীয়!

এবার একটি কড়াইয়ের মধ্যে ঘি বাদে সবকিছু একসাথে ভালো করে মিশাতে হবে যাতে তেল-মসলা-চাল-ডাল-সবজি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এরপর কড়াইসমেত খিচুড়ি মিশ্রণটি মাঝারি আঁচে রাখা চুলার উপর নিয়ে ভাজতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত খিচুড়ির সুগন্ধ বের হয়। তারপর খিচুড়ি মিশ্রণের দ্বিগুণ আয়তনেরও একটু বেশি জল (গরম হলে ভালো) দিয়ে রান্না করতে হবে। খিচুড়ি রান্না হয়ে গেলে চুলা থেকে নামানোর আগে ঘি দিয়ে ভালো করে মিশ্রিত করতে হবে। ব্যস হয়ে গেল পুষ্টিকর খিচুড়ি!

কী, মনে হচ্ছে না প্রশিক্ষক তো খিচুড়ি রান্নার কলাকৌশল সব বলেই দিয়েছেন! তাহলে আর কষ্ট করে কেন পার্থে আসব?

আপনি ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু আপনারা তো আর খিচুড়ি রান্নার জন্য আসবেন না, আসবেন প্রমোদ ভ্রমণে। সরকারের অন্যান্য ক্ষমতাধর বিভাগের কর্মকর্তারা যেমন আসেন আর কি! সেটা আপনারা যেমন জানেন, এখানকার প্রশিক্ষকমণ্ডলীও তেমন জানেন। তাই তো খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষক কোনোরূপ কার্পন্য ছাড়াই থলের বেড়াল বের করে দিয়েছেন আপনাদের মতো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়া বিভাগের সাহায্যার্থে। তাছাড়া এই বিদেশী প্রশিক্ষণ প্রকল্পে যারা খিচুড়ি রন্ধন কার্য ও বিতরণের কাজে সরাসরি যুক্ত থাকবেন, সেসব নিচুতলার মানুষদের কারও ভাগ্যে যে প্রশিক্ষণের ভিসা জুটবে না, সেটা বুঝতেও পণ্ডিত হওয়া লাগে না!

যাহোক, তো আপনারা খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণের উছিলায় পার্থে আসলে কী কী দেখতে পাবেন তার একটা ফিরিস্তি দেওয়া যাক। অস্ট্রেলিয়া বরাবরই টুরিস্টদের জন্য একটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় দেশ। হবে না-ইবা কেন? দেশটিতে যে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশের নাগরিকই বাস করে। যেই আসুক, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব পেয়ে যায়। তাছাড়া অভ্যস্ত খাবার-দাবারেরও কোনো সংকট নাই। তবে পর্যটকদের কাছে সিডনি বা মেলবোর্ন যেমন আকর্ষণীয়, সেই তুলনায় পার্থ অনেক পিছিয়ে আছে। অথচ পার্থে অনেক কিছু দেখার আছে।

প্রথমেই আপনাদেরকে নিয়ে যাব রটনেস্ট আইল্যান্ডে। এই দ্বীপটি পার্থ শহর থেকে ফেরিতে মাত্র পৌনে এক ঘন্টা লাগে। খুবই কিউট প্রাণী কোকার (Quokka) একমাত্র আবাসস্থল এই দ্বীপ, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। তা ছাড়াও এই দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অপরূপ। তাছাড়া সাদা বালির বিচ (beach), সার্ফারদের জন্য এটা আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান।

এর পরেই বলব পিংক লেকের কথা। পার্থ শহর থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অ্যাসপারেন্স এলাকায় ৯৯ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত গোলাপী রঙের এই নয়নাভিরাম লেকটি।

পার্থ শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাড়ে তিন ঘন্টার ড্রাইভিং দূরত্বে অবস্থিত ছোটখাটো সাজানো টাউন মার্গারেট রিভার (Margaret River)। এটা সার্ফারদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এখানে প্রায় ৪০টি সার্ফিং স্পট আছে। তবে শহর থেকে একটু দূরে নিরিবিলি এই সুন্দর ছিমছাম এলাকায় মানুষ ছুটি কাটাতে বেশ পছন্দ করে।

তাছাড়া পেঙ্গুইন আইল্যান্ডও বেশ সুন্দর। মাত্র ১২ হেক্টরের ছোট্ট একটা দ্বীপ এটি, যার মধ্যে প্রায় ১২০০ পেঙ্গুইনের বসবাস। এটি পার্থ শহর থেকে সড়কপথে মাত্র ৪৫ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত শোয়ালওয়াটার থেকে ৭০০ মিটার দূরত্বে অবস্থিত, ফেরিতে যেতে মাত্র পাঁচ মিনিট লাগে। সমুদ্রে ডলফিনের সাথে সাঁতার কাটতে চাইলে এই দ্বীপটি হতে পারে সবার প্রথম পছন্দের।

পার্থে আসবেন আর দ্য পিনাকলস দেখবেন না, তা কি হয়? এটি পার্থ থেকে প্রায় দুই ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত নামবাং ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত। হলুদ বালির ওপর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট লাইমস্টোনের ছোট ছোট হাজার হাজার পিলার পিনাকল নামেই পরিচিত। ছোট এই মরুভূমিতে হাঁটতে কষ্ট হলে ড্রাইভ করে ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে।

ওয়াইন পান করা হারাম হলেও ওয়াইনারি দেখা তো দোষের কিছু না! পার্থ এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ১০ মিনিটের ড্রাইভিং দূরত্বে অবস্থিত সোয়ান ভ্যালি (Swan Valley)। এর আয়তন প্রায় ৭০ বর্গ কিলোমিটার। থরে থরে সাজানো আঙুর ক্ষেত দেখতে কার না ভালো লাগে! মৌসুমে খামারির কাছ থেকে সরাসরি রসালো আঙুর কিনে খাওয়ার মজাই আলাদা। তাছাড়া এখানে একটি চকলেট ফ্যাক্টরি ও একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি আছে, যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।

তাছাড়া পার্থ শহরটাও অত্যন্ত সুন্দর, সাজানো-গোছানো পরিপাটি। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন মেগাসিটি। পার্থের নিকটবর্তী শহর হলো অ্যাডিলেড যার দূরত্ব প্রায় ২৭০০ কিলোমিটার। শহরের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে কিংস পার্ক, সোয়ান রিভার, নর্থব্রীজ অন্যতম। সমুদ্র সৈকতের মধ্যে কটেজ'ল, স্কারবোরো, সিটি বিচ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া বিশ্ব র‍্যাংকিং-এ ১০০ এর মধ্যে থাকা ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এই পার্থ শহরে অবস্থিত।

সার্বিকভাবে বলা যায়, পার্থ একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় কিন্তু তুলনামূলকভাবে অবহেলিত পর্যটন নগরী। তাই খিচুড়ি রান্না শেখার ছলে হলেও যদি কেউ পার্থে আসেন, নিরাশ হবেন না – এ কথা হলফ করে বলতে পারি।