স্বাধীন বাংলা বেতার ও বেলাল মোহাম্মদ এর একটি ভুল তথ্য

Published : 16 Sept 2020, 04:17 PM
Updated : 16 Sept 2020, 04:17 PM

মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদ হলেন। তিনি বেতার কেন্দ্রের সংগঠকদের মধ্যে অগ্রদূত। তার কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে বাধ্য হচ্ছি তিনি তার নিবন্ধে যে তথ্য দিয়েছেন তা কোনভাবেই বস্তুনিষ্ঠ না। তিনি তার "বেতার- মুক্তি সংগ্রামে" নিবন্ধে লিখেছেন, "বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের ভাষণটি  চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রথম ৭ই মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রচার করা হয়েছিল।"

এ ভাষণের উপর দীর্ঘ ১৩ বছরের গবেষণায় আমি যা পেয়েছি তাতে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারি উপরের তথ্যটা কোনভাবেই সত্য না।  ভাষণটি প্রথম প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭১ এর ৮ মার্চ সকালে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে। এ ভাষণ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ধারণ করেনি বা তাদের কোন কলা-কুশলী সেদিন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিল তার কোনও প্রমাণ নেই। পূর্ণাঙ্গ ভাষণ ধারণ করেছিলেন নাসার আহমেদ চৌধুরী। তিনি ভাষণটি ধারণ করার পর  টেপ দুটো  তার  জামার মধ্যে  লুকিয়ে ফেলে গা ঢাকা দিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সেদিন বেতারের কলাকুশলীরা নিজ বাসায় না যেয়ে হাতিরপুলের একটা বাসায় রাত কাটিয়েছিলেন। সেই সময় এখনকার মতো ইন্টারনেট ছিল না যে, হাতিরপুলে বসে ডেটাগুলো চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছিল। আর চট্টগ্রাম সেটা বাজিয়েছিল।

জনাব নাসার আহমদ চৌধুরী আমাকে পরিষ্কার জানিয়েছেন, পরদিন সকালে বেতার কর্মচারীরা সেনাবাহিনীর বিশেষ অনুরোধে  কর্মবিরতি স্থগিত করে। এরপর একটা জরুরি ঘোষণা দিয়ে  ধারণকৃত ভাষণটা  বাজানো হয়েছিল। সেই ঘোষণাটিও হাতিরপুলের সেই বাসায় বসেই লেখা হয়েছিল। পরদিন সকালে  অর্থাৎ ৮ মার্চ যদি চট্টগ্রাম রেডিও সেটা রিলে করে থাকে, সেটা সম্ভব। কিন্তু তার আগে কোনও বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণটি বাজানো হয়েছিল এই জাতীয় তথ্য সত্যের অপলাপ। সেটা বিকৃত তথ্য আমি বলবো না, তবে ভুল তথ্য।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাষণটি যিনি ধারণ করেছিলেন তাকে মূল্যায়ন করা হয়নি আজ পর্যন্ত।  কিছুদিন আগে তিনি যখন সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন, তখন আমি লিখেছিলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে। এরপর জার্মান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এর সভাপতি মাহফুজ ফারুক আমাকে ফোন করলেন। জানালেন সরকারের দুইজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তারা জনাব চৌধুরীর জন্য কিছু করতে চান। তাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারে, আমি যেন নাসার ভাইয়ের সাথে কথা বলে তাদেরকে অবহিত করি।

আমি নাসার ভাইকে টেলিফোন করে জানতে চাইলাম- তাকে সরকার কিভাবে সাহায্য করতে পারে। তিনি জানালেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চান। আর সরকার তার এই বিপদের মুহূর্তে যদি আর্থিক কিছু সাহায্য করে, তিনি চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন।  আমি  তার ইচ্ছার কথা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সভাপতিকে জানালাম।  এরপরে কী হয়েছে আমাকে জানানো হয়নি। তবে এটা নিশ্চিতভাবে জানি, নাসার ভাইকে এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেওয়া হয়নি। এবং সরকার তাকে কোন আর্থিক সহায়তাও করেনি।

নাসার ভাই ৭ই মার্চ যে ভূমিকা রেখেছেন, তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী তার নির্বাহী ক্ষমতা বলে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলেই মনে করি। নাসার আহমেদ চৌধুরীকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ প্রদান করলে কোন প্রশ্ন উঠবে না। বরং জাতি আনন্দিত হবে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে দায়মুক্তি থেকে। মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাবে। নাসার ভাইয়ের খোঁজ নেব তিনি কেমন আছেন, সেটাতে আমি এখন লজ্জা পাই। কারণ আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যখন খোঁজ নিয়ে যোগাযোগ করেছেন, তখন কিছু না কিছু একটা হবেই। অথচ সে ব্যাপারে এখন কোন কথা নেই। কেন যে তারা আমাকে এরমধ্যে জড়িয়েছিল জানিনা। তবে  মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে  আবেদন থাকবে, নাসার আহমেদ চৌধুরীর মত হাই-প্রোফাইল বিষয়গুলো বিবেচনা করে বাধিত করবেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে জানি তার মত রাজনীতিবিদ এবং মন্ত্রী আমি খুব কম দেখেছি। আমি আশাকরি এই বিষয়টি নজরে এলে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন। তবে সরকারের যে দুজন কর্মকর্তা যোগাযোগ করেছিলেন তারা যদি মন্ত্রী মহোদয়কে ব্যাপারটা জানাতেন, আমার মনে হয় খুব দ্রুত কাজ হয়ে যেত।  জীবদ্দশায় নাসার আহমেদ চৌধুরীকে সম্মানিত করার দৃঢ় দাবি  রাখছি।

জীবদ্দশায় বেলাল মোহাম্মদ অনেক সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন।  কিন্তু তাদের একজন সহকর্মী জীবন বাজি রেখে যে ভূমিকা রেখেছিলেন তাকে মূল্যায়ন করেননি।  এটা অপরাধ না হলেও, অন্যায় তো বটে।  কারণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে যারা দেশের মধ্যে থেকে কাজ করেছেন, তাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়নি। অথচ যুদ্ধের সময়ে নাসার আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ বেতার থেকে দেশাত্মবোধক গানের রেকর্ডগুলো নিয়ে নারায়ণগঞ্জের একজন মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন।