‘দ্য ডিন’ – আইন অঙ্গনের এক জ্ঞানযাজক

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 2 Sept 2020, 10:57 AM
Updated : 2 Sept 2020, 10:57 AM

Tryst with knowledge প্রোভার্বিয়াল মর্যাদা পাওয়া বাক্যটি একটু টুইস্ট করে বলা হলো কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে তার অভিসার অভিমান সব ছিল জ্ঞান সংক্রান্ত। জ্ঞান ছিল তার একান্ত অভিমুখ। শিক্ষকতা ছিল তার অহংকার, তার গড়া আইন অনুষদ ছিল গর্ব। নিশ্চিতভাবে এ দুটো তার দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাসকে আরও জোরালো হতে সাহায্য করেছিল। পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রিয় ছাত্রদের মনে কান্না জাগিয়ে বিদায় নিলেন স্যার। প্রফেসর ড. শাহ আলম। বিশেষণহীন কেবল তার নামটাই এক পরিচিতি, এক প্রতিষ্ঠান আমাদের কালের মহীরুহ এক জ্ঞানযাজক।

প্রায়শই মধ্য দুপুরে গনগনে সূর্যকে সাক্ষী রেখে পরিপাটি পোশাকের সৌম্য সুদর্শন ছোটখাট গড়নের মানুষটি যখন হাতে স্বরচিত 'সমকালীন আন্তর্জাতিক আইন' বইখানি সাথে ক্লাস লেকচার প্রাসঙ্গিক সদ্য প্রকাশিত 'ঢাকা কুরিয়ার' কিংবা 'দ্য ডেইলি স্টার'-এর আর্টিকেলের ফটোকপিসহ ক্লাস নিতে বের হতেন, তখন হয়তো আইন বিভাগের লাগোয়া ঝুপড়িগুলোতে আড্ডা প্রিয় ৬ষ্ঠ ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা খুনসুটি আর গান-বাজনায় ব্যস্ত। কিন্তু এরই মাঝে ক্লাসপ্রিয় নিয়মিত ছাত্রের সতর্ক দৃষ্টি বিভাগের প্রশাসনিক ভবনের দিকে, স্যারকে অনুসরণ করে। প্রশাসনিক ভবন থেকে ক্লাসরুমের দূরত্বের মাঝামাঝি ওই পথটুকুতে দেখা যেত শিক্ষক সামনে আর পেছনে তার ছাত্ররা যেন হেঁটে চলেছেন সক্রেটিস ও তার শিষ্যরা। সেই দৃশ্যের নামকরণ করেছিলাম "দ্য ডিন অ্যান্ড দ্য ফলোয়ার"।

ছাত্রজীবনের প্রতিটি ধাপে দুর্দান্ত ফলাফল করা ড. শাহ আলম স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। ডক্টরেট করে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরই তার শিক্ষকতা জীবনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ পর্ব। নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ। বাংলাদেশের আইন শিক্ষার ইতিহাসে সবচেয়ে আধুনিক পাঠ্যক্রম ও তার যুগোপযোগী ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পথচলা শুরু। প্রথম বর্ষেই জুরিসপ্রুডেন্স-এর মতো কঠিন তাত্ত্বিক বিষয় পড়িয়েছেন সহজবোধ্য সাবলীলতায়। কেলসেন, অস্টিন, স্যালমন্ড প্রমুখের মতবাদ অন্যদিকে রাইট ইন রেম, রাইট ইন পারসোনা, মেনস রিয়ার সমতো গ্রীক ল্যাটিন পরিভাষার কাঠিন্য ও দুর্বোধ্যতার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিত স্যারের ইলাস্ট্রেটেড উপস্থাপনা। চতুর্থ বর্ষে তার আন্তর্জাতিক আইনের ক্লাসগুলো ছিল সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি ও বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামো অনুধাবনের। নাইন ইলেভেন পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান আক্রমণ ও ইরাক দখল তথা একমেরু বিশ্বের জাতিসংঘকে অমান্য করে বুশের দমননীতির তীব্র সমালোচনায় পূর্ণ ছিল তার তখনকার ক্লাসগুলো। তার লেকচারে মুগ্ধ, বিস্মিত এবং বিচলিত হতে হতে স্থানিক দূরত্ব ভুলে কল্পনার ব্রাসেলস কিংবা ডাবলিনে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে শরীক হতাম আমরাও।

জ্ঞান আহরণ, অর্জন আর তা ভাবীকালের পাঠকের জন্য রচনা করা আইনের বইগুলোতে পাওয়া যায় স্টাইল ইজ দ্য ম্যান হিমসেলফ প্রফেসর ড. শাহ আলম। তার রচিত বিভিন্ন আইনগ্রন্থ বাংলাদেশের আইন প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত 'আন্তর্জাতিক সংগঠন' এবং 'সমকালীন আন্তর্জাতিক আইন' বই দুটো আন্তর্জাতিক আইনের শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তার গুণমুগ্ধ অনুজপ্রতিম মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, "আমার জানামতে আন্তর্জাতিক আইনের বিশাল ক্ষেত্রকে ছাত্র-ছাত্রীদের উপযোগী করে রচিত কোনো সুলিখিত গ্রন্থ অদ্যাবধি বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়নি। সমকালীন আন্তর্জাতিক আইন এরূপ প্রথম গ্রন্থ"।

২০০৬ সালে দেশে আইন শিক্ষার উন্নয়নের ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য আইন কমিশন তাকে দায়িত্ব দেয়। সুদীর্ঘকালের শিক্ষা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তিনি যথা জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি। বিচারপতি মোস্তফা কামাল ছিলেন তখন কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার নির্যাসে জারিত ৭০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বর্তমান আইন শিক্ষার ব্যাপক পরিবর্তন-পরিবর্ধনের জন্য। তিনি বাস্তবিক অনুধাবন করেছিলেন, এই শিক্ষার পরিবর্তন না হলে তা তেমন কোনো কাজে আসবে না। আইন শিখে ছাত্ররা দেশের জন্য কোনো অবদান রাখতে পারবে না। বার বা বেঞ্চ কোথাও লক্ষণীয় ও মানসম্মত ভূমিকা রাখতে পারবে না। এসবের উন্নয়নের জন্য আইন শিক্ষাই মূল প্রভাবক। তিনি বলেন- "আইন জনগণের স্বার্থে। আইন শিক্ষাকে যদি আমরা গণমুখী করতে পারি, শুধু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা না দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনের বাস্তব প্রয়োগটা দেখাতে পারি; তাহলে এ শিক্ষা কাজে দেবে। তা না হলে আইন শিক্ষা শুধু আইন শিক্ষার মধ্যেই থেকে যাবে" (সুত্র-দৈনিক কালের কন্ঠ ২২-১০-২০১২)। অভিমানাহত হয়ে বলেন আমার জানা মতে, এ পর্যন্ত ওই সুপারিশের কোনো অংশই বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়নি সরকার। এভাবে কমিশনের বেশির ভাগ সুপারিশই পড়ে আছে। আসলে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রচলিত আইন শিক্ষায় ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবকে তিনি মানতে পারতেন না। তিনি তার শিক্ষকতা জীবনে ব্যবহারিক শিক্ষাবিহীন আইন শিক্ষা পাঠক্রমকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তার প্রতিবিধানে প্রচণ্ডভাবে সচেষ্ট ছিলেন। তার পৌরহিত্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বোধ করি প্রথম পাবলিক ইউনিভার্সিটি যেখানে ক্লিনিক্যাল ল'কে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করে। যার সোনালী ফসল আলো ছড়াচ্ছে দেশের বিচার বিভাগে, ব্যবহারজীবী হিসেবে দেশের উচ্চ আদালতসহ সর্বত্র। তার সব ছাত্ররা নিশ্চিতভাবে তার জ্বালিয়ে দেয়া আলো দিয়ে আলোকিত করে রাখবে আইনের সব আঙ্গিনা।