রামু নৃশংসতা : ঘৃণ্যতম অপরাধ

বেবী মওদুদ
Published : 11 Oct 2012, 11:57 AM
Updated : 11 Oct 2012, 11:57 AM

রামু নৃশংতা আমাদের বিবেককে প্রচন্ডরূপে ধাক্কা দিয়েছে। আমরা কী মানুষ, সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ? আমাদের মানবিকতাকে কলঙ্কিত করেছে। কেন এই হিংস্রতা ? আমাদের মধ্যে ন্যূনতম সহিষ্ণুতা ও মনুষত্ব বোধ থাকলে সেদিন এ ঘটনাটি ঘটতো না। যারা এ ঘটনার জন্য দায়ী তাদেরকে অবশ্যই বিচারের সামনে আনতে পারে, তাকে অবশ্যই তার ঘৃণ্য অপরাধের জন্য শাস্তি দিতেই হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোন ব্যক্তি বা শক্তি বা গোষ্ঠী এমন অপরাধ করার যেন সাহস না পায়।

বাংলাদেশের মাটি দুর্জয় ঘাঁটি–এটা কবিতা কথা। বাংলাদেশের মাটিতে আমরা মানবধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছি, সেই ভাবে কবি বলেছেন 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'। বাংলার মাটিতে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে সকলের বসবাস। নিজ নিজ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রেখে আমরা যেমন তা পালন করি, তেমনি অপর ধর্মের প্রতিও রয়েছে আমাদের শ্রদ্ধাবোধ; আমরা প্রতিবেশি হয়ে জীবনযাপন করি, একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী, ভালো-মন্দের ভাগীদার। যার যার উৎসব-পার্বনে আমরা শুভেচ্ছা বিনিময় করি এবং খাওয়া-দাওয়া করি। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বলে তাদের ঘরে আগুন দেব, হামলা করবো এবং মন্দির-প্যাগোডা ও গীর্জায় হামলা করে ভাংচুর লুটপাট করবো ? এ কেমন নিষ্ঠুরতা ? একে কবি বলেছেন ধর্মের নামে বজ্জাতি !। এ ব্যাপারে কোন প্রকার হিংসা, বিদ্বেষ-দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে বিভেদ সৃষ্টি করা, উত্তেজনা গড়ে তোলা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা এবং অমানবিকতা। এই নগ্ন বা নোংরা খেলার যারা ক্রীড়নক তারা কখনও মানুষ নয়, শয়তানের মানসপুত্র এবং মানবসভ্যতার নিকৃষ্টতম প্রাণী।

বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের বেশি হবে। শান্তির ললিত বাণী প্রচার করে গৌতমবুদ্ধ মানুষের মনে সম্প্রীতি এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তার সেই প্রয়াস বৃথা যায়নি। বৌদ্ধ ধর্মের মাহাত্ম্যে আমরা অহিংসার মহৎ উচ্চারণ শুনে থাকি। পাশাপাশি সব ধর্মেই আমরা শান্তি ও সম্প্রীতি উচ্চারণ শুনে থাকি। সেটাই এই দেশের অসাম্প্রদায়িক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষ দৃঢ়তায়, সাহসে ও দেশপ্রেমে শক্তিশালী করে তুলেছিল এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মূল্য বোধ। বাঙালি হিসেবে বিশ্বে এটাই ছিল আমাদের গর্ব ও গৌরবের প্রধান বিষয়। সেই অবস্থান থেকে আমরা আজ কোথায় নেমে এলাম, এটা কি ষড়যন্ত্রকারী, লুটেরা ও ধ্বংসকারীরা বুঝতে পেরেছে ? পারেনি, পারবেও না ! কেননা তারা পশু, এরা হায়েনার বংশধর। এদের পূর্বসুরীরা যুগে যুগে শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপরে হামলা করেছে।

হত্যা, দখল, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘৃণ্যতম কর্মকান্ড দ্বারা সমাজকে কলুষিত করেছে, মনুষত্বের অবমাননা করেছে। এরা সভ্য হতে জানে না, বিবেকহীন এইসব অপরাধীদের নির্মূল করতে না পারলে এদেশের ভবিষ্যত কী হবে ভাবতেই আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি। ইসলাম ধর্মসহ সব ধর্মেই আছে 'শত্রুকে ক্ষমা কর'। কিন্তু কোন কোন শত্রু মারাত্মক ছোবল দেয়ার জন্য ওৎ পেতে থাকে-কখন কাকে কোথায় শেষ করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যারা মেনে নিতে পারেনি, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সবরকম ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে সহায়তা করোছিল তারা হলো সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। এরা ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের প্রধান সহায়ক ছিল। তারাই এদেশে বারবার অন্য ধর্মাবলম্বীদেরউপর হামলা চালিয়ে তাদের উপাসনালয় ভাংচুর করে লুটপাট করেছে। এরাই দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটিয়েছে। তারপর সুযোগ বুঝে কখনও রগকাটা, কখনও গ্রেনেড হামলা, সারাদেশে একই সময় বোমাবাজি, ইত্যাদি অপকর্ম করে সন্ত্রাসের শাসন কায়েম করেত চেয়েছে। এরাই একাত্তরের ঘাতক দালাল আলবদর-রাজাকারদের বংশধর। এরা বাঙালির জান শত্রু। বাঙালির অস্তিত্ব এদের সহ্য হয় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে এরা মুছে ফেলতে চায়।

রামুর ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এর পেছনে অনেক বড় ষড়যন্ত্রকারীরা রয়েছে যারা শুধু সাম্প্রদায়িক শক্তিই নয়, তাদের মদদকারী বিদেশী শক্তিও রয়েছে। বলা হচ্ছে রোহিঙ্গারা জড়িত রয়েছে। পাঁচ লক্ষ রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও এর আশেপাশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ যাতায়াত করছে, মাদকসহ বিভিন্ন ব্যবসা পর্যন্ত গড়ে তুলেছে। এরাই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সময়ে এদের শেকড় শুদ্ধ উপড়ে না ফেললে বাংলাদেশের জন্য এরাই হুমকি হিসেবে চিহ্নিত হবে। রামু ঘটনার পর সরকারের এখন নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশয় নয়, তাদের স্বদেশ ফেরত পাঠাতে বাধ্য করা হোক। আর রামু ঘটনার নৃশংসতার জন্য প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। সবার ওপরে মানুষ সত্য স্বীকার করি, তারপরও মানুষ নামধারী ধর্মের নামে বজ্জাতী' করে বেড়াবে যারা তাদের প্রতি আর করুণা বা ক্ষমা নয়। আমার সমাজ, আমার দেশ, আমার মানুষকে যারা অপমান করে আমরা অবশ্যই তাদের ঘৃণা করি।
৮.১০.২০১২
ঢাকা

বেবী মওদুদ: লেখক ও সাংবাদিক।