১৫ই অগাস্ট ট্র্যাজেডি: মানবতার প্রতি চরম আঘাত

জুনাইদ আহমেদ পলক
Published : 29 August 2020, 08:23 PM
Updated : 29 August 2020, 08:23 PM

অগাস্ট মাস শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের এই মাসের ১৫ তারিখ দুর্ভাগ্যজনক ভয়াল রাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে কিছু উচ্চাভিলাষী বিপথগামী  সেনাসদস্য, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নির্মমভাবে হত্যা করে। আত্মস্বীকৃত ওই খুনিরা সেই কালরাতে রেহাই দেয়নি ১০ বছর বয়সী শিশু শেখ রাসেলকেও !

নিজের দেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল সীমাহীন ভালোবাসা। প্রাণের চেয়েও তিনি বেশি ভালোবাসতেন দেশের মানুষকে। একদিকে, দেশের মানুষই ছিল তাঁর শক্তি ও প্রেরণার উৎস। অন্যদিকে, তাঁর  বড় দুর্বলতার দিকটিও ছিল দেশের মানুষের প্রতি এই সীমাহীন ভালবাসা। ১৯৭২ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাতৎকার গ্রহণকালে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "আপনার সবচেয়ে বড় শক্তিটি কী? বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, আমি আমার জনগণকে ভালবাসি।" এরপরই ফ্রস্ট তাকে প্রশ্ন করেন "আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?" উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, "আমি তাদের খুব বেশি  ভালবাসি।"

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয় পর্বত সমান উচ্চতার। আর তাইতো কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিডেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,

I have not seen the Himalayas. But I have seen Sheikh Mujib. In personality and in courage, this man is the Himalayas. I have thus had the experience of witnessing the Himalayas.

বঙ্গবন্ধু কেবল বাংলাদেশের নন, সারা বিশ্বের বঞ্চিত, নিপীড়িত ও মুক্তিকামী মানুষের পক্ষের কণ্ঠস্বর ছিলেন। এই নির্মম নৃশংস বর্বোরোচিত ঘটনায় গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাদের কাছে বড় প্রশ্ন থেকে যায় যে, বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে অনুসরনীয়, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা যার জীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি তাকে কেন হত্যা করা হবে? বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল যে মহান নেতা দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সংগ্রাম করে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে কারা অভ্যন্তরে কাটিয়ে একটি জাতিকে রাষ্ট্রভাষা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব উপহার দিল তাকে তার দেশের মানুষের হাতে শাহাদৎ বরণ করতে হল !

প্রশ্ন হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীরা  বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল কেন? এর উত্তর খুব কঠিন নয়। যদি বিশ্লেষণ করা হয় তবে আমরা দেখতে পাব যে, এটি ছিল ৭১ এর  মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ নেয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানিরা যে ষড়যন্ত্রকারী এটা বঙ্গবন্ধু অনেক আগে থেকেই জানতেন। তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৭৮) লিখেছেন,

পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরোপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।

১৯৪৮ সালে, পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাস পরে তারা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। তারা ঘোষণা দেয় উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে। তরুণ শেখ মুজিবসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা  হিসেবে ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভের সময় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ  তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করেন। ২৩ বছরে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি নিরস্ত্র বাঙালিকে ধাপে ধাপে সশস্ত্র  মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন।

বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ১৪ বছর কারা অন্তরীক্ষে বন্দি জীবন কাটান। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে মামলাটি প্রত্যাহারে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার চেষ্টা করে, কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমরা মহান স্বাধীনতা অর্জন করি। পাকিস্তানি কারাগার  থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্নির্মাণ এবং সোনার বাংলায় পরিণত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করেন। তবে, দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭১-এ এরকম অপমানজনক শোচনীয় পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। তারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হয় মিথ্যা অপপ্রচার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অশুভচক্র ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরাই অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট রাতের অন্ধকারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।

১৫ই অগাস্টের এই ঘটনা মানবতার উপর চরম আঘাত। প্রশ্ন হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও সুবিধাভোগী কারা ছিল? ১৫ই অগাস্ট ক্যু সংঘটনের পর পরই ক্ষমতা দখল করে খন্দকার মোস্তাক আহমেদ। এদিন সকালেই সামরিক আইন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র ৪১ দিনের মাথায় ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক একটি কালো আইন জারি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা এই কালো আইনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট সকালে সামরিক আইন ঘোষণার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া রুদ্ধ করা। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে এবং সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার এবং ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ সালের মধ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল পদক্ষেপকে বৈধতা দেয়। অবৈধ জিয়া সরকার বিদেশি মিশনে লাভজনক চাকরি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুনর্বাসন করে এবং বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রাজনীতি করার অনুমতি দেয়। এ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল হোতা এবং সুবিধাভোগী কারা ছিল  তা বোঝা কি খুব কঠিন?

বঙ্গবন্ধু হত্যা কোন সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল না। এই কিংবদন্তী মহান নেতাকে হত্যা করার অনেক কারণ আছে। কিছু কিছু আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাদের পরাজয় মেনে নিতে পারেনি; দ্বিতীয়ত, তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করা মেনে নিতে পারেনি; তৃতীয়ত, তারা পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন মেনে নিতে পারেনি এবং চতুর্থত, দক্ষিণ এশিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের মতো জাতীয়তাবাদী নেতার উত্থান এবং বিশ্ব নেতা হয়ে ওঠা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। যেহেতু ইন্দো-সোভিয়েত অংশ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে, নব্য স্বাধীন দেশটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারি দল বাংলাদেশ আওযামী লীগের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসুরী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে পাওয়া। তিনি প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রাম করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বাধা দূর করেন।

দীর্ঘ ২১ বছর বিচারহীনতার কলঙ্ক মোচন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন। বঙ্গবন্ধু  হত্যা বিচারের রায় ঘোষণা হলেও ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় এসে সে রায় কার্যকর হতে দেয়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আবারো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলে আবার শুরু হয় প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়। কিন্তু অভিযুক্তদের কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকায় বিচারের রায় আংশিক কার্যকর হয়।

আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি খুনি পলাতক আসামী রাশেদ চৌধুরী এবং অপর খুনি পলাতক আসামী নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নাগরিকদের আহ্বান জানাই তারা যেন তাদের সরকারকে অনুরোধ করেন এই নৃশংস হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক আশ্রয় থাকা খুনিদের বাংলাদেশে দ্রুত ফেরত পাঠাতে। বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের রায় কার্যকর করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাসহ সকল দেশের সরকারের কাছে জোরালো দাবি জানাতে।

ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। কিন্তু তারা তার নাম বাঙালি জাতির অন্তর থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "নেতার মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।" বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে থাকবেন চির অম্লান।