বঙ্গবন্ধু প্রথম কখন ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলেন?

Published : 24 August 2020, 03:40 PM
Updated : 24 August 2020, 03:40 PM

বঙ্গবন্ধু এমন একজন ব্যক্তিত্ব অনেক ক্ষেত্রে যার নামের আগে হাজার বিশেষণে বিশেষায়িত করলেও যথেষ্ট মনে হয় না। আবার বিশেষক্ষেত্রে মাত্র একটা বিশেষণই তাকে এতটা মহিমান্বিত করে যে অন্য কোন বিশেষণের দরকারই হয় না। যখন তাকে 'বঙ্গবন্ধু' বিশেষণে ভূষিত করা হয় তখন এই প্রশ্ন আসে না তিনি কোন দেশের? তখন তিনি বঙ্গের বন্ধু বা বাঙালির বন্ধু। আর যখনই তাকে জাতির জনক বা জাতির পিতা হিসাবে বিশেষায়িত করা হয় তখন তিনি শুধু বাংলাদেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু আসলে নিজ যোগ্যতায় বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে নিজেকে বিশ্ব নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন সেই ১৯৫২ সালেই। তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত হননি। কিন্তু ১৯৫২ সালের চীন সফরের সেই শান্তি সম্মেলনেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আসছেন বাঙালির ত্রাণকর্তা হয়ে এবং বিশ্ব নেতাদের অন্যতম একজন হয়ে।

১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বর মাসের ৫ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনের চতুর্থ আসর বসেছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সম্মেলনে যোগদান করে প্রমাণ করেছিলেন বিশ্বে তার অবস্থান। সম্মেলনের সভাপতি ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদীন, একজন করে নেতা মঞ্চে এসে দাঁড়াবার পর প্রেসিডেন্ট বুমেদীন ক্ষুদ্র বক্তৃতায় তাদের পরিচয় প্রদান করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হলে উপস্থিত সমস্ত প্রতিনিধিরা করতালির মধ্য দিয়ে জানিয়েছিলেন উষ্ণ অভিনন্দন। পিএলও-প্রধান ইয়াসির আরাফাতের পরিচিতির সময় করতালি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতির পর সম্মেলন কক্ষে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। সম্মেলন কক্ষের প্রতিটি মানুষ আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে চলেছিল, সে করতালি যেন আর থামবার না। তিন মিনিটের বেশি সময় ধরে এক নাগাড়ে করতালির পর প্রেসিডেন্ট বুমেদীনের ইশারায় সবাই আবার আসন গ্রহণ করেছিলেন। (তথ্যসূত্র: মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল)

১৯৩০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে সকল গোয়েন্দা রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে, তা দেখলে বোঝা যায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর উত্থান এবং জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু যত জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন ততই তার জীবনের আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সেনাশাসক এবং রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। তাকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য সামরিক এবং বেসামরিক চক্র অনেক হীন ষড়যন্ত্র করেছে।

১৯৫২ সালে চীন সফরের পর বঙ্গবন্ধু একটা ভ্রমণ কাহিনী রচনা করেন, যেটা আমার দেখা নয়া চীন নামে প্রকাশিত হয়েছে বর্তমানে। ১৯৫২ সালে চীন সফর করলেও বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে। সেই গ্রন্থে তিনি দু/তিন বার রাষ্ট্রদূতদের দুর্নীতি এবং কর্ম তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন দুর্নীতিবাজ আমলা কাল-কেউটের চেয়েও বিষধর। আর সার্বিকভাবেও আমলারা নিজেদের স্বার্থে সর্বদা একতাবদ্ধ সে দুর্নীতিবাজ বা সৎ যাই হোক। কামলার ছেলে আমলা হলেও সে নিজের আগের অবস্থান মনে রাখে না। খুব দ্রুত ভুলে যায় তার পূর্বের জীবনকে। এবং আমলাদের তথাকথিত অভিজাত শ্রেণিতে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে সব রকমের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তা বৈধ বা অবৈধ যাই হোক না কেন। তাই আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালেই তার জীবনকে বিপদসংকুল করে তুলেছেন রাষ্ট্রদূতের কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগের মাধ্যমে। সাপের লেজে পাড়া তিনি সেদিনই দিয়ে ফেলেছিলেন। তখনই দুর্নীতিবাজরা সতর্ক হয়েছে এবং তৎপরতা শুরু করেছে স্পষ্টবাদী, সৎ ও শোষিতের নেতা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধুর অবৈতনিক সহকারী হাজী গোলাম মোর্শেদ এক স্মৃতিচারণে বলেন, "১৯৭২ সালের ২৪ মে টাইপ করলাম- 'সকল পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করিতে হইবে। সচিব হইতে অধস্তনরা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সকল ফাইল ডিসপোজাল করিবেন। ফাইল আনা-নেয়ায় পিয়ন ব্যবহার করা যাইবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ফাইল আনা-নেয়া করিবেন।'

"বঙ্গবন্ধু দুইবার পড়ে তাতে সই করলেন। অর্ডার নম্বর ১১৪ জারি হয়ে গেল। সরকারি কর্মকর্তারা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন।" (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৪ অগাস্ট, ২০১৪) এই ঘটনার পর আমলারা বসে থাকেনি নতুন উদ্যমে চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু মামলার জট শেষ করতে চেয়েছিলেন এজন্যও বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিয়ে ভেবেছিলেন। থানা পর্যায়ে আদালত, গ্রামীণ সালিসি বোর্ড। যাতে কম মামলা হয়। মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রেখে যাতে আদালতের বাইরে ঝামেলার নিষ্পত্তি করা যায় ইত্যাদি। মামলা কমলে উকিল বিচারপতি উভয়েরই আয় কমবে। এসব ব্যাপারগুলো বিচারপতি এবং উকিলেরা ভাল চোখে দেখেনি তাদের স্বার্থ হারাবার ভয়ে। এরপর উকিল ও বিচার বিভাগ বসে থাকেনি, তারাও তৎপরতা শুরু করে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে।

আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন "পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।" সেদিন তিনি আন্তর্জাতিক শত্রুদের ক্ষেপিয়ে ছিলেন। আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের এই অভিমত পছন্দ হয়নি। কিসিঞ্জারের মতো কুচক্রীরা চক্রান্ত শুরু করে দিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু যেদিন কম্বল চুরির কথা বলেছিলেন সেদিন সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরাও নড়েচড়ে বসেছিল। যে তিনি করছেন কী? এতদিন কষ্ট করলাম আমরা এখন একটু আয়েশ করব আর তিনি কিনা আমাদের চুরির কথা ফাঁস করে দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার ২১ সদস্য খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল যাদের অধিকাংশই রাজনীতিবিদ ছিল। এরা যে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল।

অনেক বড় বড় শিল্প কারখানা বঙ্গবন্ধু জাতীয়করণ করেছিলেন। এ কারণে খেপেছিল অসৎ-অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। তারাও সাধারণ জনগণকে আর আগের মত চুষতে পারেনি। স্বাভাবিক কারণেই তারাও ক্ষেপেছিল।

অস্ট্রেলিয়া আমাদের চেয়ে অনেক বড় দেশ ও সম্পদশালী সেখানে দৈনিক খবরের কাগজের সংখ্যা মাত্র চারটা। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন যে আমাদের দেশে এত খবরের কাগজের কোনো দরকার নেই। আর সংবাদপত্রের নামে কালোবাজারিতে কাগজ বিক্রি। এসব বঙ্গবন্ধু জানতেন তাই সংবাদপত্র কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তথাকথিত সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের মালিকরাও ক্ষেপেছিল। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্য সংবাদপত্রের মালিক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিল। এই ব্যারিস্টার বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যখন প্রগশ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে তখন তাদের সাথে ছিল। এসব প্রমাণ করে এই সকল ব্যক্তিদের সমর্থন ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে।

বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় থাকলে স্বার্থগত দিক থেকে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হত সামরিক বাহিনী বিশেষ করে স্বাধীনতার পর যেসব সেনা কর্মকর্তারা ফেরত এসেছিল তারা। কারণ তিনি পিপলস আর্মির বা জনগণের সেনাবাহিনীর কথা বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন তিনি ব্যারাকে বসিয়ে সেনাবাহিনীকে খাওয়াতে পারবেন না। তাদেরকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তান ফেরত আয়েশী সেনাদের সে কথা পছন্দ হয়নি। আর বাংলাদেশেও তখন এই জাতীয় মানসিকতার সেনাসদস্যের অভাব ছিল না। তখন থেকেই তারা সতর্ক হয়েছে এবং চক্রান্তে যোগ দিয়েছে।

জিয়ারও মুক্তিযুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা ছিল। সে কোর্ট মার্শালের স্বীকার হয়েছিল। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর আত্ম-স্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেছে, ১৯৭৫ এর ২০ মার্চ সে জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা জানিয়েছিল। জিয়া তাকে এগিয়ে যাবার জন্য বলে। জিয়ার সংশ্লিষ্টতার আরও প্রমাণ পাওয়া যাবে ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির 'ভারত, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান' গ্রন্থে। সেখানে তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু জোট বিরোধী নীতির অংশ হিসেবে তখনকার ডেপুটি চিফ অফ আর্মি স্টাফ কর্নেল জিয়াউর রহমানকে তার ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৭৩ সালের শুরুতে ওয়াশিংটন পাঠান। জিয়াউর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে পেন্টাগন সিআইএ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর প্রধানদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্র সফরে তার দায়িত্ব পালন শেষে লন্ডনে কিছুদিন অবস্থান করে। আর তখন জিয়াউর রহমান মিস্টার ব্যানার্জির সাথে দেখা করে। তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল ফারুক রহমানের একটি সুটকেস ও কর্নেল ব্যাটন ফেরত নেয়া। যা ফারুক রহমান ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাবার আগে মিস্টার ব্যানার্জির কাছে গচ্ছিত রাখে।

মিস্টার ব্যানার্জি কর্নেল জিয়াউর রহমানের অনুমতি চান তাকে একটা বা দুটো অপ্রিয় প্রশ্ন করার। এক প্রশ্নের উত্তরে জিয়া স্বীকার করেছিল যে সে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশের সাথে দেখা করেছিল। এই প্রশ্নের পর মিস্টার ব্যানার্জি লিখেছেন, "তিনি (জিয়া) সাথে সাথেই মিটিং শেষ করে দিতে পারতেন কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি তা করেননি।"

এরপর মিস্টার ব্যানার্জি জানতে চান, "একজন উচ্চ পদস্থ আর্মি অফিসারের জায়গা থেকে ফারুক রহমানের মত অধীনস্থ কর্মচারীর স্যুটকেস নেবার মত তুচ্ছ কাজ কেন করছেন তিনি?" পরে মিস্টার ব্যানার্জি লিখেছেন, "আমি মনে মনে ভাবলাম তবে কি তিনি কোন একটি ভালো সময়ে বিশাল কোন অপারেশন ব্যবহারের জন্য ফারুক রহমান নামের গুটিটি তৈরি রাখছেন? তবে কি কোন বৃহত্তর পরিকল্পনা আছে? পাকিস্তানী ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে প্রশিক্ষিত, সামরিক একনায়কদের ভূমিতে লালিত হওয়ায় খুব বেশি কি কল্পনা করা হয়ে যায় যদি ভাবি যে তারও হয়তো গোপন উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে সামরিক কু'র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার? গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একজন নেতাকে হত্যা করার বিষয়টি এমন একজনের মাথায় আসতেই পারে।

পাকিস্তানী মিলিটারি অ্যাটাশের সাথে তার কি কথা হয়েছিল জানতে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছিল। কিন্তু যখন আমি দেখলাম যে সে বিষয়ে কথা বলতে তিনি (জিয়া) খুব নার্ভাস হয়ে যাচ্ছেন তখন আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমি যা বলেছি তা একজন সিনিয়র সামরিক অফিসারের আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার মত উস্কানিমূলক।

কিন্তু আমাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে মুখোমুখি এই কথোপকথনে জিয়াউর রহমান ভীষণ ঠান্ডা ছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল যে তিনি তার দ্বিতীয় অ্যাপয়েন্টমেন্টটি বাতিল করে দেননি যখন তার ফারুক রহমানের স্যুটকেসটি নেবার কথা। তিনি তার মধ্যাহ্ন ভোজের কথা রেখেছিলেন, ফারুকের স্যুটকেসটি সংগ্রহ করেছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তা বহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে ঠিক পাশের দালানের হাই কমিশন অফিস পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন। আমার জন্য এই ঘটনাটির গভীর তাৎপর্য ছিল।" এসব ঘটনা থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যা চক্রান্তে সরাসরি জড়িত ছিল কমপক্ষে ১৯৭৩ সাল থেকে বা তারও আগে থেকে।

মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিল। মোশতাকের প্রতিরক্ষা-বিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছিল মন্ত্রীর সমমর্যাদায়। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। বিমান বাহিনী প্রধানও নিশ্চুপ ছিল। নৌবাহিনীও কোন ভূমিকা রাখেনি। পুলিশ, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী সবাই নিশ্চুপ থাকল কেন? অতএব বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই কয়েকজন বিপথগামী সেনা সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হয়নি।

শেষ জনসভায় বঙ্গবন্ধু যা বলেন তা তার জীবনকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। নীচে সেই দীর্ঘ ভাষণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হল:

১. ভুট্টো সাহেব বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা কী? ভুট্টো সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করি, ফ্রন্টিয়ারের পাঠানদের অবস্থা কী? ভুট্টো সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি, বেলুচিস্তানের মানুষের অবস্থা কী? এরোপ্লেন দিয়ে গুলী করে মানুষ হত্যা করছেন। সিন্ধুর মানুষের অবস্থা কী? ঘর সামলান বন্ধু, ঘর সামলান। নিজের কথা চিন্তা করুন। পরের জন্য চিন্তা করবেন না। পরের সম্পদ লুট করে খেয়ে বড় বড় কথা বলা যায়। আমার সম্পদ ফেরত দেওয়া না পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার অপরাধে পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন আর উপরের কথাগুলো বলার পর পাকিস্তানিরা বিশেষ করে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর ওপর আরো ক্ষেপে গিয়েছিল।

২. আমি দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব চাই, কারো সাথে দুশমনি করতে চাই না। সকলের সাথে বন্ধুত্ব করে আমরা শান্তি চাই।

এই নীতিও আমেরিকার সহ্য হয়নি। তারা চায় বন্ধুত্ব শুধু তাদের সাথে করতে হবে। অতএব তারা হত্যা চক্রান্ত জোরদার করেছিল।

৩. আমি তিন বছর দেখেছি। দেখে শুনে আমি আমার স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি। এবং তাই জনগণকে বুঝিয়ে দিতে হবে শাসনতন্ত্রের মর্মকথা। এক নম্বর কাজ, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। কেমন করে করতে হবে? আইন চালাব। ক্ষমা করব না। যাকে পাব, ছাড়ব না। একটা কাজ আপনাদের করতে হবে। গণআন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে যে, ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিষ বিদেশে চোরাচালান করে তাদেরকে সামাজিক boycott করতে হবে।

এই ঘোষণার পর দুর্নীতিবাজদের টনক নড়ে গিয়েছিল তারাও হত্যা চক্রান্তে যোগ দিয়েছিল।

৪. আপনারা জানেন, আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ বেশি ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে double ফসল করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না, ভিক্ষা করতে হবে না।

যারা বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল করে রাখতে চেয়েছিল, যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিল তাদের এই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক ভাবেই ভাল লাগেনি এবং বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেবার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।

৫. ভাইয়েরা আমার, একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের প্রত্যেক বৎসর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হল ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের প্রত্যেক বৎসর ৩০ লক্ষ্য লোক বাড়ে, তাহলে ২৫/৩০ বৎসরে বাংলায় কোন জমি থাকবে না হাল চাষ করবার জন্য। সেই জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কনট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে।

এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভাল লাগেনি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সফল হলে তারা সস্তা শ্রম থেকে বঞ্চিত হবে। তারাও বঙ্গবন্ধুর হত্যা চক্রান্তে মদদ দিয়েছে।

৬. শিক্ষিত সমাজকে আর একটা কথা বলব। আপনাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। একজন কৃষক যখন আসে খালি গায়ে, লুঙ্গী পরে, আমরা বলব, 'এই বেটা, কোত্থেকে আইছিস, বাইরে বয়, বাইরে বয়।' একজন শ্রমিক যদি আসে বলি 'ঐখানে দাড়া।' 'এই রিক্সাওয়ালা, ঐভাবে চলিস না।' তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের তুচ্ছ করেন। এর পরিবর্তন করতে হবে। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।

শিক্ষিত সমাজকে তিনি যাদের সম্মান করতে বলেছেন তাদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েই এরা চলে। আর তাদের কিনা বঙ্গবন্ধু দেশের মালিক বলছেন অতএব এরাও চক্রান্তে সামিল হয়েছে।

৭. শিক্ষক সম্প্রদায়ের কাছে আমার আকুল আবেদন, ফেল করাবেন না। নকল বন্ধ করেছি। আপনাদের একটা কর্তব্য আছে, ছেলেদের মানুষ করতে হবে। ফেল করানোতে আপনাদের তেমন বাহাদুরি নাই, পাশ করালেই বাহাদুরি আছে। আপনাদের কর্তব্য পালন করুন। খালি ফেল করিয়ে বাহাদুরি নেবেন, তা হয় না। তাদের মানুষ করুনআমি তো শিক্ষকদের বেতন দেব। আমরা সব আদায় করব।

শিক্ষকরাও ক্ষেপেছিল যে তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে। টনক নড়েছিল তাদেরও, সে সিন্ডিকেটও পিছিয়ে থাকেনি চক্রান্তে।

৮. সরকারী কর্মচারী ভাইয়েরা, একটু Discipline এসে গেছে। অফিসে যান, কাজ করুন। আপনাদের কষ্ট আছে আমি জানি। দুঃখী মানুষ আপনারা। আপনারা কাজ করুন। জনগণের পেটে খাবার নাই। তাদের ওপর tax বসিয়ে আমি আপনাদের পুষতে পারব না। Production বাড়ালে আপনাদের এদের সঙ্গে উন্নতি হবে।

সরকারি কর্মচারীর সিন্ডিকেট সর্বাগ্রে হত্যা চক্রান্তে যোগ দিয়েছিল। এরা তো সরকারি চাকরি নিয়েছেই জনগণের করের টাকায় নিশ্চিত জীবন যাপনের জন্য।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুন্ডাদের লেলিয়ে দিয়েছিল শত্রুবাহিনী। আর ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়ের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিল কয়েক হাজার গুণ যা তার মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হওয়ার কয়েক মাস আগেও তার ওপর গ্রেনেড হামলা করেছিল। ১৯৭৫-এর ২১ মে সন্ধ্যায় সেই হামলা থেকে সুস্থ অবস্থায় বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। উইকিলিকস থেকে ফাঁস হওয়া কিছু মার্কিন তারবার্তা থেকে জানা যায় এসব তথ্য। ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য হিন্দু এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১৩ সালে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক এ এল খতিবের 'হু কিলড মুজিব' বইয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সতর্কবার্তার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধী খুব স্পষ্ট ভাষায় শেখ মুজিবকে একাধিকবার জানিয়েছিলেন, তার (বঙ্গবন্ধুর) বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত চলছে কিন্তু উনি এই সতর্কবার্তা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেননি। (তথ্যসূত্র: জনকন্ঠ, ১৫ অগাস্ট ২০১৭)

১৯৭৫-এর জুন মাসে গোলাম আযম লন্ডনে অবস্থানের সময় তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দিয়ে লন্ডন সফরের নামে আসলে সেখানে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মুহূর্ত চূড়ান্ত করতে। (তথ্যসূত্র: ভোরের ডাক, ৪ অগাস্ট ২০১৬)

বঙ্গবন্ধু হত্যা ছিল একটা বৃহৎ চক্রের দীর্ঘদিনের সম্মিলিত চেষ্টার ফল। যে চক্রে সবরকম পেশার কর্ণধার ও সুযোগ সন্ধানী অধস্তনরাও জড়িত ছিল। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে লাভবান হয়েছে তাদের মিলিত একটা চক্রান্ত ও পরিকল্পনার ফল এই হত্যাকাণ্ড। কয়েকজন বিপথগামী সেনাসদস্যের পক্ষে এমন একটা ষড়যন্ত্র করে বাস্তবায়ন সম্ভব না। আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। এই হত্যাকাণ্ডের আংশিক বিচার আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিলেও পরিপূর্ণ খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সময়ের দাবি হল অনতিবিলম্বে নেপথ্যের নায়কদের খুঁজে বের করতে একটা কমিশন গঠন করা। আর যারা হত্যা সংগঠনকালীন ও হত্যা পরবর্তী সময়ে কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে তাদের তালিকা প্রণয়ন করা।