মুসলিম ইতিহাসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সাদৃশ্য: কারবালা থেকে ঢাকা

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন
Published : 23 August 2020, 01:53 PM
Updated : 23 August 2020, 01:53 PM

মানব ইতিহাসে যে কয়টি লোমহর্ষক নারকীয় রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তার মধ্যে তিনটি হৃদয়বিদারক, বর্বর এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই তিনটি নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মাঝে সবচেয়ে করুণ ও হৃদয়বিদারক হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে ঢাকায় সংঘটিত বর্বর হত্যাকাণ্ডটি। তুলনামূলক বিচারে দেখা যায় যে, মুসলিম বিশ্বে সংঘটিত অন্যান্য নারকীয় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের খুনিদের চেয়ে ঢাকার হত্যাকাণ্ডের নরপিশাচরা ছিল অধিক বর্বর ও নিষ্ঠুর।

কারাবালা বনাম ঢাকা:

৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবরে কারবালার প্রান্তরে আওলাদে নবী হযরত ইমাম হোসাইন (রা:) এর ওপর সংঘটিত হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল মুসলিমদের পবিত্র জুম্মার দিন শুক্রবারে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে বাঙালি জাতির জনকের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডটিও সংঘটিত হয়েছে পবিত্র জুমার দিন শুক্রবারে (এই প্রবন্ধের সাথে সংযুক্ত ১৯৭৫ সালের ক্যালেন্ডারে লাল চিহ্ন দেওয়া তারিখ ও দিন লক্ষ্য করুন)। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের ছয় মাসের শিশু সন্তান আলী আসগর ইবনে হোসাইন ইয়াজিদ বাহিনীর তীরের আঘাতে নিহত হলেও এবং হোসাইন পরিবারের পুরুষ সদস্যদের হত্যা করা হলেও (শুধু ইয়াজিদ বাহিনীকে যারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল তাদেরকে হত্যা করা হয়) হোসাইন পরিবারের অন্যান্য নিরস্ত্র পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয়নি। যদিও ইয়াজিদ বাহিনী লুটতরাজ চালায় কিন্ত নারী-শিশুদের হত্যা না করে বন্দি করে এবং পরে তাদের মুক্তিও দেওয়া হয়। কিন্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে ঢাকায় সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নরপিশাচরা রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত ৩, ১০ ও ১৩ বছরের (শহীদ সুকান্ত, রাসেল ও বেবী) শিশুসহ নারী, অন্তঃসত্ত্বা (শহীদ বেগম আরজু মনি) ও নব বিবাহিতা নারীকেও (শহীদ সুলতানা ও রোজী) বঙ্গবন্ধুসহ নিরস্ত্র মানুষকে নারকীয় পৈশাচিক উল্লাসে হত্যা করে ও লুটতরাজ চালায়। তখন মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে "আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম"- ঘুম হইতে নামাজ উত্তম। কিন্তু নরপিশাচদের কাছে ছিল- ঘুম হইতে খুন উত্তম।

মুর্শিদাবাদ বনাম ঢাকা:

১৭৫৭ থেকে ১৯৭৫। দুইটা সালই বেজোড় সাল। আবার '৫৭'কে উল্টো লিখলে '৭৫' হয়ে যায়। সিরাজউদ্দৌলা হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত প্রায় সকলেই ছিল সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন। আবার মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত প্রায়ই সবাই ছিল মুজিবের ঘনিষ্ঠ ও পরিচিত। হযরত হোসাইন ও সিরাজকে হত্যাকারীরা প্রায় সবাই স্বজাতীয় বিশ্বাসঘাতক। সবাই একই ধর্মাবলম্বী ছিল। মুজিব হত্যাকারীরাও স্বজাতি ও স্বধর্মীয় বিশ্বাসঘাতক।

কাবুল বনাম ঢাকা: ১৯৭৮ সালে কাবুলে সংঘটিত সর্দার মোহাম্মদ দাউদ খান ও তার সমগ্র পরিবারের হত্যাকারীরাও ছিল তার স্বজাতি ও স্বধর্মীয়।

ইতিহাসের বিচারে: শত শত বছর ধরে কারবালা ও মুর্শিদাবাদের হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা ইতিহাসের দুর্গন্ধময় অন্ধকার আস্তাকুঁড়ে বাস করছে। যুগ যুগ ধরে তারা অভিশপ্ত। সভ্য মানবিক সমাজ তাদের নামের উপর ঘৃণার থুতু নিক্ষেপ করে আসছে। পক্ষান্তরে, হযরত ইমাম হোসাইন ও সিরাজউদ্দৌলা ইতিহাসের স্বর্গে বাস করছে। কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় তারা সিক্ত হয়ে আসছে। তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ইতিহাসের স্বর্ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। কোটি কোটি মানুষ অবনত মস্তকে ও বিনম্র শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করে। তার স্মরণে অশ্রু বিসর্জন করে, মাতম করে। পাশাপাশি তার হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা কোটি কোটি বাঙালির ঘৃণায় অভিশপ্ত। ইমাম হোসাইন ও সিরাজের হত্যাকারীদের মতো তারাও আজ ইতিহাসের অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত। উল্লেখ্য যে, ইয়াজিদ ও মীরজাফরের অনুসারী কিছু বর্বর জনগোষ্ঠী তখন ছিল কিন্তু সেই অভিশপ্ত জনগোষ্ঠীকে ধীরে ধীরে ইতিহাসের অন্ধকূপে গিলে ফেলেছে। তেমনি বাংলাদেশেও একটি বিবেকহীন, অজ্ঞ, অশিক্ষিত বর্বর জনগোষ্ঠী আছে, যারা বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়কের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে নারকীয় পৈশাচিক উল্লাসে কেক কেটে এক মূর্খ, অভিশপ্ত বিবেকহীন, নির্লজ্জ নারীর ভুয়া জন্মদিন পালন করে। কিন্তু ইতিহাসের অতল অন্ধ গহ্বরে এই অভিশপ্ত, অজ্ঞ জনগোষ্ঠীও ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়।