প্রবাসীর চিঠি: বিনিয়োগ নাকি নিরাপত্তা!

শারমিন জান্নাত ভুট্টো
Published : 17 August 2020, 08:38 PM
Updated : 17 August 2020, 08:38 PM

প্রবাসীরা কেবলই কি অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে নিজেদের দেখতে চায় নাকি সেই সাথে চায় বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা? সরকারি হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসে থাকেন। এরই মাঝে সবারই জানা আছে যে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে।

গত অর্থবছর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীদের আয় পাঠানোর ওপর ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে রেমিটেন্সের পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়তে থাকে। আর এ কারণেই আগামী অর্থবছরেও এই প্রণোদনা দেওয়া অব্যাহত থাকবে।বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের ঘোষণায় প্রবাসীরা আরো উৎসাহিত হবেন বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠানোর বিষয়ে। তবে প্রবাসীরা শুধুমাত্র নিজেদের সামর্থ্য আর অর্জন টাকা পাঠানোর মাঝেই রাখতে চান না। তারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন দেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে। এমনকি অনেকে মাটির টানে ফিরছেন দেশের বুকে তাদের সারাজীবনের সঞ্চয় নিয়ে।

তবে যে আশা-ভরসা সাথে নিয়ে তারা দেশে ফিরছেন তার কতটুকু তারা পাচ্ছেন বাস্তবতার নিরিখে? শুরু হোক তাহলে দেশের মাটিতে পা রাখা থেকেই। বিমানবন্দর থেকে বিদায়বেলায় কিংবা নামার পর থেকে যেভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয় সেখানে বোঝার কোন অবকাশই থাকে না যে এই রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবদান কতটা গুরুত্ব সহকারে প্রতিবার বাজেটের আগে উত্থাপন করা হয়। বিমানবন্দরের বিদায় ও অর্ভ্যথনা কোনটার মাঝেই তেমন কোন তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না।

শুধুই মিল পাওয়া যায়  তাদের হেনস্তা, অবহেলা আর চাঁদাবাজির শিকারের মাঝে। আর সে কারণেই এই মানুষগুলো দেশে আসার পর থেকেই ধাক্কা খেতে থাকে একের পর এক। প্রথমেই আসি নিরাপত্তা প্রসঙ্গে। অনেক প্রবাসীই দেশে ফিরলে কাউকে আগে থেকে জানাতে চান না। আর তার বড় কারণ হচ্ছে নিরাপত্তা। ওই সময় চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী সবাই মেতে উঠে 'পুলিশ-পুলিশ' খেলায়। বিনা আমন্ত্রণে এরা অতিথি হয়ে ঘরে আসে যখন-তখন, উদ্দেশ্য একটাই যদি সরলতার সুযোগ নিয়ে হাতিয়ে নেওয়া যায় তাদের সম্বলটুকু। এমনকি বিনিয়োগ করেও স্বস্তি মেলার কোন উপায় থাকে না। পরতে পরতে শকুনের লোলুপ দৃষ্টি।

সম্প্রতি তেমনই একটা ঘটনা চোখে পড়লো পত্রিকার পাতায়। ফেইসবুক ও গণমাধ্যমে অনেক অনেক খবরের ভিড়ে এ সংবাদটি চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু নিজে প্রবাসে কাটাই বলেই হয়তো ছোট্ট খবরটি নজর কাড়লো।

খবরে প্রকাশ, "আব্দুল হক নামে এক প্রবাসী দীর্ঘ ৪০ বছর সৌদিতে থাকার পর সারা জীবনের সঞ্চয় নিয়ে পরিবার-পরিজনের জন্য দেশে ফেরেন। শান্তিতে মাথা গোঁজার জন্য সঞয়ের টাকা বিনিয়োগ করে একটি আবাসিক এলাকায়, কেনেন ৫ কাঠার প্লট। সেখানে সাত তলা ভবন নির্মাণের জন্য 'সারা হাউজিং' নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সাথে ২০১১ সালে চুক্তিবদ্ধ হন।‍ চুক্তি অনুযায়ী ৩০ মাসের মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করে আব্দুল হককে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও 'সারা হাউজিং ও তার স্বত্বাধিকারী মুজিবুর রহমান' ৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তা হস্তান্তর করেননি। পরে নিরুপায় হয়ে আব্দুল হক আদালতের শরণাপন্ন হলে ওই ডেভেলপার কোম্পানি ও তাদের ভাড়া করা বাহিনী হামলা চালায় তার পরিবারের ওপর। সেই সাথে দিয়ে আসছে একের পর এক মিথ্যা মামলা ও প্রাণনাশের হুমকি। শুধু তাই নয়, সারা হাউজিং কর্তৃপক্ষের ভাগ্নে নুরুল আমিন ও কোম্পানীটির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হোল্ডার আনিসুল হক খান ইনিয়ে-বিনিয়ে হাতিয়ে নিতে চাইছে আব্দুল হকের শেষ সম্বলটুকু। এমনকি আদালতের রায় আব্দুল হকের পরিবারের পক্ষে যাওয়ার পরও তার আদেশ কিংবা নিয়ম-নীতি কোনকিছুরই তোয়াক্কা করছে না সারা হাউজিং ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। দীর্ঘ আইনি লড়াই লড়তে লড়তে ক্লান্ত আব্দুল হক শুধুই চাইছেন তার পরিবারের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ।"

এ নিয়ে আব্দুল হক অভিযোগ করে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।  সংবাদ সম্মেলনে ব্যাঙের ছাতার মতো দেশজুড়ে বিস্তার করা 'সারা হাউজিং' এর মতো অসাধু কোম্পানীগুলোর উৎপাত বন্ধ করতে নানা দ্বারে কড়া নেড়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, বসুন্ধরা আবাসিক গ্রুপ সর্বত্র হন্যে হয়ে দৌঁড়েছেন আব্দুল হক, তবে কোথাও থেকে এখন পর্যন্ত মেলেনি কোন আশার বাণী, দেখতে পাননি আলোর রেখা।

এ লেখাটি যখন শেষ করছি তখন চট্টগ্রামে পত্রপত্রিকায় আরেকটি খবর দেখতে পেলাম। মো. জাফর নামে এক প্রবাসীকে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ করেছেন নিহতের মামা ও বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আহমদ নবী। কক্সবাজারের চকরিয়া থানার ওসিসহ দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ।

এতো কিছুর পর তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, তবে কি দেশে থাকা ও প্রবাস ফেরত মানুষগুলোর জীবনবন্দি কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কাছে? নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে বিনিয়োগ করে তার কতটুকু প্রতিদান পাচ্ছেন ফেরত প্রবাসীরা? নিজ দেশে শান্তিতে- নিরাপত্তায় থাকার অধিকার কি নেই তাদের? এ বিষয়ে কতটুকু এগিয়ে আসছে প্রবাস কল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? তবে কি অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে প্রবাসীদের বিনিয়োগ? আপাতত প্রশ্নগুলো রেখে গেলাম, থাকলাম উত্তরের অপেক্ষায়…।