রামু পরিস্থিতি : প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 9 Oct 2012, 02:13 PM
Updated : 9 Oct 2012, 02:13 PM

৮ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রামু সফর, ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধবিহার ও ঘরবাড়ি পরিদর্শন, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে নগদ অর্থসহ ত্রাণ-সামগ্রী বিতরণ, সম্প্রীতি সমাবেশে বক্তব্যপ্রদান ও সর্বোপরি বৌদ্ধসমাজকে যে কোনও পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য সবরকম সাহায্য করার ঘোষণার ফলে, রামুর বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে যা-কিছু ইতিবাচক তার প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সাধুবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের প্রাপ্য। সে সঙ্গে যে সব অসঙ্গতি ও অপরিণামদর্শিতা এখনও রয়ে গেছে, যার ক্রমবর্ধমান রূপ ভবিষ্যতে আরও অভাবিতপূর্ব ঘটনার জন্ম দিতে পারে- মোটা দাগে সে ধরনের দুয়েকটি বিষয় নিয়ে এখানে খুব কম কথায় বলতে চাই।

প্রথম কথাটি হচ্ছে- ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়, তার প্রতিবিধান ও পুনর্বাসন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৬০টি পরিবরের মধ্যে নগদ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। এ অর্থ ও পণ্যসামগ্রী এ মুহূর্তে তাদের প্রযোজন মেটাতে কাজে লাগবে। কিন্তু ধ্বংসপ্রাপ্ত মঠ, মন্দির, বাড়ি, যাদুঘর, সংগ্রহশালা ও বৌদ্ধসম্প্রদায়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য এটি কোনওমতেই যথেষ্ট নয়। তাই খুব শিগগির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালদের অস্তিত্ব কার্যকরভাবে বিলুপ্ত করা দরকার। তা না হলে বরাদ্দকৃত অর্থ স্বার্থান্বেষীদের পকেট ভারি করবে।

সরকারি বরাদ্দসহ অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত সাহায্য প্রধানত যে সব কারণে জরুরি : (১) সীমা বৌদ্ধবিহারসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত সব বৌদ্ধবিহারের হুবহু পুনর্নিমাণ। (২) এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বৌদ্ধবিহারের স্থাপত্য ও অন্যান্য উপকরণ পুরোপুরি আগের মতো রাখতে হবে। (৩) ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি বৌদ্ধমূর্তি পুনর্নিমাণ ও পুনর্স্থাপন করতে হবে। (৪) ভস্মীভূত ধর্মগ্রন্থ, পত্র, পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক নিদর্শন ও দলিল সম্ভব হলে অন্য উৎস থেকে এনে সংরক্ষণ করতে হবে। (৫) কোনও-কোনও বৌদ্ধবিহারের সংশ্লিষ্ট ইতিহাস-সম্বলিত তালপত্র বা পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ ভম্মীভূত হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে জীবিত বর্ষীয়ান ও প্রাজ্ঞ ভিক্ষু বা ধর্মীয় প্রধানদের বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণের মাধমে যথাসম্ভব সে ইতিহাস পুনর্লিখন করে সংরক্ষণ করতে হবে। (৬) ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিটি বাড়িঘর ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতি মেনে পুননির্মাণ করতে হবে। (৭) ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার পদ্ধতি অবলম্বন করে এ ভাবে পুনর্নির্মিত ঐতিহ্যের বস্তুরূপের পাশাপাশি তার বিমূর্ত রূপ ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা জাদুঘরে তার কপি বিতরণ করতে হবে। (৮) এ ভাবে পুনর্নিমিত এলাকাকে সব ধর্মের মানুষের জন্য একটি শান্তি ও সম্প্রীতির এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে এটি খুব জরুরি একটি পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল, বৌদ্ধসম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। পত্রপত্রিকায় দেখলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রামু খিজারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে যে 'সম্প্রীতি সমাবেশ' করেছেন, তাতে সাধারণ বৌদ্ধদের উপস্থিতি কম ছিল। এর কারণ হিসেবে রামুতে আওয়ামী লীগের দু'গ্রুপের মতভেদের কথা উঠে এসেছে। তবে আমাদের মতে, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বৌদ্ধদের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তার অভাববোধ। যারা ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল তাদের কাউকে-কাউকে এ সমাবেশে দেখা গেছে বলেও পত্রিকাগুলো লিখেছে।

এটা খুব স্পষ্ট যে, সর্ষের মধ্যেও ভূত আছে। সে ভূতকে তাড়াতে হবে। আওয়ামী লীগের বিবদমান গোষ্ঠী দুটোকে সংঘর্ষ থেকে নিরস্ত করতে হবে। এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইসলামের সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। সবচেয়ে জরুরিভাবে বৌদ্ধদের মনে আস্থা ও নিরাপত্তার ভাব ফিরিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে এ অঞ্চলে একটি স্বেচ্ছাসেবক নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা দরকার যেটিতে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণদের প্রাধান্য থাকবে। তাহলে ভবিষ্যতে এ এলাকার সব ধর্মাবলম্বীর নিরাপত্তার দায়িত্ব ও দায় মূলত তাদের কাঁধেই বর্তাবে। বাংলাদেশের অস্তিত্বরক্ষা ও অখণ্ডতার স্বার্থে এ ধরনের নিরাপত্তা-বলয় গঠন জরুরি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের সব জায়গায় এমন বলয় গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয় বিষয়টি হল- তদন্ত, অপরাধী সনাক্তকরণ ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান।
এ বিষয়টিকে রাজনৈতিক দিক থেকে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছে বিভিন্ন মহল। তাই সব দিক থেকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলে প্রকৃত ঘটনার অনুসন্ধান বিঘ্নিত করা হচ্ছে। এটি একান্তই অনভিপ্রেত। আর এর আড়ালে আমাদের বর্ণিত প্রথম দুটি করণীয় মন্থর চালে চলছে। আসলে বর্ণিত তিনটি বিষয় সমান্তরাল রেখায় সমান তালে অগ্রসরমান রাখা জরুরি।

তদন্তের জন্য সরকার কমিটি গঠন করেছেন। কিন্তু বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠিত হয়নি। প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির পর নিরপেক্ষতার খাতিরে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনে কোনও দোষ নেই। বরং এটি কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় বহন করবে। তবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে যে সব সম্ভাব্য অপরাধীর দিকে আঙ্গুল তোলা হচ্ছে, তাদেরও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাতে তদন্ত প্রভাবিত হবে কিনা সেটি পরের কথা, কিন্তু প্রথম কথা হচ্ছে যারা এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে বক্তব্যের সপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করা। বিরোধীদল আওয়ামী লীগকে কটাক্ষ করছে আর আওয়ামী লীগ জামাত-শিবির-রোহিঙ্গাদের প্রতি অভিযোগের তীর ছুঁড়ছে।

তাছাড়া, ঘটনার পরদিন কক্সবাজারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ৮ অক্টোবরের সম্প্রীতি সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার জন্য স্থানীয় সাংসদকে দায়ী করেছেন। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, ''সেদিন রাত সাড়ে ১১টায় যখন এ এলাকার মানুষ শান্ত হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই স্থানীয় সাংসদ এসে মানুষকে কী বলে গেলেন যে তিনি চলে যাওয়ার পর মন্দিরে আগুন লাগানো শুরু হল? আমার প্রশ্ন, তিনি কী কথা বলে গেলেন, কী উসকানি দিয়ে গেলেন তা বলতে হবে। মন্দিরে হামলার জন্য তিনিই দায়ী। অথচ তাঁর নেত্রী আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন।'' ( প্রথম আলো, ৯.১০.২০১২)।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রমাণ করে, সরকারের কাছে এ সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট ও প্রামাণ্য দলিল রয়েছে। কী সে দলিল? অন্তত ওই রাতে স্থানীয় সাংসদের ভাষণের ভিডিও ফুটেজ দেখা যেতে পারে যদি থাকে। তাহলে সরকার বিনা-দ্বিধায় সেটি তদন্ত কমিটির কাছে দিতে পারেন। এরপর জনগণকেও ভিডিওটি দেখানোর ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযোগটি পুরোপুরি গ্রাহ্য হবে। তাছাড়া, দায়ীদের যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা যাবে। সে ক্ষেত্রে কোনও অপরাধীর পদমর্যাদাও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বাংলাদেশে গা-ঢাকা-দেওয়া সাম্প্রদায়িক শত্রু ও মানবতার শত্রুদের সম্পর্কেও বিশ্ববিবেক আর দ্বিধাগ্রস্ত ঘাকবে না।

এটা যদি না করা যায়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের যে রূপটি তৈরি হয়েছিল তা ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধবিহারের মতো জ্বলে-পুড়ে শেষ হযে যাবে।

আমরা চাই, অসত্যের ক্ষয় হোক; জয় হোক সত্যের, ন্যায়পরায়ণতার।
৯.১০.২০১২

মুহম্মদ নূরুল হুদা:কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।