বাঙালির গড় আয়ুর চেয়েও অনেক বেশি সময়ই বেঁচে ছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। তবু ৮৮ বছরও তার মতো কর্মচঞ্চল মানুষের জন্য যথেষ্ট ছিল না। গত দুই তিন বছর আগে থেকেই মৃত্যু তাকে নানাভাবে নিপীড়ন করতে চেয়েছে, তিনি প্রায় অবজ্ঞাভরে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বেঁচে ছিলেন। অনেকটা যেন সেই ভলতেয়ারের মতো; "ওরা আমায় কবর দিতে চেয়েছিল। আমি অবশ্য সটকে পড়েছি।" আসলেই তাই, বশীর ভাই কৃত্রিম পদ্ধতিতে অক্সিজেন গ্রহণ করা সত্ত্বেও, মৃত্যুকে তোয়াক্কা করেননি খুব একটা। মৃত্যু তাকে হুমকি দিয়ে আসছিলো কয়েক বছর যাবতই, কিন্তু তিনি অবলীলায় 'সটকে' পড়েছেন। অবশেষে, অপমানিত ও অপদস্ত মৃত্যুদূত যেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই ১৫ অগাস্টের দিনটিকেই চূড়ান্ত হিসেবে বেছে নিয়েছে। অগাস্ট বাঙালির জন্য আরেকটি শোকের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
'মৃত্যু কেবল মৃত্যুই ধ্রুব সখা।'—কথাটা বশীর ভাই ভালোভাবেই জানতেন। কিন্তু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন কাজের মধ্যদিয়ে জীবনের উদযাপন করে গেছেন। যে-জীবন ছিল কর্তব্যবোধে, ন্যায়নিষ্ঠা আর সৃজনী সংরাগে মুখর। ৮৮ বছরের জীবনেও তিনি ছিলেন কাজ-পাগল এক সৃষ্টিশীল মানুষ। যদিও তিনি বলতেন টাকার প্রয়োজনেই তাকে কাজ করতে হবে, কিন্তু ওই কথাটাকে আমার কাছে সবসময়ই অজুহাত বলেই মনে হতো। টাকার প্রাচুর্য তার ছিল না ঠিকই, কিন্তু তার যেটুকু টাকা প্রয়োজন সেটা তার ছেলেমেয়েদের পক্ষে জোগাড় করা মোটেই অসম্ভব নয়। আর আমিতো জানি তার মেয়েরা, বিশেষ করে মুনীরা বশীর যেভাবে পিতার যত্ন ও দেখাশুনা করে আসছিলেন গত কয়েক বছর ধরে তাতে করে বশীর ভাইয়ের কোনো কিছু নিয়েই চিন্তা করার ছিল না। সুতরাং টাকার জন্য কাজ করার কথাটা কাজে ডুবে যাওয়ার প্রয়োজনে তার উদ্ভাবিত এক উক্তি ছাড়া কিছু নয়।
বশীর ভাইয়ের কাজের পরিধি ছিল বিশাল। সবাই জানেন তিনি নিছক চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন আরও বহু কিছু। সারা পৃথিবীতেই এমন শিল্পী খুব কমই আছেন যিনি একই সঙ্গে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার, প্রচ্ছদশিল্পী, শিল্পসমালোচক, গবেষক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক কর্মী।
ছাত্রাবস্থায়ই তিনি বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। জেলও খেটেছেন সেকারণে। চিত্রকলার জগতে প্রবেশ করেছেন এমন এক সময়ে যখন বাঙালি মুসলমানদের কাছে ছবি আঁকা ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে উপেক্ষিত। তিনি উপেক্ষিত জগতে প্রবেশ করে আমাদের চিত্রকলাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। চিত্রশিল্পের নানান মাধ্যমে যেমন তিনি কাজ করেছেন, তেমনি শিল্পের বিভিন্ন রীতি নিয়ে করেছেন দুঃসাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিমূর্ত ধারার শিল্পকর্ম নিয়ে তার নিরীক্ষাগুলো আমাদের পরবর্তী শিল্পীদের জন্য সাহস ও শিক্ষণীয় এক বিষয়। ৫০-এর দশক থেকে শুরু করে একেবারে তার শেষ দিনগুলো পর্যন্ত তার যে শিল্পযাত্রা তা বৈচিত্রে অপরিমেয়। এত বদল, এত সব বাঁকে চিহ্নিত হয়ে আছে তার শিল্পের যাত্রা যে আজ সবটা দেখলে অবাক হতে হয়। সরাসরি ক্যানভাস ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন মুরাল রচনায়। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের জন্য মুরাল করেছেন, আবার স্বাধীনতার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি করেছেন অক্ষয়বট নামে ইট, সিমেন্ট ও পাথরের বিশাল এক মুরাল। এক সময় বাংলাভাষার সেরা উপন্যাসগুলো অবলম্বনে এঁকেছেন স্বতন্ত্র চিত্রকর্ম। ফর্ম ও বিষয় নিয়েও তার নতুন নতুন ভাবনার কোনো বিরতি ছিল না। গ্যালারি কায়াতে তার যে সর্বশেষ একক প্রদর্শনী হয়েছিল তাতে কাজের বৈচিত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিষয় নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক সব আয়োজন। গুরুগম্ভীর চিত্রকর্মের পাশাপাশি 'স্ট্যাচু অব লিবার্টি নাও' কিংবা 'বার্থ অব ভেনাস' নামের প্রায় পপ আর্টের আদলে এমন সব কাজের উপস্থিতি ছিল যা দেখলে মনে হবে এ বুঝিবা নবীন কোনো শিল্পীর প্রদর্শনী। শুধু পপই নয়, আছে যৌনতার শিল্পিত ইশারাও। অর্থাৎ, ফর্ম বা বিষয় নির্বাচনে তার মধ্যে প্রবীণের কুসংস্কার ছিল না। তিনি যেন নবীনে প্রবীণ কিংবা প্রবীণে নবীন সেই শিল্পী যিনি উজানের বার্তা নিয়ে সদাচঞ্চল। এই পপ ও পর্ন সত্তাই আশির দশকে জন্ম দিয়েছিল কলেমা তৈয়বা শিরোনামের শিল্পগুচ্ছ যা দেখে অনেকেই তাকে ধার্মিক পরিচয়ে সীমিত করতে চেয়েছিল। তারা বুঝতে পারেননি যে তিনি বহুপ্রবণতার বহুস্বরে ঋদ্ধ এক শিল্পী। নিজেকে তিনি একক কোনো জায়গায় স্থির রাখেননি, পুরানের সেই প্রটিয়াসের মতো নিজেকে বদলেছেন ক্রমাগত।
ভাবতে অবাক লাগে, এই তিনি ৫২ ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে, বাম-রাজনীতি, পরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে যদিও তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি, কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পী পরিষদের উদ্যোগে 'স্বা-ধী-ন-তা' মিঠিলে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এর আগে ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড সায়েন্টিফিক আ্যাফেয়ার্স আয়োজিত আরসিসিভুক্ত দেশের শিল্পীদের প্রদর্শনী বর্জন করেন। স্বীধনতার পর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও অর্জনকে তিনি নিজের চিত্রকর্মে অক্ষয় করে রেখেছেন 'শহীদ শিরোনাম' সিরিজ-এ। তার বাবা ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের এক তাত্ত্বিক পুরুষ, বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার পক্ষে তিনি আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই আগুনে নিজের সন্তানকেও জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সেদিন যদি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষাপ্রেম আর তার মননের শক্তি নিয়ে না দাঁড়াতেন তাহলে ইতিহাস কোন দিকে যেত তা সহজেই অনুমান করা যায়। শহীদুল্লাহ তখন বাঙালি জাতির এমনই এক মান্য ব্যক্তিত্ব যে তার উক্তি ও অংশগ্রহণ উপেক্ষা বা অমান্য করা সহজ নয়। তেমনিভাবে ভাষাআন্দোলনে মুর্তজা বশীরের ভূমিকা কেবল শারীরিকভাবেই (শহীদ বরকতের রক্তাক্ত দেহ বহন করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া) নয়, শৈল্পিক (হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলন' গ্রন্থে 'রক্তাক্ত ২১শে, লিনোকাট) অংশগ্রহণও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক হয়ে উঠেছিল। তারচেয়েও বড় কথা হলো, মাতৃভাষার রক্ষায় পিতাপুত্রের এই ভূমিকা আমাদের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে।
বর্ণ ও বর্ণমালায়
আমাদের লেখক-জীবনের শুরুতে মুর্তজা বশীর ছিলেন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব: যে-মানুষ ছবি আঁকেন আবার লেখালেখিতেও দারুণ। ত্রসরেনু – এই নামটিও মনের মধ্যে গেথে গিয়েছিল তখন থেকেই। সিনেমা, উপন্যাস, গল্প—এসব মাধ্যমে কোনো চিত্রশিল্পী কাজ করছেন এমন নজীর দেশে বা বিদেশে খুবই কম আছে। তার সঙ্গে তুলনা দেয়া যেতে পারে—স্বভাষায়—সত্যিজিৎ রায় কিংবা পূর্ণেন্দু পত্রীকে। বিদেশে—জাঁ ককতো। ককতো মানেই রং ও বর্ণমালার এক বর্ণাঢ্য চরিত্র। মুর্তজা বশীরও ছিলেন আমাদের কাছে সেরকমই এক চরিত্র।
কবিতা তিনি খুব বেশি লেখেননি, এমনকি ধারাবাহিকও নয়, কিন্তু তার কবিতাগুলো খুবই আলাদা বৈশিষ্ট্যে দীপ্ত। ওগুলোতে আছে অভাবনীয় ইমেজ আর অদ্ভূত সব পারম্পর্যে বাধা। কখনো কখনো নারীদেহের কাঙ্ক্ষিত নগ্নতা এসেছে খোলামেলাভাবে।
ত্রসরেনু নামের কবিতায় তিনি এক বান্ধবীর সাথে দেখা করার কথা জানাচ্ছেন। কবিতাটিতে আছে চোখ ধাঁধানো সব চিত্রকল্পের পাশাপাশি প্রায় পরাবাস্তক কিছু দৃশ্য:
সময়ের অনুপল
না জানি কত চৌকোন রঙিন পাথরকুচি বুকে
রাভেনায় সেন্ট ভিটায়েলে মোজাইকে ছবি হলো। নতরদামের
গীর্জাঘড়ি ঘোড়দৌড়ে বাজী হেরে আলস্যে ঝিমোয়;
অফুরন্ত অবকাশ তাই কোথাও কাটাবো ব'লে—
স্বর্ণ দুপুরে পিগালে পর্ণো দোকানে
সুন্দরী বিদেশিনীর
নগ্নছবিতে উজ্জ্বলরস খুঁজি, কখনো বা বই নেড়েচেড়ে দেখি।
আমি নিশ্চিত, তিনি যদি শুধুই কবিতা লিখতেন তাহলে এদেশের শীর্ষ কবি হয়ে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু শুধুই কবি হওয়া তার একমাত্র নিয়তি ছিল না, গল্প, উপন্যাসও তাকে লিখতে হয়েছে। এমনকি, ইতিহাসে লুকিয়ে থাকা তথ্য ঘেটে তাকে উদ্ধার করতে হয়েছে মধ্যযুগের নানান মুদ্রার পরিচয় আর সেই পরিচয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট জাতিগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সবাই জানেন, ডাকটিকিট ও মুদ্রা সংগ্রহের ব্যাপারে তার ছিল প্রবল আগ্রহ। তার সঞ্চল বিশাল। জানি না, ঢাকা শহরে অত বড় সংগ্রহ আর কারোর আছে কিনা। সম্ভবত মুদ্রা সংগ্রহের বিশাল ভাণ্ডারই তাকে নিয়ে গেছে 'মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ' নামক গ্রন্থ রচনায়।
অনেকেই হয়তো জানেন, ১৯৫২ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ' পরিচয়' পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের উপর 'পারবে না' শিরোনামে তার কবিতা ছাপা হয়।
১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র 'কারোয়াঁ'র কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ুন কবীর রচিত 'নদী ও নারী'র চিত্রনাট্যকার, শিল্পনির্দেশক এবং প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র 'ক্যায়সে কাহু'র শিল্পনির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এসব তথ্যও আমাদেরকে সেই কালে এই মানুষটি সম্পর্কে এক সম্ভ্রম তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিল। আরও কিছুকাল পরে শিশির দত্ত সম্পাদিত স্বনির্বাচিত সংকলনটি বের হলো সেখানে তার আঁকা ৪৮ জন কবির রেখাচিত্র দেখে তার প্রতি আরেকমাত্রায় আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রবল আকর্ষণের কেন্দ্র থাকলেও ২০১০/১১ সালের আগে তাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আর তখন দেখলেও, তা ছিল দূর থেকে দেখা। তবে সেই দেখা পরে ঘনিষ্ঠতা অর্জন করে ২০১৪ সালে যখন তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য তার বাসায় গিয়েছিলাম। নানা সময়ের ব্যবধানে আমি তার চারটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম যা পরে গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে পাঞ্জেরী প্রকাশনী থেকে। গ্রন্থাকারে বেরুবার আগে সেগুলো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর আর্টস বিভাগেও বেরিয়েছিল। আর প্রকাশমাত্রই সেগুলো পাঠকপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল খুব। বশীর ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎকারের সূত্রে যোগাযোগ হলেও তার সাথে আমার গভীর এক হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেটার কারণ খানিকটা আমার শহীদুল্লাহ-প্রীতি আর খানিকটা চিত্রপ্রীতি। শহীদুল্লাহ যে এখনও বহু ক্ষেত্রে উন্মোচন ও মূল্যায়নের অপেক্ষায় এবং কারো কারো দ্বারা অবমূল্যায়িত – এসব ব্যাপারে আমাদের অবস্থানের ঐক্য হৃদ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এই ব্যাপারটা ছাড়াও তিনি আমাকে অন্য কিছু কারণেও স্নেহ করতেন। তার স্নেহ অর্জন করা যে সহজ নয় তা বশীর ভাই-এর মেজাজ সম্পর্কে যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। তিনি কখনো কখনো রূঢ় হয়ে উঠতে পারতেন যদি তা মেজাজের অনুকূল না হয়। আবার এই মানুষটিই রূঢ় আঘাতের পরেই শিশুর মতো সারল্যে বুকেও টেনে নিতে পারতেন। আমার সঙ্গে যদিও এমনটা কখনো ঘটেনি কিন্তু অন্যদের মুখে, অন্যদের অভিজ্ঞতা আমি শুনেছি।
এত সৎ, স্পষ্টভাষী, আদর্শনিষ্ট আর জ্ঞানদীপ্ত মানুষ আমি কমই দেখেছি। এত সব বিষয়ে তার উৎসাহ ও চর্চা ছিল যে তা রীতিমতো মুগ্ধ করার মতো। আমি তার শ্রোতা যেমন ছিলাম, তেমনি ছিলাম তার চিত্রকর্মের মুগ্ধ দর্শক। রেখাচিত্রে তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। অতি অল্প টানে আভাসিত করে তুলতে পারতেন যে-কোনো আদলকে এবং তা মাত্রই কয়েক মিনিটে। এই লেখাটি লেখার আগে আগে আমি তাকাচ্ছিলাম তার নিজের কিছু আত্মপ্রতিকৃতির দিকে। তিনি বেশ কিছু আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছিলেন যার একটির সঙ্গে আরেকটির মিল খুব একটা নেই, অথচ প্রত্যেকটিতেই তাকে চেনা যায় আবার প্রতিটিই কোথায়ও কোথায়ও আলাদা। আমি তার এই কাজগুলোর খুব তারিফ করেছিলাম। তিনি মিষ্টি হাসি দিয়ে সেই তারিফ গ্রহণ করলেও ওখানটায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। তিনি নতুন নতুন কাজের আইডিয়ার কথা বলতেন।
করোনাভাইরাস এসে আমাদের সরাসরি যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করেছিল বটে কিন্তু ফোনে যোগাযোগ ছিল প্রায় নিয়মিতই। কখনো কখনো যদি কাজের চাপে ভুলে যাওয়ার কারণে তাকে ফোন করতে দেরি হতো তখন তিনি ফোন করে খানিকটা অভিমানের সুরে অভিযোগ করতেন। আমি লজ্জিত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম, এবং তিনি ক্ষমা করেও দিতেন। প্রত্যেকবারই ফোন করলে আমার বউ আর মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেনই। মেয়ে ছবি আঁকে জেনে ওকে উৎসাহ দিতে বলতেন। আমরা একবার মেয়েকে কোনো একটা আর্টের স্কুলে ভর্তি করাবো শুনে উনি নিরুৎসাহিত করলেন। বললেন, শিশুদের একটা জগত আছে যা ব্যাকরণ দিয়ে চলে না। ওকে এই বয়সে ব্যাকরণ শেখাতে গেলে ওর ওই জগতটা নষ্ট হয়ে যাবে।
শেষবার অ্যাপোলোতে ভর্তি হওয়ার আগেও তিনি বেশ কয়েকবার এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি প্রত্যেকবারই গিয়েছি। একবার আমি সস্ত্রীক গিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন। হবারই কথা। হাসপাতালে কেউ আপনাকে দেখতে যাওয়া মানেই আপনি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর ওই একাকী নিঃসঙ্গ সময় কারোর উপস্থিতি রোগীর কাছে শুধু কাম্য নয়, রীতিমত আনন্দদায়ক। কিন্তু এবার, করোনাভাইরাস আমাদেরকে সেই সুযোগটি দেয়নি। তার চিরবিদায়ের আগে এক নজর দেখার বা তাকে শেষবারের মতো স্পর্শ করার সুযোগটাও দিল না। এই দুঃখ চিরটাকাল একটা ক্ষত হয়ে থেকে যাবে।
বশীর ভাই ছিলেন আমাদের এই দেশে জয়নুল-প্রতিষ্ঠিত চারুকলা ইনস্টিটিউট-এর দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনিই ছিলেন সর্বশেষ শিক্ষার্থী ও ছিল। আবার এই পরিচয়ের বাইরে তিনি যে বহুমুখিতা নিয়ে শিল্পচর্চা করেছেন – সেই দিক তিনি ছিলেন মুষ্টিমেয়দের একজন এবং সর্বশেষ জনও। ফলে তার প্রয়াণে একটি যুগের অবসান হলো। তার প্রয়াণে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।