বঙ্গবন্ধু ও অন্নদাশঙ্কর: একটি প্রত্যয়ের মিলনভূমি

গৌতম রায়
Published : 28 Jan 2012, 04:47 PM
Updated : 15 August 2020, 04:38 PM

ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি দেশ যখন ভাষার তাগিদে কেঁপে উঠেছিল বায়ান্নতে অন্নদাশঙ্কর রায় তখনই উপলব্ধি করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাই দেশভাগের ক্ষতের মুখে পলি জমিয়ে একটা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে সুপ্ত ভাবনার জন্ম হয়েছিল, আন্তর্জাতিক স্তরে সেই ভাবনাকে অন্নদাশঙ্করই প্রথম সার্বিক স্বীকৃতি দেন ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে 'সাহিত্য মেলা'র আয়োজনের ভেতর দিয়ে। শেখ মুজিবের ভাবনার কাব্যিক বোধ নির্মাণের প্রধান ঋত্ত্বিক শামসুর রাহমানকে ভারতের মাটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাম্প্রদায়িকতার আগলভাঙার লড়াইয়ের প্রতি বিশ্বজনমতকে প্রথম আকৃষ্ট করেছিলেন অন্নদাশঙ্কর, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এই সাহিত্যমেলার ভেতর দিয়ে।

প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মানুষ না হয়েও ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়কাল থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের হালহকিকৎ সম্পর্কে জানতেন তিনি। এর ভেতর দিয়েই অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে পশ্চিম পাকিস্থানের অর্থনৈতিক, সামাজিক শোষণ কীভাবে বাংলাদেশের পরিবেশকে দূষিত করছে আর সেই দূষণকে প্রতিহত করতে আগের প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সামঞ্ছস্য রেখে ও চিন্তার ক্ষেত্রে, প্রয়োগের আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধু কী ধরনের ইতিবাচক অদলবদল ঘটাচ্ছেন, সেগুলি সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর খুবই ওয়াকিবহাল থেকেছেন। মার্শাল ল শুরু হওয়ার পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও বন্ধুবান্ধব, অনুজদের মাধ্যমে ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা – প্রতিটি বিষয়ে জেনেই ক্ষান্ত হননি অন্নদাশঙ্কর। তার স্বপ্নের বিচরণ ভূমি, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তৈরির দিকে ধীরে ধীরে শেখ মুজিব এগোচ্ছেন, তাই নিজের লেখার ভেতর দিয়ে এপার বাংলায় জনমত সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেন অন্নদাশঙ্কর।

কাজী মোতাহার হোসেন থেকে সুফিয়া কামাল প্রত্যেকের মাধ্যমে তিনি সরাসরি যোগাযোগ রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই, ভারতের অভ্যন্তর থেকে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা যায়, যেসব মানুষ হানাদার পাকবাহিনীর অত্যাচারে সাময়িক ভাবে ভারতে এসেছেন তাদের দেখাশোনা, প্রত্যেকটি বিষয়েই অন্নদাশঙ্করের মতো মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে প্রত্যক্ষ ভূমিকা সমসাময়িক বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ ছিল না। ভারতে আশ্রয় নেয়া শরনার্থীদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে মৈত্রেয়ী দেবীকে নিয়ে নিজে পথে নেমেছিলেন অন্নদাশঙ্কর। এই কাজে গৌরী আইয়ুবও ছিলেন তার বিশেষ সহায়ক।

বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কলকাতা ময়দানে বুদ্ধিজীবীদের আহুত সভায় অন্নদাশঙ্করকে নিয়ে গেলেন অভিনেত্রী মাধবী চক্রবর্তী। মাঠে পৌঁছে তার আর পাত্তা পেলেন না অন্নদাশঙ্কর। দেখলেন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক নেতাদের ঢঙে বক্তৃতা করে চলেছেন। কর্তব্য স্থির করে ফেললেন অন্নদাশঙ্কর। ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরে বাইরের পোশাক না বদলেই লেখার টেবিলে বসলেন। সৃষ্টি করলেন কালজয়ী পংক্তি; "যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবর রহমান।" বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের পর যখন বাংলাদেশে তার নামোচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল খুনি মেজর চক্র আর তাদের দেশীয় স্তাবকেরা তখন বাংলাদেশের প্রতিটি দেওয়াল অন্নদাশঙ্করের এই পংক্তি দুটি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ।

বাঙালির বীর বিক্রম লড়াইয়ের পাশাপাশি গান্ধীজীর স্বপ্নের একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গঠনের জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা হওয়ার পর তাকে আবেগে কার্যত আলিঙ্গনপাশে বেঁধে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। 'আপনার তেলের তিশি ভাঙার বেদনার গভীরে দেশ টুকরো হওয়ার, ধানের গোলা, পাটের আড়ত ভাঙার যন্ত্রণাটা আমাকে ভাবনার জগতে অনেক কিছু দিয়েছে' – আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন অন্নদাশঙ্করকে। জবাবে অন্নদাশঙ্কর বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে; 'বিশ্বমানব হতে গেলে প্রাথমিক শর্ত হল শাশ্বত বাঙালি হওয়া, আপনি আপনার লড়াই দিয়ে সেটা প্রমাণ করে দিলেন।'

দেশ নানা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে আলাদা হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর '৪৭ এর দেশভাগের তীব্র বিরোধী হয়েও গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন; মুসলমান সমাজকে সঠিক ভাবে অর্থনৈতিক অধিকার দেওয়া হয়নি। এই খামতি যে ভারতের জাতীয় আন্দোলন কালেও ছিল, মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে জাতীয় আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বেশিরভাগই যথেষ্ট কুন্ঠিত ছিলেন, এ বিষয়ে অন্নদাশঙ্করের কোনো সংশয় ছিল না।

সেই অন্ধকার আবর্ত থেকে বাঙালি মুসলমান পাকিস্থান আমলেও মুক্তি পায়নি। এটা পাওয়ার পথ নির্মাণ করলেন বঙ্গবন্ধু, এই কথাটা অন্নদাশঙ্কর বঙ্গবন্ধুকে বলামাত্রই জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন; সাহিত্যমেলার ভেতর দিয়ে সেই ঔদার্যের সুমহান পথ আপনিই প্রথম নির্মাণ করে দিয়েছেন।

পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা – সর্বপরি ভরসা, এটাই ছিল অন্নদাশঙ্কর এবং বঙ্গবন্ধুর ভেতর সম্পর্কের মূল রসায়ন। সেই সময়েই কলিম শরাফীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু অন্নদাশঙ্করকে বলেছিলেন; আপনাদের সুচিত্রা মিত্রের গলায়, 'আমার সোনার বাংলা' শুনেই কিন্তু আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের এটিই হবে জাতীয় সঙ্গীত।

মণি সিংহ-এর মতো মানুষরা বঙ্গবন্ধুকে সবসময়ে সঠিক পরামর্শ দিচ্ছেন বলে অন্নদাশঙ্কর মনে করতেন না। বিশেষ করে বাংলাদেশের '৭২-এর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ক্ষেত্রে মণি সিংহ এবং সিপিবি'র প্রভাব বঙ্গবন্ধুর জন্যে ইতিবাচক হচ্ছে না – এটা অন্নদাশঙ্কর তার ঘনিষ্ঠমহলে বললেও নিজের বিরক্তির কথা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে তুলে ধরার সুযোগ পাননি।

দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন ছিল অন্নদাশঙ্করের স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুকে সে কথা তিনি বলতেই সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস তিনি অন্নদাশঙ্করকে দিয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় স্বাধীনচেতা অনানদাশঙ্করকে সহ্য করতেই পারতেন না। ফলে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের প্রাথমিক স্তর হিসেবে পত্রপত্রিকার অবাধ চলাচলের যে ভাবনাটা অন্নদাশঙ্কর বঙ্গবন্ধুকে দেন এবং বঙ্গবন্ধুও কালবিলম্ব না করে সেই ভাবনার প্রয়োগে আন্তরিক সচেষ্ট হন, সেটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড যখন ঘটে, ভারতে তখন জরুরি অবস্থা চলছে। নিজের দেশের ভালো-মন্দ নিয়েই রাষ্ট্র দেশের নাগরিকদের মুখে চাবি পরিয়ে রেখেছে তখন, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের কিছু নিয়ে বলা তো দূরের কথা। ভারতের কোনো পত্রপত্রিকাতে জরুরি অবস্থার সেন্সর বাঁচিয়ে কিছু লেখা তখন সম্ভব নয়। প্রতিটি লেখাই শাসক ময়নাতদন্ত করে দেখে, লেখাটির নখদন্তহীন চরিত্র সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিত হলে তবে সেটি দিনের আলো দেখতে পায়।

এইসব জানা স্বত্ত্বেও 'কাঁদো প্রিয় দেশ' নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করে সেটিকে অন্নদাশঙ্কর 'দেশ' পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কাছে পাঠালেন। সাগরময়বাবু যথারীতি সেন্সরের জন্যে পাঠালেন। অন্নদাশঙ্করের প্রবন্ধটি পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ের তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় পেশ করলেন সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছে। এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে লাখে লাখে শরনার্থী চলে আসবে ভারতে – এই কুযুক্তি দিয়ে প্রবন্ধটি ছাপতে দিলেন না সিদ্ধার্থশঙ্কর।

জবাবে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে অন্নদাশঙ্কর বললেন, তুমি সাপের লেজে পা দিয়েছ।

সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধটির সঙ্গে আরো কয়েকটি বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে 'কাঁদো প্রিয় দেশ' নামে একটা গোটা বই-ই অন্নদাশঙ্কর প্রকাশ করে দিলেন। সেদিন কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের ভেতরে অন্নদাশঙ্করই ছিলেন একমাত্র মানুষ, যিনি জোর গলাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার নিন্দা করেছিলেন এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেছিলেন।

জরুরি অবস্থার ভয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজ কার্যত শতাব্দীর ঘৃণ্যতম ঘটনাটি সম্পর্কে একটা গা বাঁচানো মানসিকতা নিয়েই চলে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে, খুনিদের বিচারের দাবিতে কলকাতাতে একটি রাজনৈতিক দলও কোনো প্রতিবাদ সভা ডাকে না, প্রতিবাদ মিছিল বের করে না। ব্যতিক্রম অন্নদাশঙ্কর। তিনি তার লেখার ভেতর দিয়ে জরুরি অবস্থাকে উপেক্ষা করে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে নিজের প্রতিবাদ জারি রাখেন।

শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রবাস জীবনকালেও যতখানি সম্ভব তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন আন্নদাশঙ্কর। শেখ হাসিনা সম্পর্কে তিনি বলতেন; আমার বাপ মা মরা এক অনাথ মেয়ে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশে অবৈধ ভাবে ক্ষমতাদখলকারী একটি সরকারের সঙ্গেও সামাজিক সম্পর্ক পর্যন্ত অন্নদাশঙ্কর রাখেননি। রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমান থেকে স্বৈরাচার এরশাদ, অন্নদাশঙ্করকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন; বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হলে আমি বাংলাদেশে যাব না। '৯৫-তে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কলকাতাস্থ বাংলাদেশের উপ দূতাবাসে প্রথম জাতীয় শোক দিবস পালিত হয় অন্নদাশঙ্করের নেতৃত্বে।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই অন্নদাশঙ্করকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। অন্নদাশঙ্কর বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আগে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার কর, তারপর যাব। বাংলাদেশ সরকার ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করবার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করলে অন্নদাশঙ্কর সম্মতি দেন বাংলাদেশ যাওয়ার। ১৯৯৬ এর ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সকালে পা রাখেন ঢাকার মাটিতে।