বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে হবে সামগ্রিকভাবে

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 15 August 2020, 06:39 AM
Updated : 15 August 2020, 06:39 AM

বিবিসির জরিপে যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়, তখন কারো কারো মধ্যে যে বিস্ময় দেখা দেয়নি, তা নয়। রাজনীতি-সাহিত্য-শিল্প-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষা-সংস্কারের শত শত বছরের ইতিহাসে সব বাঙালিকে ছাড়িয়ে শেখ মুজিব কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হলেন তার উত্তর অত্যন্ত সহজ – তিনি বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জনক। শেখ মুজিব একদিকে যেমন ইতিহাসের নায়ক, বরপুত্র আবার অন্যদিকে তিনি ইতিহাস-স্রষ্টা। তারচেয়ে পুথিগতবিদ্যায়-বুদ্ধিমত্তায়-সৃজনশীলতায় সেরা বাঙালি হয়তো আরো এক বা একাধিক পাওয়া যাবে কিন্তু শেখ মুজিবের মতো অসম সাহসী, দূরদর্শী এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী রাজনৈতিক নেতা বাঙালিদের মধ্যে আর খুব বেশি নেই। তিনি জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন, অতিক্রম করেছেন তাদের, যাদের কাছ থেকে তিনি রাজনীতির অ আ ক খ শিখেছিলেন।

শেখ মুজিব ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নেতা ছিলেন না। তিনি ধীরে ধীরে উপরে উঠেছেন। কারো তৈরি করা সিঁড়ি দিয়ে নয়, নিজে সিঁড়ি তৈরি করেছেন, তারপর ধাপে ধাপে উপরে উঠেছেন। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রাজনীতির ইমারত গড়ে তুলেছিলেন বলে তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, মানুষকে বিশ্বাস করতেন। আর তাই তার সবলতা যেমন মানুষকে ভালোবাসা তেমনি দুর্বলতাও মানুষকে ভালোবাসা।

এ তথ্য আমাদের অজানা নয় যে, শেখ মুজিব ছিলেন গ্রামের ছেলে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মতো অজপাড়াগাঁয়ের কাদাপানিতে তার বেড়ে ওঠা। নিজে একেবারে দরিদ্র পরিবারের সন্তান না হলেও তিনি তৎকালীন গ্রামীণ দারিদ্র্য দেখেছেন খুব কাছে থেকেই। মানুষের অভাব-দারিদ্র্য তিনি সইতে পারতেন না। বালকবেলাতেই নিজেদের গোলার ধান চুপিসারে বিলিয়ে দিতেন গরিবদের। গায়ের চাদরও খুলে দিয়েছেন শীতে কষ্ট পাওয়া গ্রামীণ মানুষকে। থাকা এবং না-থাকার বিষয়টি তাকে ছোটবেলা থেকেই ভাবিত ও তাড়িত করেছে। তার মধ্যে একটি সহজাত নেতৃত্বগুণ ছিল। সবার মধ্যে থেকেও তিনি সবার থেকে একটু আলাদা থাকতেন। ফুটবল খেলতেন, তবে শুধু খেলোয়াড় ছিলেন না, ছিলেন ক্যাপ্টেন। তিনি বাল্যকাল থেকে যেমন হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ মানতেন না, অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে ছিলেন, তেমনি একশ্রেণির হিন্দুর অহমিকা, দম্ভ, গরিবের প্রতি জুলুমবাজিরও বিরুদ্ধে ছিলেন।

তিনি তার জীবন অভিজ্ঞতা থেকে একটি রাজনৈতিক পথ বা আদর্শ বেছে নিয়েছিলেন, আর সেটা হলো 'গরিবের মুখে হাসি ফোটানো'। তিনি এই আদর্শ কখনো ত্যাগ করেননি। গরিবের পক্ষ তিনি কখনো ত্যাগ করেননি। ত্যাগ করার কথা ভাবেনওনি। গরিব মুসলমান তার ভাগ্য ফেরানোর আশা নিয়ে পাকিস্তান চেয়েছেন, শেখ মুজিবও সম্মুখে থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক থেকেছেন। আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই যখন তিনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বাঙালির স্বার্থবিরোধী মনোভাব বুঝতে পারলেন, অমনি গরিব বাঙালির পক্ষেই অবস্থান বেছে নিলেন। শুরু হলো তার বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর জেল-জুলুম। 'কারাগারের রোজনামচা'য় তিনি নিজেই লিখছেন: "পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই ১৯৪৮-এ যখন আমাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করলো, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ সালে ছাড়লো, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, 'বাবা, তুইতো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস – এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?" (পৃষ্ঠা ৭৯) সহজ-সরল মাকে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব তিনি দিতে পারেননি অথবা দেননি। তার গরিবমুখি, বাঙালিমুখি অবস্থানের কারণেই যে তাকে শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল, এটা এখন সবারই জানা।

একাধিকবার তাকে ফাঁসির মঞ্চের মুখোমুখি করা হলেও তিনি আপোস করেননি। নিজের সাহস তিনি বাঙালি জাতির মধ্যে সংক্রমিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ডাকে বাঙালি অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। মরণকে বরণ করেছে হাসিমুখে। তাই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার জীবনের সেরা ভাষণে শেখ মুজিব অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পেরেছিলেন, "আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না"। বাঙালিকে আসলেই আর কেউ 'দাবায়ে' রাখতে পারেনি। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের জিঞ্জির ভেঙ্গে বাঙালি স্বাধীনতার রক্তপতাকা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে গরিবের পক্ষের রাজনৈতিক ধারার অনুকূলেই তার অবস্থান নিশ্চিত করে বলেছিলেন, "পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত – শোষক এবং শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে"। কিন্তু নানা বাস্তব কারণেই তিনি এই রাজনীতিকে সফল পরিণতি দিতে পারেননি। এক জীবনে একজন মানুষ একসঙ্গে বহু ইসিহাস রচনা করতে পারে না। টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান, অনেকের মুজিব ভাই, মওলানা ভাসানীর মজিবর, কারোবা শেখ সাহেব, ১৯৬৯-এ এসে বঙ্গবন্ধু এবং সবশেষ একাত্তরের যুদ্ধ জয়ের পর জাতির পিতা। কম কিসে! বেঁচে থাকলে হয়তো আরও অনেকদূর যেতে পারতেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতক দল তাকে সপরিবারে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে তার গতি রোধ করে দিল চিরদিনের মতো।

কারা এই ঘাতকচক্র? ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "বাংলাদেশ যেমন লক্ষ লক্ষ শহীদের জন্ম দিয়েছে, তেমনি বেঈমানও রয়েছে। এখানে রাজাকার-আলবদরও হয়েছে। এসব পরগাছার শিকড় তুলে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। কেউ কেউ আবার অতি বিপ্লবের নামে তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে।" বঙ্গবন্ধু শত্রু চিহ্নিত করেছিলেন ঠিকই। পরগাছার শিকড় পুড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেও সে লক্ষ্যে খুব বেশিদূর অগ্রসর হননি কিংবা হতে পারেননি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান মানুষ। তিনি মানবিক সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বেও ছিলেন না। কোনো বাঙালির অস্ত্র তার বক্ষভেদ করবে – এটা ছিল তার কল্পনারও অতীত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। ঘোরতর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্যও ছিল তার বুক উজাড় করা ভালোবাসা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকারবৃত্তির কারণে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, খুলনার আব্দুস সবুর খান কারাগারে থাকলেও বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে খাবার যেত ঠিকই। রাজনৈতিক ভাবে বিরোধী আত্মগোপনে থাকা মোহাম্মদ তোয়াহার বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে যে প্রতিহিংসার রাজনীতির সূত্রপাত হয় তা আর বন্ধ হচ্ছে না। রাজনীতিতে উদারতা ও কঠোরতার যে সমন্বয় দরকার বঙ্গবন্ধু তা করেননি। তিনি ছিলেন কেবলই উদার, মানবিক এবং সংবেদনশীল।

বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর রাজনৈতিক ব্রত থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। সদ্যস্বাধীন দেশে গরিবের হক কেড়ে খাওয়া 'চাটার দল'-এর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কষ্টকর, তা রক্ষা করা তা চাইতেও কঠিন। দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন।"

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বলেছিলেন, "আমাদের নীতি পরিষ্কার। এর মধ্যে কোনো কিন্তু নাই। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলই সুপ্রিম বডি। আপনাদের সিদ্ধান্ত সরকারকে মানতে হবে। এটা আওয়ামী লীগের সরকার। সরকারের আওয়ামী লীগ নয়। আমার অনুরোধ, নির্দেশ, আবেদন- কাজ করতে হবে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হবে। ক্ষমতা দখলের জন্য আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে নি। তাই সবাইকে লোভের উর্ধ্বে, স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে হবে।"

বঙ্গবন্ধুর এই সব বক্তব্য মনে-মননে ধারণ না করে কেবল আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তাকে স্মরণ করা আসলে তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন নয়। ঠুনকো আবেগ দিয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে তার আদর্শের যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই।

শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অবস্থান যে আগাগোড়াই সাধারণ মানুষ তথা গরিব-দুঃখীদের পক্ষে ছিল সেটা আরো স্পষ্ট হবে পাকিস্তান গণপরিষদে দেওয়া তার এই ভাষণ থেকে। ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন:

…পশ্চিম পাকিস্তান ও অন্যান্য প্রদেশের গভর্নরদের বেতন সম্পর্কে জনাব আবুল মনসুর আহমদ কর্তৃক আনীত সংশোধনী আমি সমর্থন করতে চাই।

সংশোধনীতে গভর্নরগণের মাসে ৩ হাজার টাকা করে পাওয়া উচিত বলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মহোদয়, আপনি জানেন যে গভর্নরগণ প্রত্যেকে মাসে ৬ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন এবং পেতে থাকবেন। এ ছাড়াও তারা পাচ্ছেন বিনা ভাড়ায় আসবাবসজ্জিত বাংলো এবং আরও নানা রকম সুবিধা। মহোদয়, আমরা বিশ্বের কাছে ষোষণা করেছি যে, আমরা ইসলামী দেশ এবং আমরা ইসলামী রীতিনীতির অনুসারী। তাহলে এটাকে কি ইসলামী আদর্শ বলবো যখন আমরা গভর্নরদের ৬ হাজার টাকা করে বেতন দিচ্ছি আর গরিব লোকজন অনাহারে ও ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে? মহোদয়, আমার দেশের লোকজনের মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। তারা অন্ন পায় না, বস্ত্র পায় না এবং কখনও কখনও সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের অন্ন-বস্ত্র সংগ্রহের জন্য ইজ্জত খোয়াতে হয়। তাহলে বলুন, আমরা কাদের অর্থ ব্যয় করতে যাচ্ছি? এট হচ্ছে এ দেশের গরিব চাষীদের অর্থ- পাট ও তুলা চাষীদের অর্থ এবং তা হচ্ছে করদাতা সাধারণ মানুষের অর্থ এবং ওই করের অর্থ থেকে আমরা গভর্নরদের মাসে ৬ হাজার টাকা করে দিতে যাচ্ছি। মহোদয়, আমরা ভান করি যে, আমরা ইসলামি দেশ কিন্তু এখানে একজন পিয়নের মাসিক বেতন ৫০ টাকা, আর্দালির বেতন ৭০ টাকা আর কেরানির বেতন ১০০ বা ১৫০ টাকা, আর কিনা এই ইসলামি দেশে ইসলামের ধ্বজাধারী এসব নেতা বেতন পাবেন মাসে ৬ হাজার টাকা করে। তাহলে এটাই কি ইসলামের নমুনা, যা নিয়ে আমরা এত বড়াই করছি এবং যা আমরা ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করছি?

৬০ কোটি মানুষের দেশের চেয়ারম্যান সেই মহান চীনা নেতা মাও সে তুং পর্যন্ত মাসে ৫০০ টাকা পান। অবশ্য তিনি আমাদের গভর্নর জেনারেল এবং গভর্নরদের মতো বিনা ভাড়ায় আসবাবসজ্জিত বাড়ি ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের এই সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশে যেখানে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ নানা ধরনের রোগে ভুগছে এবং ওষুধ ও মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় না, সেখানে আমরা গভর্নর সাহেবদের জন্য মাসে ৬ হাজার টাকা করে দিতে যাচ্ছি। তাহলে, মহোদয় শুনুন, আমি যখন রাতের বেলায় এই নগরীর পথ দিয়ে যাই তখন দেখি পাকিস্তানের নাগরিকরা খোলা আকাশের নিচে ফুটপাথে শুয়ে আছে এবং তারই পাশে দেখি প্রাসাদোপম দালান-কোঠা আর চমৎকার সব মোটর গাড়ি। এটাই হলো ইসলামি দেশের চেহারা! ওয়াশিংটনে আমাদের রাষ্ট্রদূতের মাসিক বেতনের পরিমাণ ৯ হাজার টাকা অথচ ওই ধনী দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার এ থেকে কম বেতন পান। মহোদয়, পরিস্থিতি আপনার পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আমি আমার বন্ধুদের বলবো তারা যেন ইসলামের আর অবমাননা না করেন। আপনারা যখন গভর্নরদের ৬ হাজার টাকা করে বেতন দিতে চলেছেন তখন ইসলাম নিয়ে আপনাদের কোনো কথা বলার অধিকার নেই।

তার বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। খুব সহজ-সরল ভাবে তার অবস্থান তিনি পরিষ্কার করে তুলে ধরতে পারতেন। শুধু আবেগ নয়, যুক্তির জোর তার ভাষণে ছিল যথেষ্ট। এই ভাষণেও তার রাজনীতির গরিবমুখিনতা স্পষ্ট ভাবেই ফুটে উঠেছে ।

১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ: "…অতিবিপ্লবীরা বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে চায়। এরা স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে। আমি সব খবরই রাখি। এই অতিবিপ্লবীদের মধ্যে রাজাকার, দুষ্কৃতকারী ও বদর বাহিনীর লোক ঢুকে পড়েছে। এরা রাতের অন্ধকারে দেয়ালে পোস্টার ও ইশতেহার ছড়ায়। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। বিপ্লবের নামে লুটতরাজ, হত্যা চালাচ্ছে। এদের যে প্রকাশ্যে গুলি করি নি, এটা আমার দুর্বলতা নয়। কিন্তু প্রয়োজন হলে জনগণ তা করবে। মুখে মুখে সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের বুলি আউড়ে পেছন থেকে আঘাত করা চলবে না। স্বাধীনতা-বিরোধী তৎপরতা গণতন্ত্র নয়। …কোনো একটি দলকে দেওয়া জেনারেল রাও ফরমান আলীর চিঠি আমার কাছে আছে। এই দলের হাতে বিপুল অস্ত্র তুলে দিয়ে চিঠিতে লেখা রয়েছে, 'সবুজ বাংলাকে লাল করে দাও'। প্রয়োজন হলে আমি সে চিঠি জনগণের সামনে প্রকাশ করে দেবো।"

এই হলেন আদি ও অকৃত্রিম শেখ মুজিবুর রহমান। তার মধ্যে ঘোরপ্যাঁচ ছিল না। তিনি যা করেন, ঠিক করেন – এমন দাবি তিনি কখনো করেননি। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে তিনি যে ভুল করেন তা নিজেই অকপটে স্বীকার করেছেন। কাজ করলে ভুল হবে। তবে তিনি ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাননি। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যায়িত শেখ মুজিবের জীবন রাজনীতিবিজ্ঞানীদের জন্য এক পরম কৌতূহল জাগানিয়া বিষয়। তাকে তাই খণ্ডিত ভাবে নয়, বুঝতে হবে সামগ্রিকতায়। বঙ্গবন্ধু আমদের মাঝে নেই চার দশকের বেশি সময় হলো। কিন্তু যতদিন বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটি থাকবে ততদিন তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হবে কোটি কোটি কন্ঠে।