করোনার ওষুধ বা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন শুধু মানবজাতিকে ভয়াবহ এক ভাইরাস থেকে মুক্তির প্রচেষ্টাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রথম হওয়ার গৌরব বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা, ওষুধ বিক্রি করে টাকা কামানোসহ নানা ইস্যু। তাইতো করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রথম থেকে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যেখানে সামান্য সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে, সেখানেই ছুটে গেছে শক্তিধর দেশগুলো। একটি ভ্যাকসিন পেতে আমেরিকা,চীন, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। সাফল্যের প্রান্ত ছুঁতে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছেন বিজ্ঞানী-গবেষকরা। রাজনৈতিক নেতারা আগ বাড়িয়ে 'ভ্যাকসিন হাতে এসে গেছে, এই এলো বলে' ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছেন। বিশ্ববাসী রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের চূড়ান্ত খবরটা শোনার জন্য।
সেই চমকপ্রদ খবরটা এসেছে, তবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড কিংবা চীন নয়, খবরটা দিয়েছে রাশিয়া! আর তাতেই গোল বেঁধেছে। যারা ধারাবাহিকভাবে ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছে, অগ্রগতির প্রতিটি ধাপ সবিস্তারে বর্ণনা করছে, তারা কেউ নয়, ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দৌড়ে অন্ধকারে থাকা রাশিয়া আকস্মিক বজ্রানলের মতো ভ্যাকসিনের খবর দিয়ে চমকে দিয়েছে বিশ্বাবাসীকে!
আমেরিকার বিখ্যাত গল্ফ তারকা ওয়াল্টার হাগেন বলেছিলেন, "No one remembers who came in second"। অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়কে কেউ মনে রাখে না। আর সেই দ্বিতীয় হওয়ার আশঙ্কা কার্যত উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া। গত জুনেই কাজ শুরু করে ১১ অগাস্ট তারা জানিয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন প্রস্তুত।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলছিল চূড়ান্ত ঘোষণার প্রস্তুতি। তুলনা চলছিল মহাকাশযান স্পুটনিকের সেই সাফল্যের সঙ্গেও। ১১ অগাস্ট গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছে তাদের ভ্যাকসিনটি। তারপর থেকেই পৃথিবীজুড়ে এনিয়ে চলছে আলোচনা, সমালোচনা। কীভাবে আমেরিকা, ব্রিটেন বা চীনকে পিছনে ফেলে এত দ্রুত এগিয়ে গেল রাশিয়া? তবে কি বিশ্বের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের বাজারটা চলে আসবে তাদের দখলেই? চমকের এখানেই শেষ নয়, বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে রাষ্ট্রপতি পুতিনের মেয়ে মারিয়া অথবা ক্যাটরিনার শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে এই ভ্যাকসিন। প্রথম পর্যায়ে এই ভ্যাকসিনে মানবদেহে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দ্বিতীয় ধাপে দেহে গড়ে উঠছে প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনটাই জানান হয়েছে।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন তৈরির এই ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে আমেরিকা। বিপন্ন হয়ে পড়েছে ডনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। এখন পর্যন্ত আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সেখানে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হাজার–হাজার লোক কর্মহীন। ভোটের মুখে মরিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প গত মাসে ঘোষণা করে বসেন— ভ্যাকসিন উদ্ভাবনবিষয়ক গবেষণা প্রায় শেষের পথে। নভেম্বরের নির্বাচনের আগেই ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলবে আমেরিকা। কিন্তু পরের দিনই ট্রাম্পের উচ্চাশায় জল ঢেলে দেন আমেরিকার বিজ্ঞানীরা। জানিয়ে দেন, এ ভাবে তাড়াহুড়ো করে আর যা–ই হোক, ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব নয়!
এর পরেই 'বিজয়ীর মুকুট' ছিনিয়ে নেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ট্রাম্পের সেই ঘোষণার সপ্তাহ খানেক পরে রাশিয়ার কর্তা ব্যক্তিরা দাবি করেছিল, ''ফের 'স্পুটনিক মুহূর্ত' উপস্থিত! তারাই আনতে চলেছে প্রথম ভ্যাকসিন। স্পুটনিকের সময়ে আমেরিকাকে যেভাবে চমকে দিয়েছিল রাশিয়া, এ বারেও তার পুনরাবৃত্তি দেখবে ওয়াশিংটন!''
কথার অন্যথা হয়নি। তারাই প্রথম ঘোষণা করে, ভ্যাকসিন প্রস্তুত। নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই ভ্যাকসিন প্রয়োগে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে রাশিয়া! ভ্যাকসিনের নামও দেওয়া হয়েছে 'স্পুটনিক ভি'।
এরপর থেকেই যেন নয়া 'ঠাণ্ডা যুদ্ধ' শুরু হয়ে গেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চলেছিল আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূ–রাজনৈতিক লড়াই। ঠান্ডা যুদ্ধ বলা হয়, কারণ প্রকাশ্যে হানাহানি হয়নি। এবারেও পরিস্থিতি অনেকটা এক রকম। কে আগে প্রতিষেধক আনবে, তা নিয়ে এক অদৃশ্য লড়াই চলছে। এই মুহূর্তে রাশিয়া বিশ্বের সংক্রমণ–তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে। নয় লাখের কাছাকাছি আক্রান্ত। কিন্তু মৃতের তালিকায় প্রথম দশেও নেই তারা। দীর্ঘদিন ধরেই একাংশের দাবি, সত্যিটা গোপন করে যাচ্ছে রাশিয়া। এক সময়ে তারা 'হাতেগোনা আক্রান্ত' বলে চেপে রেখেছিল বিষয়টা। উল্টে করোনা–মোকাবিলায় সাহায্য হিসেবে আমেরিকাকে পিপিই পাঠিয়েছিল রাশিয়া। আমেরিকা এ নিয়ে এত দিন মুখ না–খুললেও, জানিয়েছিল রাশিয়ার ভ্যাকসিন তারা ব্যবহার করবে না। সম্প্রতি ব্রিটেনও একই কথা জানায়। মশকরা করে তাদের মন্তব্য, ''এই ভ্যাকসিন অনেকটা রাশিয়ার নির্বাচনী ফলের মতো হবে।''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকে বলে আসছে, ভ্যাকসিন তৈরি নিয়ে তাড়াহুড়ো করা বিপজ্জনক হতে পারে। তবে তারা রাশিয়ার স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র তারিক জাসারেভিক বলেছেন, ''রুশ কর্তাদের সঙ্গে প্রতিষেধকটির 'প্রিকোয়ালিফিকেশন' নিয়ে আলোচনা চলছে। কোনও ভ্যাকসিনকে পাশ করানোর আগে বারবার তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার পরে পাশ–ফেল।''
তবে রাশিয়া পাশ করুক বা ফেল, মস্কোর ঘোষণায় ক্ষুব্ধ গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা। কোভিড–১৯ ভাইরাস রুখতে বিশ্বে যখন ভ্যাকসিন উৎপাদনে সাফল্যের দৌড়ে এগিয়ে ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনকা, মডার্না, ফাইজারের মতো ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা, ঠিক সেই সময়ে প্রথম দেশ হিসেবে করোনার টিকা আবিষ্কারের দাবি জানিয়ে দুনিয়াকে চমকে দিয়েছে রাশিয়া। যদিও আমেরিকা–ব্রিটেনের মতো দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভ্যাকসিন এখনও প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে। ফেজ টু বা ফাইনাল স্টেজ পরীক্ষা, যেখানে কয়েক হাজার মানুষের উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়, তা করা হয়নি।
'স্পুটনিক ভি' ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত গোটা পৃথিবী। প্রথম শিবিরে রয়েছে আমেরিকা, জার্মানির মতো দেশ। যারা স্পুটনিক ভি–র কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে রয়েছে রুশপন্থী দুই দেশ—ফিলিপিন্স এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। উচ্ছ্বসিত ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতের্তে জানিয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি স্পুটনিক ভি–র ক্লিনিকাল ট্রায়ালে অংশ নেবেন। সম্ভাব্য এই ভ্যাকসিন পেতে ভারতও রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে। রাশিয়ার পাল্লা ক্রমেই ভারি হচ্ছে।
কীভাবে রাশিয়া এত দ্রুত টিকা আনল, ইতিমধ্যেই তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এপ্রিলে একটি আইন আনে পুতিন সরকার। সেখানে ফেজ থ্রি ট্রায়ালের আগেই ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করার অনুমতি দেওয়া হয়। স্পুটনিক ভি এই কাজটাই করেছে। তাই রাশিয়ার এই অগ্রগতিকে বড় ব্যাপার বলে মানতে নারাজ আমেরিকা।
একথা ঠিক যে বর্তমান বিশ্বে রাশিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা আছে। একটি ভাইরাসের প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যে ধাপগুলো অতিক্রম করতে হয়, তাও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। বলা যায় সন্দেহজনক গোপনীয়তা ও কিছুটা চালাকির মাধ্যমে তারা ভ্যাকসিনের সাফল্যের খবর প্রচার করেছে। কিন্তু তাদের এই উদ্ভাবন যে পুরোপুরিই ভুয়া- এমনটাও কিন্তু জোর দিয়ে কেউ বলছেন না। বিশিষ্ট চিকিৎসক, বিজ্ঞানী অথবা রাজনীতিবিদ– সকলেই একটি বিষয়ে একমত যে এই ভ্যাকসিন নিশ্চিতভাবে নিরাপদ। নাহলে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতির মেয়ে এই ভ্যাকসিন নিতেন না।
কেউ কেউ মনে করছেন, আমেরিকার সঙ্গে টেক্কা দিতেই রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত। বিশ্ববাজারে নিজেদের জায়গা প্রকাশ করতে এবং নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখতেই রাশিয়ার এই কাজ। কীভাবে কাজ করবে এই ভ্যাকসিন? এই সম্পর্কে মস্কোর গ্যামলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর আলেকজান্ডার গিন্টসবার্গ জানান, এই ভ্যাকসিন কিছু জড় বা নিষ্প্রাণ পার্টিকলস তৈরি করবে। শরীরের অ্যাডিনো ভাইরাসের উপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো তৈরি হবে। সেখান থেকেই তৈরি হবে করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করার মতো অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডিই গিলে খাবে করোনাভাইরাস।
তবে এই ভ্যাকসিন নিয়ে এখনই নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে না। গত আট মাসের ক্রমশ ভয়াবহ করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির উপর সর্বক্ষণ নজরদারি রাখতে রাখতে এবং দৈনিক সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভ্যাকসিনের আবিষ্কার ঠিক কোন পর্যায়ে আছে, বা মোট কতগুলো পর্যায় অতিক্রম করতে হয়, কারা অনুমোদন দেয়, কী ভাবেই বা তা বাজারে এসে সকলের ব্যবহার উপযোগী হয়, এ সব এখন সবার নখদর্পণে। রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি এখনও মানব ট্রায়ালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘ ধাপ তৃতীয় পর্যায় উত্তীর্ণ করেনি, যেখানে প্রতিষেধকের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়।
ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজটা যে দেশই করুক, তা নিরাপদ ও কার্যকর হওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি। রেষারেষি, শ্রেষ্ঠত্ব বা ব্যবসায়িক ভাবনা থেকে যথাযথ পর্যবেক্ষণ না করে তাড়াহুড়ো করে ভ্যাকসিন বাজারে ছেড়ে দিলে তা আরও বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। ইতিহাসে এ রকম নজির বেশ কিছু আছে। ২০০৭ সালে মার্কিন সংস্থা মার্ক এইচআইভি ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বন্ধ করে দেয়। কারণ এই ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত অ্যাডিনোভাইরাস–৫, যা একটি সাধারণ কোল্ড ভাইরাস আবার জিন ট্রান্সফার পরীক্ষার জন্যও কাজে লাগে, কিন্তু সেটি ব্যবহার করে দেখা গেল সংক্রমণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাই বন্ধ করে দেওয়া হল। দুঃখের বিষয় এই রুশ বংশোদ্ভূত 'স্পুটনিক–ফাইভ'-তেও আছে অ্যাডিনোভাইরাস–এর ছোঁয়া। কাজেই সব কিছু জেনে-বুঝে পর্যালোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে।
আমরা সকলেই এই মহামারী দ্রুত সমাপ্তির জন্য মুখিয়ে আছি, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে ফাস্টট্র্যাক ভ্যাকসিনে প্রচুর ঝুঁকির আশঙ্কা থাকবে, কারণ এখনও গবেষকদের এই ভাইরাসের চরিত্র সম্বন্ধে অনেক কিছুই অজানা রয়েছে। তাই তাঁরা যে কোনও বিপর্যয়কর পরিণতি এড়াতে ভ্যাকসিন প্রস্তুতির জন্য 'ফাস্ট ইজ্ স্লো, অ্যান্ড স্লো ইজ্ ফাস্ট' নীতিই মেনে চলতে চাইছেন।