অনলাইন শিক্ষায় ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা

মো. শফিকুল ইসলাম
Published : 13 August 2020, 10:59 AM
Updated : 13 August 2020, 10:59 AM

কোভিড-১৯ মহামারীতে সারাবিশ্ব এক আতঙ্কজনক সময় পার করছে। করোনাভাইরাসে বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিবিধিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থাও করোনাভাইরাসের প্রভাবের বাইরে নয়। করোনাভাইরাসে শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম থমকে রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীতে বিশ্বব্যাপী ৩০০ মিলিয়ন বা তার বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনতার পরে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সব দেশের সরকারই নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যাতে জনসাধারণ বিভিন্ন ইস্যুতে কম জমায়েত হয়। কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মনে করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অথবা একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এজন্য বাংলাদেশ সরকার অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। যা অবশ্যই ভালো পদক্ষেপ। অনলাইন শিক্ষামূলক ব্যবস্থা সহজলভ্য করে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং পিতামাতাদের অনুপ্রাণিত করা উচিত। শিক্ষা কার্যক্রম কিভাবে গতিশীল করা যায় সেই লক্ষ্যে সরকার এবং অন্যান্য শিক্ষা দপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারীতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় সংযোগ স্থাপন এবং শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। তাই এই বিষয়ে বিভিন্ন উপায়ে গবেষণা করা দরকার। কোভিড-১৯ এর ফলে সারা বিশ্বজুড়ে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংকটের কারণে স্কুল বন্ধ হওয়ায় ১৮৬টি দেশে ১.২ কোটিরও বেশি শিশু শিক্ষার বাহিরে ছিল। তবে ই-লার্নিংয়ের স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে কার্যক্রম পুনরায় চালু হওয়ায় শিক্ষা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যার মাধ্যমে দূরবর্তী অবস্থান এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষাদান চলছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে অনলাইন শিক্ষাগ্রহণে তথ্যের আদান প্রদানের ধরন পরিবর্তন হয়েছে এবং সময় কম প্রয়োজন হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় সকল উন্নত দেশ অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করছে। চীন, ডেনমার্ক ও দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তাদের শিক্ষকদের নিকট রোল কলে সাড়া দিচ্ছে। যদিও বিশ্বের অনেক জায়গায় হঠাৎ করে শ্রেণিকক্ষ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সাথে সাথে কেউ কেউ ভাবছেন যে অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণ গ্রহণ কীভাবে করোনাভাইরাস সংকটে বহাল থাকবে এবং কীভাবে এই পরিবর্তনটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষার বাজারকে প্রভাবিত করবে?

কোভিড-১৯ ইস্যুতে বিভিন্ন অ্যাপস, ভার্চুয়াল টিউটরিং, ভিডিও কনফারেন্সিং সরঞ্জাম বা অনলাইন লার্নিং সফটওয়্যার ইত্যাদির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন সরকার প্রায় এক বিলিয়ন শিক্ষার্থীদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পড়াশুনা পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দেয়, ফলে টেনসেন্ট অ্যাপ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে চীনে। পরবর্তীতে উহানে টেনসেন্ট অ্যাপে অনলাইন ক্লাসে প্রায় ৭,৩০,০০০ বা কে-১২ শিক্ষার্থীর ৮১% অনলাইন শিক্ষায় উপস্থিত হয়েছে যা শিক্ষার ইতিহাসে বৃহত্তম।

বর্তমানে আমাদের দেশেও স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে টেলিভিশন মাধ্যমে ক্লাস হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফেইসবুক, গুগল অ্যাপ, জুম এবং অন্যান্য মাধ্যমে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যথারীতি শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক আগে থেকে অনলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বেশ পরে এসে অনলাইন ক্লাস শুরু করে, সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পর। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয় তারা অধিকাংশ সচ্ছল পরিবারের। তাদের ইন্টারনেট সুবিধাসহ অনলাইন শিক্ষার অন্যান্য সরঞ্জামের অভাব নেই বললেই চলে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা রয়েছে; যেমন অনেকের ইন্টারনেট এবং ল্যাপটপ, স্মার্টফোন নেই। যার কারণে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এক প্রকারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনলাইন শিক্ষার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। অনলাইন শিক্ষায় আরও কিছু অসুবিধা রয়েছে যেমন, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরাসরি কথোপকথনের অভাবে অনলাইন ক্লাসকে সফল করা কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে বিদ্যুতের বিঘ্নিত সরবরাহ অনলাইন শিক্ষার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক। এখনো কিছু মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে রয়েছে। অস্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দুর্বল বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা অনলাইন শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষক বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছেন কিন্তু এমন অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা বাস করে যেখানে বিদ্যুৎ নেই। সুতরাং এটি অনলাইন শিক্ষার জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ।

এছাড়াও বাংলাদেশে অনেক শিক্ষার্থী এ জাতীয় ই-লার্নিংয়ে অভ্যস্ত নয়। শুধু শিক্ষার্থীরা নয় স্কুল ও কলেজের অনেক শিক্ষকই গতানুগতিক পাঠদান পদ্ধতিকে বেশি পছন্দ করেন। আমার পর্যবেক্ষণে, এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাসে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন (পিপিটি) এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নন। উল্লেখিত চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষা ব্যয়বহুলও। অনলাইন শিক্ষার জন্য যেসব সরঞ্জাম দরকার, আমাদের শিক্ষার্থীদের সেগুলো ক্রয় করতে যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতা থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর সেটা নেই। এছাড়াও অনেকের ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম থাকলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে না। কারণ দুর্বল নেটওয়ার্ক ও নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত অনেকের আর্থিক সামর্থ্যের অভাব। তাই অনলাইন শিক্ষার গৃহীত পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়ন কিছুটা সংশয়ের মুখে।

আমার একটি ব্যাচের কথা বলি যেখানে আমি তিনটি ক্লাস নিয়েছি, সর্বোচ্চ উপস্থিতির হার ৫০% এবং অন্য সহকর্মীদের সাথে কথা বলে জানতে পারি যে তাদের ক্ষেত্রে একই রকম চিত্র। ব্যতিক্রমও আছে, কোনো কোনো ব্যাচে ৬০-৭০% উপস্থিত হয়ে থাকে। উপস্থিতির হার কম হওয়ার কারণ হলো ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নেই। আমাদের দেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে পুরোপুরি ফ্রি ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তাই সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নিউ নরমাল পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদেরকে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ফ্রি ইন্টারনেট সেবা এখন সময়ের দাবি। যেসব শিক্ষার্থীর আর্থিক সমস্যা রয়েছে তাদেরকে শনাক্ত করে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর অনুযায়ী ঐসব শিক্ষার্থীকে ফ্রি ইন্টারনেট দিতে পারলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে।

সার্বিক বিবেচনায় করোনাভাইরাস সংকটে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার জন্য অনলাইন শিক্ষার বিকল্প নেই। অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেশনজট কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে এবং তাদের মেধা ও চিন্তা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। অন্যথায় সমাজের নেতিবাচক বিভিন্ন বিষয়ে তারা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বে যা পরে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়াতে পারে। শুধু বাংলাদেশে সমস্যা রয়েছে এমন নয়, নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেস অথবা স্মার্টফোন ব্যতীত অন্য দেশের কিছু শিক্ষার্থীও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে লড়াই করছে যার মধ্যে সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ইন্দোনেশিয়া এবং অষ্ট্রিয়া রয়েছে।

যাদের নিকট সঠিক প্রযুক্তির অ্যাক্সেস আছে তাদের পক্ষে এমন প্রমাণ রয়েছে যে অনলাইনে শিক্ষা বেশ কয়েকটি উপায়ে আরও বেশি কার্যকর হতে পারে। যেমন কিছু গবেষণা দেখা যাচ্ছে যে ক্লাসরুমের তুলনায় অনলাইনে শিক্ষার সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি মনযোগী থাকে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে দ্রুত শিখতে সক্ষম হওয়ার কারণে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা গ্রহণের তুলনায় ই-লার্নিংয়ে ৪০-৬০% কম সময় প্রয়োজন হচ্ছে কারণ শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব গতিতে শিখতে, পড়তে বা জ্ঞান অর্জন করতে পারে। তবুও, অনলাইন শিক্ষার কার্যকারিতার ক্ষেত্রে বয়স বা গ্রুপের মধ্যে তারতম্য দেখা যায়। অনলাইনে যে অ্যাপ বা ভিডিও বাচ্চারা শেখার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে, তাই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শেখার সেই অ্যাপ বা ভিডিও অত্যন্ত প্রাণবন্ত এবং কার্যকর করা গুরুত্বপূর্ণ।