সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে

বিধান চন্দ্র পালবিধান চন্দ্র পাল
Published : 11 August 2020, 10:16 AM
Updated : 11 August 2020, 10:16 AM

বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণের নানা অভিজ্ঞতা যেন আমাদেরকে একটা কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেটা হলো– সকলের জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অর্থনৈতিক মুক্তি, সুশাসন, পরিবেশ ইত্যাদি অনেক কিছুর সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা জাতীয় উন্নয়নের জন্য, এসডিজির গোলসমূহ শতভাগ অর্জনের জন্য এবং করোনাভাইরাস পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোর জন্য কোন পথে যাব, কী করণীয়? – সেটাই যেন এখনকার সবচাইতে বড় প্রশ্ন।

বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র তত্ত্বাবধানে Health for All বা 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে কাজাখিস্তানের আলমাআতা শহরে সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বা Primary healthcare (PHC) পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। আলমাআতা ঘোষণার মূল সুরই ছিল স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বজনীন করে একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা। সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২০০০ সাল পর্যন্ত। কমিউনিটির সকলের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা, সকল সেক্টরের সমন্বয়, যথোপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং ন্যায্যতার-ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়টিও সেখানে উল্লেখিত হয়েছিল। এছাড়া মূলনীতিতে "essential healthcare" বা অতি-প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ২০০০ সাল নাগাদ Primary Healthcare এর সন্তোষজনক লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তাই ২০০০ সালে জাতিসংঘ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (Millennium Development Goals -MDGs) ঘোষণায়ও ৮টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে শিশু, মাতৃস্বাস্থ্য ও রোগব্যাধির বিষয়টিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়। লক্ষ্য অর্জনের সময় নির্ধারণ করা হয় ২০১৫ সাল পর্যন্ত।

অনেক কাজের মধ্য দিয়ে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কাল অতিবাহিত হয়েছে। এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে – যা বিশেষভাবে প্রশংসিতও হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতিও পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যের উন্নতিতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ পুরস্কৃত হয়েছে। তারপরও সকলের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে। ফলে ২০১৬ থেকে ২০৩০ মেয়াদে এসডিজির যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্ব সহকারে সকলের জন্য স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আমাদেরকে আরও উপলব্ধিতে আনতে সহায়তা করেছে, আসলেও সকলের জন্য স্বাস্থ্যের বিষয়টি কতটা প্রয়োজনীয়।

সবার জন্য স্বাস্থ্য এ বিষয়টি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে। কিন্তু সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে যে জাতীয় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, অবকাঠামো, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন সেটি লক্ষ্য করা যায় না। করোনাভাইরাস আসায় এই দুর্বলতাগুলো আবার যেন সবার সামনে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এটা সুস্পষ্ট যে, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ হতদরিদ্র, দরিদ্র ও দারিদ্র্যের হুমকিগ্রস্থ মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অনুপস্থিত। অন্যদিকে মানুষের রোগ বিশেষভাবে অসংক্রামক রোগ (যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) দিন দিন নানা কারণে বেড়ে চলেছে। এছাড়া এখন আমরা নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। অনেক পুরোনো রোগও আবার নতুন আঙ্গিকে ফিরে আসছে। ফলে ক্রমবর্ধমান রোগের জন্য জনসাধারণকে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দূর করে সার্বিকভাবে করোনাভাইরাস অতিমারি পরিস্থিতি মোকাবেলা করাটা সত্যিই রাষ্ট্রের ও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা অনেকসময়ই স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে যথার্থ ধারণা পোষণ করি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমাআতা ঘোষণায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে – Health is not merely the absence of disease or infirmity. It is a state of complete, physical, mental and social well-being. অর্থাৎ আমরা শারীরিক অবস্থার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে যখন স্বাস্থ্যসেবার কথা বলি তখন মানসিক এবং সামাজিক দিকটি যথেষ্ট বিবেচনা পায় না।

অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবার কতগুলো ধারা আছে যেগুলোকে Promotive, Preventive, Curative and Rehabilitative খাত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্তর হিসেবে Primary, Secondary এবং Tertiary হিসেবে বিভাজন করা যায়। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা মূলত Curative দিকটিতেই দৃষ্টি দেয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে Preventive প্রচেষ্টাও নিতে দেখা যায়। ফলে আমাদের স্বাস্থ্য চিন্তা কিংবা স্বাস্থ্য নীতি সংক্রান্ত বিষয়সমূহে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে একটি Holistic অবস্থান লক্ষ্য করা যায় কি-না, সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যায়।

স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে Promotive Care এর দিকে প্রাথমিক বিবেচনা দিতে হবে। যেটি আজকে বিভিন্ন অজ্ঞানতা, আয়-বৈষম্য ইত্যাদির কারণে প্রায় অবহেলিত। তেমনিভাবে Preventive Care সম্পর্কেও কেবল টিকাদানের বিষয়টিই সবসময় প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে অনেককিছু এবং অনেক কথা হলেও জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ বিবেচনা তেমন একটা লক্ষ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে School Health, Working Place Health, Long Term Care for Old Aged People, Palliative Care for Old Aged People ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনও অনেকটাই অবহেলিত। দুর্যোগ প্রবণ এলাকার Promotive, Preventive, Curative এবং Rehabilitative স্বাস্থ্য সম্পর্কিত চাহিদা নগরাঞ্চলের স্বাস্থ্য চাহিদার থেকে ভিন্ন। আঞ্চলিক ভিন্নতার কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসলেও নীতি প্রণয়নে কিংবা পরিকল্পনায় এর সুবিবেচনা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। প্রসঙ্গত বলা বাহুল্য যে, এখনও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল, হাওড় অঞ্চলের নিম্নভূমি এবং উপকূল ও চরের জনগোষ্ঠীর জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে রয়েছে অনেক বাধা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও এমন ধরনের অসংখ্য উদাহরণ আমরা দেখেছি এবং এখনো দেখছি।

আমাদের দেশে আসলে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা দিতে হলে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা সবচাইতে বেশি। অথচ এদেশে স্বাস্থ্যসেবার মূল্যায়ন সম্পর্কিত গবেষণা নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্যসেবার সামাজিক দিকটির গবেষণাও একেবারেই অনুপস্থিত। কিছু কিছু গবেষণা আজকাল হচ্ছে। কিন্তু রোগ, রোগী, তার সামাজিক-পারিবারিক অবস্থান, তার জীনগত বৈশিষ্ট্য, নানা কর্ম সম্পাদন ইত্যাদির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বিশেষ কোন গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অন্যদিকে ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক, নার্স-ডাক্তারের সম্পর্ক, ডাক্তার-নার্স ও রোগীর ব্যবহারিক আচরণ ইত্যাদি নিয়েও বিশেষ গবেষণা আছে বলে আমরা লক্ষ্য করি না।

পরিবেশ ধ্বংস বা দূষণের কারণে কী পরিমাণ মানুষের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি বা দেশের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়েও নির্ভরযোগ্য কোন গবেষণা নেই। এছাড়া গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো নিয়েও কোন মূল্যায়ন প্রচেষ্টা (যেমন: ভবন ভেঙ্গে পড়ছে, ডাক্তার নেই, ঔষধ নেই, শয্যা সংখ্যা অনুপাতে প্রয়োজনীয় জনবল ও বাজেট নেই ইত্যাদি) লক্ষ্য করা যায় না। স্বাস্থ্যনীতিতে গবেষণার বিষয়টি নানা সময়েই উল্লেখিত হয়েছে, কিন্তু যথার্থ গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ গবেষণার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সরকারি ও বেসরকারি প্রণোদনা ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা অনুপস্থিত। ফলে সেই জাতীয় কোন ধরনের গবেষণার ভিত না থাকায়, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যনীতি মূলত নানা মতামত ও অন্যদেশের অভিজ্ঞতাকে বাংলাদেশের আলোকে বিবেচনা করেই প্রণীত হয়ে আসছে।

আমাদের দেশে সবক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব লক্ষ্য করা যায়। নার্স, ডাক্তার অথবা সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীর অনুপাত যথার্থ নয় বলে আমরা জানি। ডিপ্লোমাধারী স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না এবং তাদের যথার্থ মর্যাদাও দেয়া হয়নি। নার্স ও হেলথ টেকনোলজিস্ট সম্পর্কে একই কথা বলা চলে। স্মরণ রাখতে হবে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কখনোই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন না। এক সময়ে এই দেশে দু'বছরের মেডিক্যাল স্কুল পাশ করা ডাক্তাররা গ্রামে Curative চিকিৎসা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে দিয়েছে। এখনও গ্রামাঞ্চলে ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকেরাই এই শূন্যতা পূরণ করেন।

সরকারের উদ্যোগে একসময় যে পল্লী চিকিৎসক বা গ্রাম ডাক্তারের চিন্তা করা হয়েছিল সেটি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এজন্য সমস্যা সমাধান না করে আমরা একটি সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটিয়েছি। অথচ করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশের অনেক স্থানে তারা কাজের মাধ্যমে অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের সবার জন্য স্বাস্থ্য এবং জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য পৌঁছে দিতে হলে বর্তমান সামাজিক অবস্থায় বিকল্প চিকিৎসক জনবলের ব্যবস্থা করতে হবে।

পল্লী চিকিৎসক, গ্রাম ডাক্তারসহ সকল ইনফরমাল হেল প্রোভাইডাররা দেশের এই অতিমারির পরিস্থিতিতেও বাজার চাহিদা অনুযায়ী একটি বিকল্প সেবাদানের ক্ষেত্রও তৈরি করে চলেছেন। এ জাতীয় জনবলকে তাই আরও দক্ষ করে তোলা, সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে তাদের সাথে পরিকল্পিত উপায়ে প্রযুক্তি ও মানসম্মত চিকিৎসকদের সংশ্লেষ ঘটানো এবং আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রের সাথে সমন্বয় ঘটানো এখন অত্যন্ত জরুরি।

সাম্প্রতিক সময়ে পল্লী চিকিৎসকদের সংখ্যা জানার এবং আলাদা শিক্ষা বোর্ড গঠন করে তাদের মূল্যায়ন করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে আমরা জানতে পেরেছি- যা সত্যিই আশার সঞ্চার করে। এছাড়া স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এখন প্রযুক্তি ব্যবহারের নানামুখি প্রয়াস ও প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। যা এক অর্থে আশাব্যঞ্জক কিন্তু অন্যদিকে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ও সচেতন ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং নানা উদ্যোগের পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু সমন্বয়ন নিশ্চিত করার ভাবনাটিও এখন বিশেষভাবে ভাবাটা জরুরি।

এছাড়া অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবদান রাখতে পারে। দেড়শ বছরের পুরোনো এ প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে করোনাভাইরাস কিংবা এ ধরনের বড় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে স্থানীয় অনেক সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া রোগে আক্রান্ত হবার হার কমিয়ে আনা এবং প্রাথমিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং সেবা পরিকাঠামোকে গণমুখী করার জন্য বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিতে পারে।

সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ব্যয় জনগণের আয় ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুসারে জুন, ২০১৯ মাসের শেষে দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ আর অতি দারিদ্র্যের হার সাড়ে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ বিবিএসের প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ১৬ কোটি ৪৬ লাখ জনগোষ্ঠী আছে। সবমিলিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সোয়া তিন কোটি মানুষ।

এছাড়া বর্তমানে পরিবেশ দূষণ, বিষাক্ত খাদ্যগ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবন-যাত্রার পরিবর্তনের ফলে আশঙ্কাজনকহারে বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটছে। বিশেষ করে বাড়ছে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক এবং কিডনি সমস্যাসহ অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধি। চিকিৎসা হয়ে উঠছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ঔষধ, যন্ত্রপাতি ও অবকাঠমো তৈরিতে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে। তারপরও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি রোগী সুস্থ হলেও রোগী ও তার পরিবারবর্গ, সমাজ ও রাষ্ট্র নানাভাবে যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা এমন অনেক ঘটনাই লক্ষ্য করেছি। যেমন: একটি বেসরকারি হাসপাতালে একজন করোনা রোগীকে ৩০ মিনিট অক্সিজেন দেওয়ার পর ওই রোগীর স্বজনদের হাতে ৮৬ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ জুন, ২০২০)।

দ্য ইকোনমিস্টের সর্বশেষ ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম খরচ করা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। আবার জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি অনুপাতে বরাদ্দ পাওয়া এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য খাতের আর্থিক সুরক্ষার বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বে সবচেয়ে কম খরচ হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

দেশের চার শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র হয়ে যায় স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত খরচের জন্য। এ থেকেই বোঝা যায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কত খারাপ। অসুস্থতার কারণে সম্পদ বিক্রি এবং দরিদ্রতার নিম্নস্তরে নেমে আসা এদেশে খুব ব্যতিক্রম নয়। ২০১৯-২০২০ সালের বাজেটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ ছিল মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থমূল্যে যার পরিমাণ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। পুরো বাজেটের আকারের তুলনায় তা ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ পরিবহন ও যোগাযোগ খাত পেয়েছিল বাজেটের ২৬ দশমিক ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাত পেয়েছিল ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগের বছর (অর্থাৎ ২০১৮-২০১৯) ছিল জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। অথচ উন্নত দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ডে ব্যয় করা হয় জিডিপির ৯ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, কোনো দেশে কোনো নাগরিকের স্বাস্থ্য ব্যয় তার সামগ্রিক ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি হলে সেই দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল বলে বিবেচিত হয়। অথচ বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বছর বছর বাড়ছে। বিবিসির গত ১০ জুন, ২০২০-এর এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ৩৪ টাকা এবং বাকি ৬৬ টাকা রোগী নিজে বহন করে। যা সত্যিই অপ্রত্যাশিত।

আমরা চাইলে খুব সহজেই একটি স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। আয় সম্পর্কিত ও পরিবার সম্পর্কিত তথ্য থেকে এ জাতীয় প্রকল্প তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব কিছু নয়। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা চালু হওয়া সম্ভব এবং গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে ব্যক্তিক স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় সহনীয় সীমায় নিয়ে আসা যায়। বেসরকারি খরচবহুল হাসপাতালে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তের প্রবেশাধিকার অর্থ ও খরচের কারণে অনেকটাই নিষিদ্ধ হয়ে আছে। এছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকেরা আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে এত বেশি শক্তিশালী যে তারা তাদের নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও অনেকক্ষেত্রেই চিকিৎসার বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেন, যেখানে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণই থাকে না।

সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও, প্রাইভেট হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা নিয়ে তেমন আলোচনাই লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু প্রতিনিয়ত তাদের ভুল চিকিৎসা, অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ ইত্যাদির কারণে মানুষ অর্থনৈতিক ও শারিরীকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এর ব্যতিক্রমী কিছু নজির অবশ্য আমরা দেখতে পেয়েছি। যা আশাব্যঞ্জক।

অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রসমূহের মান নিয়ন্ত্রণ যে কতটা দুর্বল তাও করোনাকালে সবার সামনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রসমূহের বৈধ অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালকের কার্যক্রমকে আরও ঢেলে সাজানো এবং জোরদার করা প্রয়োজন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রয়োজনে মান নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেয়া এবং হাসপাতাল পরিচালকের কাজ বিকেন্দ্রীকরণ করে বিভাগীয় পর্যায়ে নেবার বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা যেতে পারে।

তবে সর্বোপরি একথা বলতেই হয় যে, বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালগুলিতে সেবা ব্যবস্থাপনা এবং হিপোক্রেটিক ওথ বা শপথ – যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মান্য করা হয় না, সে বিষয়েও কোন পদক্ষেপ বা নীতি ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যায় না। এছাড়া বায়োলজিক্যাল সাইন্স নিয়ে গবেষণা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল এসোসিয়েশন প্রণীত হেলসিংকি ডিকলারেশন বা নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না বলেই অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়।

জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ বছর বা ঊর্ধ্বে যারা রয়েছে তাদের প্রবীণ বলে স্বীকৃত। পরবর্তীতে তাদের সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বয়সের মানদণ্ডে বর্তমানে বাংলাদেশে ৮% মানুষ ৬০ বছর কিংবা উপরে (২০১৯ সালে বিবিএস প্রকাশিত রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিক্টিস ২০১৮-এর তথ্যে) রয়েছে যা জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩০ সালে পৌঁছে যাবে প্রায় ১২ শতাংশে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন এইজিং রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫ বছর ও উপরে জনগোষ্ঠী রয়েছে ৫.২%। আর ভারতে ৬৫ বছর ও উপরে রয়েছে ৬.৪%, পাকিস্তানে ৪.৩%, নেপালে ৫.৮%, শ্রীলংকায় ১০.৮% এবং ভুটানে ৬.১%।

এ বয়স্ক জনগোষ্ঠী নানাবিধ সমস্যার সন্মুখীন হয়ে থাকেন চাহিদার পরিসরে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বয়সভেদে বেশ তারতম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশ ও অঞ্চলভেদে করোনাভাইরাস সংক্রমণে ভিন্নতা দেখা গেলেও এক্ষেত্রে প্রবীণ জনগোষ্ঠীই বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক উপাত্তেও লক্ষ্যণীয়। আর এ বয়স্ক মানুষদের করোনাভাইরাসের সাথে অন্যান্য রোগ থাকলে কো-মরবিডিটি (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডাইবেটিস, ফুসফুসে সমস্যা) থাকলে তাদের করোনাভাইরাসে অধিকতর মৃত্যুঝুঁকি লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

ফলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ও চিকিৎসা সেবা প্রদানে দেশের সবচেয়ে বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এই জনগোষ্ঠীর মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাটা এখন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষের চিকিৎসার জন্য আলাদা প্রবীণ হাসপাতাল স্থাপন ও তাদের চিকিৎসা ও সেবা দেবার জন্য স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করাটাও এখন সবচাইতে বেশি প্রয়োজন– যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। পাশাপাশি শিশু খাদ্য, শিশুর ঔষধ, মাদক, তামাকজাত দ্রব্য, জরুরি ঔষধ এবং প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয় হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরিকল্পনাগুলিতে Accountability ও Affordability-র দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করাটাও খুব বেশিই জরুরি।

স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের যে কোন আলোচনাতেই প্রাধান্য পায়– কোথায় ডাক্তার নেই, ঔষধ নেই, হাসপাতাল নেই, সিট নেই, হাসপাতালের দুরবস্থা, দুর্নীতি, অনিয়ম, বাজেটে বরাদ্দ কম, দালালদের উপদ্রব ইত্যাদি অনেক বিষয়। এর প্রতিটি বিষয়ই চিকিৎসাকেন্দ্রিক। এ বিষয়গুলোরও আলোচনা ও সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু এ সকল আলোচনার ভিড়ে হারিয়ে যায় Preventive দিকটি– আমরা কীভাবে রোগ হ্রাস বা প্রতিরোধ করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ করোনাভাইরাস ও হাকিমপুর মডেলটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় মাস্ক পরা ও শারিরীক দূরত্ব পালন বাধ্যতামূলক করাই শুধু নয়, তা বাস্তবায়নও করা হয়েছে সফলভাবে। ফলে সেখানে অন্যান্য উপজেলার থেকে করোনার প্রকোপ নেই বললেই চলে। প্রত্যেকটি স্থানে প্রশাসন যদি সত্যিকারভাবেই সক্রিয় হতো তাহলে এমন চিত্রটা তো সারাদেশেরই হতে পারত!

বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫-এ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে চিকিৎসাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) এ জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য না থাকায় তা বলবৎযোগ্য অধিকার হিসেবে দাবি করা যাচ্ছে না। দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে, স্বাস্থ্যকে বলবৎযোগ্য মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া দরকার এবং রোগ প্রতিরোধকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।

করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী মহামারি ঘোষণা করার পর এই রোগটি মোকাবেলায় সংক্রামক রোগ সংশ্লিষ্ট একটি আইন– 'সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মুল) আইন, ২০১৮ প্রয়োগের দিকে নজর দিয়েছে বাংলাদেশ। সেই আইনটির অনেকগুলো অসঙ্গতিই আমরা লক্ষ্য করেছি যা নিয়ে আলাদা আলোচনা হতে পারে, কিন্তু করোনাভাইরাসের অভিজ্ঞতার আলোকে সেগুলো দূর করে সেটাকে যুগোপযোগী করে তোলাটাও এখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ হবে।

স্বাস্থ্য সেবাদানের ক্ষেত্রে সরকারি যে ব্যবস্থা আছে সেখানে বিভিন্ন কারণেই সুশাসনের অভাব আছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে যথার্থ মানবিক গুণসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর যেমন প্রয়োজন; তেমনি প্রয়োজন একটি পরিচ্ছন্ন সাংগঠনিক ব্যবস্থা ও দায়বদ্ধ প্রশাসন। এর সাথে যুক্ত আছে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও মেডিক্যাল সাপ্লাই ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং অসুস্থ ব্যক্তির অধিকার সম্পর্কে সজ্ঞানতা। আমরা জানি, অনেকসময় প্রতিষ্ঠানের ওপর সেবা চাহিদার যে চাপ পড়ে সেটা মোকাবেলা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক সিদ্ধান্তগ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেক সময়ই যথাযথ হয় না। বিভিন্ন স্থানের স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র নির্মাণের সময় শৈথিল্যের কারণে অল্প দিনেই ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থাপনার পরিচ্ছন্নতা নিয়েও নানা প্রশ্ন থাকে এবং এই সমস্ত হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে সেকেন্ডারি ইনফেকশন একটি চিহ্নিত সমস্যা। মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও যথেষ্ট মানসম্মত নয় এবং সেখান থেকেও রোগের বিস্তার ঘটে।

Promotive এবং Preventive Care এর অনুপস্থিতিতে Curative Care এর ওপরে যে চাপ সৃষ্টি হয়, সেটি বিকল্প ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। অতি প্রয়োজনীয় ঔষধের ঘাটতি একটি নিত্যদিনের ঘটনা। অতি প্রয়োজনীয় ঔষধ উৎপাদন, বিতরণ ও রোগীর কাছে পৌঁছে দেয়ার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুপস্থিত। তার সাথে যুক্ত হয়েছে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বৈত ভূমিকা, অর্থাৎ তিনি সরকারি হাসপাতালে যত না সময় দেন, তার চাইতে বেসরকারি হাসপাতাল অথবা নিজস্ব ক্লিনিকে কিংবা সাম্প্রতিক সময়গুলিতে অনলাইনে অনেক বেশি সেবা প্রদান করে থাকেন। এ দ্বৈত ভূমিকার কারণে এক জাতীয় মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সেইসাথে আছে ভেজাল ঔষধের ছড়াছড়ি, ঔষধের উচ্চমূল্য এবং ঔষধ কোম্পানীর মার্কেটিং এজেন্টদের উপদ্রব। অর্থাৎ এখানে চিকিৎসা সেবাদানকারী সকল কর্মীদের প্রণোদনা, স্বীকৃতি, পদায়ন ও পদোন্নতির কোনো স্বচ্ছ ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা নেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লেষ। ফলে দায়বদ্ধতার ঘাটতি দেখা যায়।

এ প্রেক্ষিতে আমাদের দাবি করার প্রয়োজন হবে, নীতি প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে চারটি দিক বিশেষভাবে বিবেচনা করা। এগুলো হলো– information, technology, human agent এবং organization। আর এই চারটি বিষয়ই Primary, Secondary এবং Tertiary ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। Primary চিকিৎসায় যথার্থ সাফল্য Secondary and Tertiary ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনীয়তা সীমিত করে আনে। তবে এক্ষেত্রে যথোপযুক্ত রেফারেল সিস্টেম গড়ে তোলাটা অত্যাবশ্যকীয়। ফলে এটা স্পষ্ট যে, একটি সমন্বিত, কার্যকর এবং বহুখাত সমর্থিত স্বাস্থ্যসেবা দানের প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রয়োজন আছে। যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা একটি বহুধা বিভক্ত কর্মের ওপরে নির্ভরশীল সেজন্য এ খাতের স্বার্থকতার জন্য পারস্পরিক সহায়তা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সুশাসনের জন্য এই বিভিন্ন দিকটি আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

একথা সত্যি যে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আমাদের দেশে চিকিৎসা সেবা অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু তাও এখনো পর্যন্ত সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা থেকে আমরা অনেক দূরে আছি। ফলে স্বাস্থ্যখাতে যেমন বরাদ্দ বাড়াতে হবে তেমনি টাকা ব্যায়ের ক্ষেত্রেও দক্ষতা ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে। দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে অনেক সমস্যা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাস আসায় পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই শুধু গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি, অর্থনীতিসহ জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রই বিরাট সংকটের মুখে পড়ে গেছে। একদিকে জীবন বাঁচাতে হবে, সংক্রমণ রোধ করতে হবে, আক্রান্তদের চিকিৎসা প্রদান করতে হবে অন্যদিকে রোজগারহীন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অর্থনীতির চাকাও সচল রাখতে হবে – এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পুরো সরকারের সমন্বিত তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাত, এনজিও, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ পুরো সমাজের আরও সক্রিয়তা জরুরি। যে কথাটা একেবারে লেখার শুরুতেই বলেছি, সেটা সচেতনভাবে খেয়াল রাখতে হবে। সকলের জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টি অর্থনৈতিক মুক্তি, সুশাসন, পরিবেশ ইত্যাদি অনেককিছুর সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়া দক্ষতার সাথে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলা করা এবং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়নের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ হবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে সকল চিকিৎসা কারিকুলাম (ডাক্তার, নার্স, টেকনোলোজিস্ট ইত্যাদি) যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের নিজস্ব আঙ্গিকে আধুনিকীকরণ করে তোলা এবং সেবাদানকারীদের মধ্যে এ্যাম্পেথির (Empathy) মনোভাব সৃষ্টি করা।

স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যে মানুষের অধিকার, কারো দয়া বা করুণার বিষয় নয় – এটাও সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে বোঝানো এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছেন তাদের জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির জন্য সচেষ্ট হতে হবে। অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলেই এইসব ক্ষেত্রে অর্জন, এসডিজির গোলসমূহ অর্জন করা এবং সর্বোপরি করোনাভাইরাস কিংবা এ ধরনের বিপদশঙ্কুল পরিস্থিতি আরও সুদৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করা সহজতর হবে। স্বাস্থ্য অধিকারের দাবিতে দেশে একটি স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

পরিশেষে, স্মরণ রাখতে হবে সেই উক্তি যে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষেরাই সুস্থ মনের অধিকারী হন এবং সার্বিক উৎপাদন ও উন্নয়নে অবদান রাখেন। আমাদের জাতীয় উন্নয়নের জন্য, এসডিজির গোলসমূহ শতভাগ অর্জনের জন্য এবং করোনাভাইরাস পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে নতুন একটি সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি আলমা-আতা ঘোষণার দশটি ধারায় যে কথাগুলো উল্লেখিত হয়েছে, তার বাংলাদেশি প্রেক্ষিত রচনাই আমাদের জন্য বর্তমানে সবচাইতে প্রয়োজনীয় হবে। আর এর মধ্য দিয়েই সবার জন্য স্বাস্থ্য, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্য এবং অসহায়ের জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পথ অনেকটা হলেও সুগম হবে বলেই বিশ্বাস করি।