রেমিটেন্স-যোদ্ধাদের বিড়ম্বনার শেষ কোথায়!

হাফিজুর রহমান মিতু
Published : 10 August 2020, 08:51 PM
Updated : 10 August 2020, 08:51 PM

দেশে ফিরতে কামাল হোসেনের বাচ্চার জন্য পাসপোর্ট লাগবে। দুই মাস ঘুরেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান না তিনি। পরে বাধ্য হয়ে রোম বাঙালি কমিউনিটিতে সক্রিয় এক ভাইয়ের মাধ্যমে ৩০ ইউরো বেশি দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলেন। বলছিলাম, বছর দেড় আগের কথা।

ইতালির রোমের বাংলাদেশে দূতাবাসের বর্তমান পরিস্থিতি তো আরও খারাপ। ইতালিতে বা রোম ও এর আশেপাশে কয়েকলাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য দূতাবাসের মাত্র দুইটি নম্বর সচল রাখা হয়েছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে। বলার অপেক্ষা রাখে না যেগুলো বেশিরভাগ সময়েই ব্যস্ত থাকে। অনলাইন লাইভে এক টকশোতে এসে ইতালি বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি রিপন খান জানান, তিনি এক নাগাড়ে ১৮৬ বার কল দেওয়ার পর দূতাবাসের নম্বরে সংযোগ পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে তিনি নিজেকে ভাগ্যমান মনে করছেন!

রোমের উত্তরাঞ্চলে থাকা রুবেল হোসেন নামে এক প্রবাসী সকাল ১০টা থেকে কল করতে থাকার পর ২০৯ বারের সময় সংযোগ পেয়েছেন বলে জানান আমাকে।

প্রায় চার বছর আগে নিয়োগ পেয়ে বর্তমান রাষ্ট্রদূত রোম আসেন। এরপর থেকেই নানান সমস্যায় প্রবাসীদের পাশে থেকে সহযোগিতা করা একমাত্র মাধ্যম দূতাবাস যেন ইতালিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায়। অভিযোগ আছে, উনি আসার পর থেকেই মূলত অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাণিজ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। সরকারি দলের একাংশের সাথে মধুর সর্ম্পক বজায় রেখে তিনি রয়েছেন গডফাদারের ভূমিকায়। এমনও অভিযোগ আছে, রোমে অবস্থানরত বাঙালি কমিউনিটির নেতারা দূতাবাসে কর্মরত সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মচারিদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে এর জবাব দেন রাষ্ট্রদূতের প্রশ্রয়ে থাকা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা কর্মীরা।

তারা রাষ্ট্রদূতের পক্ষ নিয়ে তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদকারিদের জামায়াত-বিএনপির এজেন্ট বলে ট্যাগ দেন। অথচ ইতালি আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিতে প্রতিবাদকারিদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

ইতালিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষে দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এবং তাকে সহায়তাকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাদের সমন্বয়ে রোমে গঠিত হয়েছে 'দালাল নির্মূল এবং দূতাবাস দুর্নীতিমুক্তকরণ কমিটি'।

বাংলাদেশ সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সবাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের 'রেমিটেন্স যোদ্ধা' বলে ভূষিত করে থাকেন। কিন্তু ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে প্রবাসীদের সাথে অমানবিক এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড, ঢাকা ও সিলেট এয়ারপোর্টে নানানভাবে হয়রানির কারণে 'রেমিটেন্স যোদ্ধা' একটি গালি, নাকি প্রশংসা বাক্য তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে প্রবাসী বাঙালিরা!

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো বিদেশে থাকা বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স। বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অবদান ১২ শতাংশের মতো। অথচ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত এ রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সাথে করা হচ্ছে অমানবিক আচরণ। মাঝে মধ্যেই খবরের শিরোনাম হচ্ছেন তারা।

এই যেমন, বাংলাদেশ দূতাবাস কুয়েতের স্টাফদের অনৈতিক আচরণে ক্ষুব্ধ কুয়েত প্রবাসীরা। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে দূতাবাসের ভেতরে মসজিদে পানি খেতে গেলে একজন কুয়েত প্রবাসীর কাগজপত্র ও মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কেবল তাই নয়, ধাক্কা দিয়ে দূতাবাস থেকে বের করে দেওয়া ও গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে কুয়েত দূতাবাসের এক কর্মচারি। তা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় চলেছে তোলপাড়। নিজ দেশের দূতাবাসে এ ধরনের আচরণে হতবাক হয়েছিলেন কুয়েত প্রবাসীরা।

ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রবাসী কর্মী নির্যাতনের ঘটনার  ভাইরাল হওয়া ভিডিও আমরা দেখেছি। কতটুকু নির্দয় আর অসম্মান করা হলে এমন আচরণ করা হয় একজন প্রবাসী বাংলাদেশির উপর! তাছাড়া সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশেও প্রতিনিয়তই এমন অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে। আবার শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন কেউ কেউ।

আর ঢাকা এয়ারপোর্টে প্রবাসীদের সাথে ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস আফিসারদের অসৌজন্যমূলক আচরণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবর মাঝে মধ্যেই শিরোনাম হয় দেশের প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলোতে।

সরকারি কর্মচারী আর রাজনৈতিক নেতা/কর্মী এক কথা নয়। জনকল্যাণে রাজনৈতিক কর্মীরা সর্বদা জনগণের পাশেই থাকার কথা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। রাজনীতি বাণিজ্যে পরিণত হওয়া, রাজনীতির সুশিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের আগ্রহ না থাকা আর রাজনীতিই কর্ম ও জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস হয়ে যাওয়াতে আমলাদের কদর আজ বেড়ে গেছে।

মূলত আমলারাই আজ নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের রাজনীতি। যার শতভাগ প্রতিফলিত হচ্ছে ইতালির রাজধানী রোম দূতাবাসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত দূতাবাসে।

ইতালিতে বসবাসরত সাধারণ বাঙালিরা হয়তো রাষ্ট্রদূতের নামটিও ঠিক মত বলতে পারবেন না। কিন্ত যখন দূতাবাসে যান অথবা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে টেলিফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টার কল দিয়েও সংযোগ পেতে ব্যর্থ হন তখন তারা দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়েই বাজে মন্তব্য করেন।

এতে দূতাবাসের বা নীতিহীন সরকারি রাজনৈতিক দলের একাংশের কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু ক্ষতিটা হয় আওয়ামী লীগের, ক্ষতিটা হয় দেশের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে দেশ উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এবং তিনি সফলও হচ্ছেন। কিন্তু গুটিকয়েক এমন আমলা-কর্মচারীদের জন্য আজ তা দুর্নামে পরিণত হচ্ছে।

ইতালির রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে- তা তিনি ভিডিও বার্তায় নয় বরং তার কর্মে মাধ্যমেই প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। ইতালির মত প্রথম বিশ্বের দেশে থেকে তিনি খুব সহজেই দূতাবাসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেমকে সহজ করে করতে পারেন। যদি তার সদিচ্ছা থাকে তবে তিনি এদেশের প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে পারেন। তাছাড়া বাঙালি কমিউনিটিতে এমন অনেক সংস্থা রয়েছে যারা খুব সহজেই বিনা খরচে দূতাবাসকে এব্যাপারে সহায়তা দিতে পারে।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার হীন যে উদ্দেশ্যে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাত্রা শুরু করেছিল সেই যাত্রা থামানো যায়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতামলে এখনো অব্যাহত রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে জাতীয় কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ আর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের দূতাবাস অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হতো না। এখনো অনেকটা সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। আজ বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তার শাসনামলে বিভিন্ন দূতাবাসে সাম্প্রদায়িক আচরণ কি শোভা পায়?

আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়ে থাকে বিদেশে প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠানোর কথা। এ লেখার মাধ্যমে আমি আপনাদের অনুরোধ করবো, শুধু প্রশিক্ষিত শ্রমিকই নয়, এখন থেকে দূতাবাসগুলোতে প্রশিক্ষিত সরকারি কর্মচারী পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। যেন তারা পেশাদারী মনোভাব নিয়ে খেটে খাওয়া প্রবাসী, আপনাদের ভাষায় 'রেমিটেন্স যোদ্ধা'-দের সাথে সুন্দর ব্যবহারটা অন্তত করতে পারে। পরিবার-পরিজন ছাড়া বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা দূতাবাসগুলোতে গেলে যেন তাদের মনে হয় তারা নিজ দেশের নিকট আত্মীয়ের বাড়িতেই এসেছেন।