বালিকা বধূ থেকে বঙ্গমাতা: সংগ্রামের পুরোধা এক মহিয়সী

রিয়াজ আহমেদ
Published : 8 August 2020, 05:25 PM
Updated : 8 August 2020, 05:25 PM

সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করছে, তুমি জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছ, তুমি জানো যে এ দেশের মানুষরে জন্য কি চাই, তোমার থেকে বেশী কেউ জানে না, তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি শুধু সেই কথাই বলবে, কারো কথা শুনতে হবে না। তুমি নিজেই জানো তোমাকে কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সে কথাই বলবা।

যে মহিয়সী নারীর এমন দৃঢ় প্রত্যয় সাহস জোগানোর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন ৭ই মার্চের অমর ভাষণ দিয়েছিলেন, বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। ৭-ই মার্চের ভাষণের নেপথ্য শক্তি- তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ডাক নাম রেণু। ১৯৩০ সালের ৮ই আগস্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তার জন্ম। পিতা শেখ জহুরুল হক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতি সর্ম্পকের চাচা এবং গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবার।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন-

একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার-তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর  দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, যে আমার সাথে তার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে  দিয়ে যাবেন। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান তারপর, সে আমার মা'র কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। 

শেখ মুজিবের মা বেগম সায়েরা খাতুন পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহীন রেণুকে ঘরে তুলে নেন এবং নিজের  ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা ও গৃহকর্মে বড় করে তোলেন।  শৈশব থেকেই রেণু শেখ মুজিব সহ পরিবারের ছোট-বড় সব সদস্যের নিজকে আপন হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে বড় সন্তান খোকা, (শেখ মুজিবের ছোটবেলার ডাক নাম) যার সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক, তার চলাফেরা, কিশোর বয়স থেকেই নানা কর্মকাণ্ড, খানিকটা দুরন্তপনা, বেপরোয়া ও সাহসী মনোভঙ্গি কিশোরী ফজিলাতুন নেছা রেণুর জন্যও বড় হওয়ার প্রেরণা ও মুগ্ধতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।  মানুষের যে কোন বিপর্যয়ে,অসুখ বিসুখে, উদ্ধার কর্মী হিসাবে শেখ মুজিবের সঙ্গে নিজেও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান।     

মহিয়সী এই নারী প্রেমময়ী স্ত্রী, স্বার্থ বিসর্জক, ত্যাগী নারী ও আদর্শ মাতা পাশাপাশি নিজকে একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলেন। চিন্তা চেতনায় ও আদর্শের সমান অংশীদারিত্ব অর্জনে সমর্থ হন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী বহুমাত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই নারী মানুষের ভালবাসা অর্জন করে হয়ে উঠেন বঙ্গমাতা।  

 প্রাথমিক জীবনে নিজের লেখাপড়া বেশিদূর না এগোলেও স্বামীর শিক্ষার ব্যাপারে তার নজর ছিল অতন্দ্র।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,

কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা পয়সার অভাবে। রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হল। কিছুই বললেন না। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, "কোনও কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, 'পাকিস্তানের আন্দোলন' বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।" আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। 'অমঙ্গল অশ্রুজল' বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, "একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।"

প্রয়োজনে নিজের জমির ধান বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি নিয়মিত স্বামীকে সহযোগিতা করে গেছেন। স্বামীর পাশে থেকে মানবতার জন্য কাজ করে গেছেন। জীবনে ঝুঁকি নিয়েছেন বহুবার।  আড়াল থেকেই তিনি বাংলার মানুষের সেবা করে গেছেন আজীবন।  

বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীর প্রথম পাতা শুরু করেছিলেন সঙ্গী সহধর্মিণীর কথা দিয়ে কেননা বেগম মুজিবের তাগিদেই এই প্রজন্মের বাঙালি আজ হাতে পেয়েছি স্বাধিকার আন্দোলনের এক অমূল্য দলিল। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের কাহিনী রচনার পেছনে স্ত্রীর যে উদ্যোগ ও উসাহ পেয়েছেন তাঁর বর্ণনায় লিখেছেন-

আমার স্ত্রী আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা-কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। "বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী"। বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের  কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।  

সেই ছোট্ট বেলা থেকে এবং পরবর্তীকালে স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের এক আত্মত্যাগী সহযোগী হয়ে ওঠেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সংগ্রাম, আন্দোলন ও কারাজীবনেও তিনি এক অনুকরণীয় ত্যাগী নারী হিসেবে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। স্ত্রী হিসেবে তার জীবনকালের কখনও স্বামীকে একনাগাড়ে দুই বছর কাছে পাননি। কিন্তু কোনদিন কোনও অনুযোগ অভিযোগ ছিলনা, কখনো বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও, চলে আসো বা সংসার করো বা সংসারের খরচ দেও। জীবনে কোন প্রয়োজনে কোনদিন বিরক্ত হন নি। যত কষ্টই হোক কখনো ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়নি তাকে।

একদিকে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার সামলানো, আবার কারাগারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষা করে তার মনোবল দৃঢ় রাখা; অন্যদিকে আইনজীবীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মামলার খোঁজখবর নিয়েছেন।  নিজের সোনার অলঙ্কারও বিক্রি করে মামলার খরচ জুগিয়েছেন। নিজেকে বঞ্চিত করে তিনি স্বামীর আদর্শ ও সংগঠনের জন্য নিজের সম্বল প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তার স্বামী দেশের জন্য কাজ করছে, মানুষের কল্যাণের জন্য করছেন। টাকার অভাব, সংসার চালাতে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের সাহায্য দরকার, কেউ অসুস্থ তাকে টাকা দিতে হচ্চে। কিন্তু কখনোই  এসব কথা কাউকে বলতেন না। নীরবে কষ্ট করে সমস্যার সমাধান করেছেন।

এমনও দিন গেছে মামলা চালাতে গিয়ে তার কাগজপত্র, উকিল জোগাড় করতে অনেক খরচ হয়ে গেছে। এদিকে বাজারও করতে পারেননি। কোনদিন বলেননি যে টাকা নাই বাজার করতে পারলাম না। চাল ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন, আচার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বলেছেন যে প্রত্যেকদিন ভাত মাছ খেতে ভালো লাগে নাকি, আসো ‌আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাই, এটা খেতে খুব মজা। একজন মানুষ, তার চরিত্রটা কতটা সুদৃঢ় থাকলে যেকোনো অবস্থা মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রত্যেকটি পদে পদে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রকাশ্যে প্রচারে কখনই আসেননি।

১৯৬৬ সাল ছয় দফা দেবার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম তিন মাসে ৮বার গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তান সরকার ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে।  

৭ জুন ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ধর্মঘট সফলভাবে পালনে বেগম মুজিবের ভূমিকা ছিল অন্যতম। গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি লুকিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের ছোট ফুফুর ফ্ল্যাট বাসায় চলে যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলে, বোরকা পরে একটা স্কুটার ভাড়া করে ঢাকায় পড়ুয়া ছোটভাইকে নিয়ে ছাত্রনেতাদের আর আওয়ামী লীগের নেতাদের সাঙ্গে বৈঠক করতেন। আন্দোলন চালাবে কিভাবে তার পরামর্শ, নির্দেশনা তিনি নিজেই দিতেন। আবার ওই বাসায় ফিরে এসে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে নিজের বাসায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে এই ধর্মঘট যাতে পালিত হয় এবং চলমান আন্দোলনের সফলতার জন্য তিনি নিরলস কাজ করে যেতেন। সবই করতেন গোপনে এবং রাজনৈতিক মেধায়। 

একটা সময় আসলো ৬ দফা না ৮ দফা? পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা চলে এলেন ঢাকায়। তদানীন্তন শাহবাগ হোটেলে থাকতেন নেতারা। বেগম মুজিব মাঝে মাঝে বড় মেয়ে হাসু (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা)-কে পাঠাতেন তাদের স্ত্রীদের একটু খোঁজখবর নিয়ে আসার জন্য, আর সেই সঙ্গে কে কে আছে একটু দেখে নিয়ে এসে তাকে জানাতে। ছোটভাই রাসেলকে সাথে নিয়ে রুমে রুমে গিয়ে সব দেখেশুনে মাকে এসে রিপোর্ট দিতেন শেখ হাসিনা। বেগম মুজিবের একটা ভালো নেটওয়ার্ক ছিল সারা দেশে। কোথায় কি হচ্ছে তার সমস্ত খবর চলে আসতো তার কাছে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন তিনি। রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক নেতাই বেগম মুজিবের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।

আওয়ামী লীগের মধ্যে সে সময়, খুব গোলমাল। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা । ১৯ মে ১৯৬৬ তারিখে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। ডেকোরেটর, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সে যুগে ছিলনা, নিজ হাতে রান্না করে তিন দিন সবাইকে খাইয়েছেন বেগম মুজিব। একই সঙ্গে বিভক্ত নেতাদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন,সাবধান করেছেন যেন ৬ দফা থেকে  ৮ দফার দিকে চলে না যায়। বেগম মুজিবের মানসিক দৃঢ়তা সেই সময়ের রাজনৈতিক জাতীয় সঙ্কট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত,অত্যন্ত কার্যকরী ছিল।

নেতাদের নানামুখী পরামর্শে তিনি শুধু বলতেন "লেখাপড়া জানিনা কি বুঝবো, খালি এটুকু বুঝি যে ৬ দফা আমাদের মুক্তির সনদ এর বাইরে আমি কিছু জানিনা।" জেলখানা থেকে শেখ মুজিব দৃঢ় উচ্চারনে জানিয়ে দিয়েছেন- আর যাই হোক ৬ দফা থাকতেই হবে। ছয় দফা, ছয় দফা থেকে একচুল এদিক-ওদিক হওয়া যাবেনা। বিশেষ কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত  হল ৬ দফা ছাড়া আর কিছু হবেনা।

বেগম মুজিবের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। একবার যা শুনতেন তা আর ভুলতেননা। শ্লোগান থেকে শুরু করে অনেক রাজনৈতিক পরামর্শ, নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত আসতো বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে।

১৯৬৬ শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকার সময়ে প্রতিদিন কি বিপুল আগ্রহে স্ত্রীর আগমনের প্রতীক্ষায় থাকতেন তা তার লেখনীতে দেখতে পাই। ঘরে বাইরে বেগম মুজিবই ছিলেন তার পরামর্শক, উপদেষ্টা, সহচর আর নির্ভরতার আশ্রয়স্থল। সে সময়ের লেখা কারাগারের রোজনামচা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হল।

১৫ই জুন ১৯৬৬  

মাত্র ২০ মিনিট সময় যাবতীয় আলাপ করতে হবে। কথা আরম্ভ করতেই ২০ মিনিট কেটে যায়। নিষ্ঠুর কর্মচারীরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু উপায় কি? আমরা তো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষণীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে, কিন্তু বলার উপায় নাই। 

২৬ শে জুন ১৯৬৬ 

রেণু স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। বলতাম, আমার হার্ট নাই, অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই কিন্তু জেলের ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।

৬ই জুলাই ১৯৬৬

বিকালে চা খাবার সময় সিকিউরিটি জমাদার সাহেবকে আসতে দেখে ভাবলাম বোধহয় বেগম সাহেবা এসেছেন। গত তারিখে আসতে পারেন নাই অসুস্থতার জন্য। 'চলিয়ে, বেগম সাহেবা 'আয়া ।' আমি কি আর দেরি করি?  তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে । রেণুকে জিজ্ঞাসা করলাম, 

'খুব জ্বরে ভুগেছ। এখন কেমন আছ'? 

'পায়ে এখনও ব্যথা। তবে জ্বর এখন ভালই।' 

 বললাম, 'ঠাণ্ডা লাগাইও না'। 

আজ অনেক সময় কথা বললাম। সময় হয়ে গেছে, 'যেতে দিতে হবে'। বিদায় দিয়ে আমার স্থানে আমি ফিরে এলাম। 

কখনো কখনো স্ত্রীর উপস্থিতি কামনায় আকুল হয়ে উঠতেন, অপেক্ষা করে থাকতেন, না এলে মুষড়ে পরতেন কিছুক্ষণের জন্য–

২১ শে জুলাই ১৯৬৬

ভেবেছিলাম আজ রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখতে আসবে আমাকে। হিসাবে পাওয়া যায় আর রেণুও গত তারিখে দেখা করার সময় বলেছিল, '২০ বা ২১ তারিখে আবার আসব।' চারটা থেকে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে। মনে হতেছিল এই বোধহয় আসে খবর। যখন ৫টা বেজে গেল তখন ভাবলাম, না অনুমতি পায় নাই। 

শেখ মুজিবের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেগম ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন অফুরান প্রেরণার উস।  ১৯৬৬তে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে শেখ মুজিব যখন বারবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নির্দেশনাগুলো পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাতেন। জেলখানায় দেখা করার সময় ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে নিতেন একটু হৈচৈ করার জন্য, আর ওই ফাঁকে বাইরের সমস্ত রিপোর্ট স্বামীর কাছে দেওয়া আর তার কাছ থেকে পরবর্তী করনীয় নির্দেশনা জেনে নেয়া। নির্দেশনাগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

১৭ই মার্চ ১৯৬৭

আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই—বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। 

ছয়টা বেজে গিয়াছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না। ফিরে এলাম আমার অস্তানায়। 

১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্দ্রিয় কারাগার থেকে প্রথমে মুক্তি দিয়ে জনগণের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে জেল গেটেই সেনাবাহিনীর লোকজন পুনরায় গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্ট  নিয়ে যায়। পাঁচ মাস তার পরিবার জানতেও পারেনি তিনি কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, বেঁচে আছেন কিনা? পুরো পরিবার নিয়ে চরম উকণ্ঠা,উদ্বেগ আর দুঃচিন্তায় কেটেছে বঙ্গমাতার। আগরতলা মামলায় সামরিক বাহিনীর ইন্টারোগেশনের সম্মুখীনও হতে হয়েছে একাধিকবার ।

দেশের অনেক এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নেতারা বেগম মুজিবের কাছে আসতেন দেখা করতে,পরামর্শ নিতে, নির্দেশনা জানতে। আইয়ুব খান ভুট্টোকে মন্ত্রিত্ব থেকে বের করে দিলে সেও ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসায় ছুটে আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা এলে পর্দার আড়াল থেকে তাদের সাথে কথা বলতেন বেগম মুজিব। কখনোই সামনে আসতেন না। ছেলেমেয়েদের বলতেন, 'ওদের সাথে তো আর আমরা থাকবনা, কেন দেখা করবো? ওদের চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছা করেনা।' বঙ্গবন্ধু এমএনএ, এমপি, মন্ত্রী থাকা কালে অনেকবার করাচি গেছেন। বেগম মুজিব একবারের জন্যও তার সঙ্গী হন নাই। কখনো যেতে চাইতেন না।  সবার আগে তিনিই বুঝেছিলেন এ দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। তার মধ্যে এই চেতনা অত্যন্ত তীব্র ছিল এবং বিশ্বাসও ছিল।

আগরতলা মামলা নিষ্পত্তির জন্য আইয়ুব খান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠক ডাকে। প্রস্তাব দেওয়া হয়, বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে ছাড়া হবে প্যারোলে। বেগম মুজিব স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যেন তার সাথে পরামর্শ না করে তিনি কোন সিদ্ধান্ত না নেন। জানালেন, দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে। মামলা তুলে বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ৩৫ জনের সকলের মুক্তি দিলেই গোল টেবিল বৈঠক হতে পারে অন্যথা একা যাওয়ার প্রশ্নই আসেনা। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যে দূরদর্শিতা তিনি সেদিন দেখিয়ে ছিলেন যা পরবর্তীতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথের নির্দেশনা দিয়েছিল।

নেপথ্যে থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এবং নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বন্দি থেকেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে দলের নেতাদের নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন। বেশ কয়েকবার গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ ও শাস্তি-নির্যাতনের হুমকি দেয় তবুও তিনি ছিলেন অকুতোভয়।

দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতেও প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন জাতির জনককে।  ৫ সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন এই মহীয়সী নারী। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইতিহাসে কেবল একজন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণী নন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যের অন্যতম অনুপ্রেরণা-দানকারী মহিয়সী নারী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন তিনি। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের সময়ও জীবনের মতো মরণের সহযাত্রী হলেন শেখ মুজিবের। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব আজ সশরীরে বেঁচে না থাকলেও তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি দেশ প্রেমিক বাঙালির হৃদয়ে। তার দেশপ্রেম ও আদর্শ অনুপ্রেরণার উস হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এক মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব একে অপরের সম্পূরক। বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্ব ও বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের যে দুর্বারতা তার উসে ছিলেন বেগম মুজিব। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কিন্তু এই নেতৃত্বকে সহায়ক শক্তি, নির্যাতন বরণের ধৈর্য্য ও  প্রেরণা জুগিয়েছেন এই নারী। মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালি নারী ছিলেন বঙ্গমাতা। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও সুখ শান্তি তার কাছে বড় হয়ে ওঠেনি। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছেন। রাজনৈতিক ও জাতীয় সংকট উত্তরণে দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম যেমন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে চিরকাল ইতিহাসের পাতায় অম্লান থাকবে। তেমনি বাঙালি জাতি চিরকাল স্মরণ করবে তাঁর প্রিয়তমা পত্নী 'বঙ্গমাতা' শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে। ৮ অগাস্ট বঙ্গমাতার জন্মদিন। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।