এক হাজার ট্যাক্সিক্যাব ও রাজধানীর গণপরিবহণ

হাসান শফি
Published : 6 Oct 2012, 05:18 PM
Updated : 6 Oct 2012, 05:18 PM

যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আমাদের একটি দারুণ খবর দিয়েছেন। আগামী মাসে ঢাকার রাজপথে এক হাজার নতুন ট্যাক্সিক্যাব নামবে। দুশ'-পাঁচশ' নয়, একেবারে হাজার! আমরা যারা রাজধানীতে বাস করি তাদের জন্য তো বটেই, এমনকী সারা দেশ থেকে নানা প্রয়োজনে যাদের নিয়মিত বা মাঝেসাঝে রাজধানীতে আসতে হয় তাদেরও চিত্ত এ খবরে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার কথা।

খবরটা শুনে এক মুহুর্তের জন্য হলেও আমরা যে আনন্দিত হইনি তা নয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই যে-প্রশ্নগুলো অন্তত ভুক্তভোগী প্রতিটি মানুষের মনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা হল, রাজধানীর বর্তমান যোগাযোগ বা গণপরিবহণ সমস্যার সমাধানে এই এক হাজার ট্যাক্সিক্যাব কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে? আদৌ রাখতে পারবে কি? নাকি শহরের নিত্যদিনের যানযট পরিস্থিতিকে তা আরও ভয়াবহ, আরও দুর্বিষহ করে তুলবে মাত্র? মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষ কি এই ট্যাক্সিক্যাবে সওয়ার হতে পারবে? অন্যান্য দেশের মতো এগুলো শেয়ারে যাত্রী নেবে তো? এগুলো কি সরকার-নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা মেনে চলবে? মিটারে চলবে? কতদিন পর্যন্ত চলবে? যাত্রীর ইচ্ছা বা প্রয়োজন অনুসারে যে কোনও দূরত্বে ও যে কোনও দিকে যেতে রাজি হবে? সমস্যাটা কি আসলে যানবাহনের সংখ্যার না কি ব্যবস্থাপনারও? এর আগে যে-ক্যাবগুলো ঢাকায় নেমেছিল, এবং যার কিছু এখনও চালু আছে- তা যাত্রীসাধারণকে কী ধরনের সেবা দিয়েছে বা দিচ্ছে?

ঢাকা শহরে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন রুটে বাস-মিনিবাসও তো কম নামেনি। ব্যবসা হিসেবে লাভজনক না হলে নিশ্চয় ব্যবসায়ীরা এই খাতে অর্থলগ্নি করতে এগিয়ে আসতেন না। পরিবহণ-খাতে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকঋণও পাওয়া যায়। তারপরও মহানগরের গণপরিবহণ ব্যবস্থার দিকে তাকালে এক সার্বিক নৈরাজ্যদশাই আমাদের চোখে পড়ে। এর জন্য কে কতটা দায়ী– পরিবহণ মালিক, শ্রমিক, ট্রাফিক পুলিশ কিংবা সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল? কার দায়ভাগ কতটা তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু জনগণের দুর্ভোগ কমার কোনও সম্ভাবনা কোনও তরফ থেকেই আপাতত দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক রুটে কাউন্টার বাস চালু হয়েছে, কাউন্টারে টিকেট কেটে যে-বাসগুলোতে উঠতে হয়। কিন্তু সেগুলোর যে ভাড়ার হার তাতে একেবারে উপায়ন্তরহীন না হলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক'জন মানুষ ওই বাসগুলোতে চড়ার সামর্থ্য রাখেন? সে-বাসও কি সব রুটে পর্যাপ্ত সংখ্যায় আছে? সময়মতো পাওয়া যায়, বিশেষ করে অফিস বা স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার সময়? টিকেট কেটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও ঠিকমতো বাসে ওঠা যায়? কিছু রুটে কাউন্টার বাস চালু হয়েও আবার কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে গেছে।

কাউন্টার বাসগুলোর কথা বাদ দিলে পুরো ঢাকা শহরের গণপরিবহণ ব্যবস্থা গোড়া থেকেই যে যানবাহনগুলোর উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে- সে বাস, মিনিবাস, হিউমান হলার এগুলোরই বা কী অবস্থা? এগুলো কি কোনও নিয়মনীতি মেনে চলে? ওভারটেকিং তো আছেই, মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, স্টপেজে বাস না থামানো, চালু অবস্থায় যাত্রী ওঠানো-নামানো, অনেক সময় রাস্তার মাঝখানে প্রায় ধাক্কা দিয়ে যাত্রীকে নামতে বাধ্য করা- এ সব এখন সাধারণ ও আমাদের গা-সওয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা শহরে বর্তমানে দু-ধরনের বাস চলে : এক ধরনের বাস হল ঘোষিতভাবে সিটিং (দুষ্ট লোকেরা বলে 'চিটিং'), এগুলোকে ডাইরেক্ট, গেট-লক ইত্যাদি আরও নানা নামে অভিহিত করা হয়। আরেক ধরনের বাস আছে যেগুলো সময়ে-সিটিং, সময়ে-লোকাল। এগুলো আসলে লোকাল বাস, কিন্তু সকালে ও বিকেলে অর্থাৎ অফিস-টাইমে বেশি ভাড়া আদায়ের জন্য সিটিং হয়ে যায়। এমনকী সিটিং বাসগুলোরও মাঝপথে নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যায় যাত্রী তোলার নিয়ম আছে। কিন্তু বিশেষ করে অফিস টাইমে তাও মানা হয় না।

ফলে মাঝপথে নারী-পুরুষ অফিসযাত্রী, পরীক্ষার্থীসহ ছাত্রছাত্রী, শিশুসহ অভিভাবকদের দীর্ঘ সময় ধরে বাসের অপেক্ষায় ঠাঁই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে কিংবা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে হয়। ঢাকা শহরের অনেক রাস্তায় দিনের বেলায় রিক্সা চলাচল নিষিদ্ধ। অথচ বাসগুলো (তা সে সিটিং বা লোকাল যাই হোক) স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে যাত্রী বোঝাই করে 'ডাইরেক্ট' চলাচল করে। এ অবস্থায় মাঝপথের বাসিন্দা স্কুলের ছোট-ছোট বাচ্চাদের নিয়ে তাদের অভিবাবকদের স্কুল যাওয়া-আসার সময় প্রতিদিন দু-বেলা কী দুর্দশায়ই না পড়তে হয় (সব ছেলেমেয়ের অভিভাবকরাই তো আর গাড়িওয়ালা নন, বাবার অফিসিয়াল গাড়ি ব্যবহারের 'সৌভাগ্য' নিয়েও সবাই জন্মায় না)। প্রচণ্ড রোদ ও বৃষ্টির দিনে এই দুর্দশা আরও বাড়ে।

আমি মিরপুর এলাকায় থাকি। প্রতিদিনই আমাকে এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব নেয়ার পর গোড়ায় যখন প্রতিদিন রাস্তাঘাট পরিদর্শন ও রাস্তায় নেমে যাত্রীদের অসুবিধা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন- তখন আমি একবার তাঁকে ফেসবুকে অনুরোধ করেছিলাম যে-কোনও একদিন সকালে অফিস টাইমে মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় এসে এখানকার যাত্রীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে। ফেসবুকেই তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনওদিন পরিদর্শনে এসেছিলেন কিনা জানি না। এলেও বা তাঁর একদিনের পরিদর্শনে অবস্থার কি কোনও পরিবর্তন ঘটত? তিনিও জানেন বা এতদিনে নিশ্চয় বুঝে গেছেন, তা ঘটত না।

উপরে যে-সমস্যাগুলোর কথা বলা হল সেগুলো তো আসলে ব্যবস্থাপনার সমস্যা। এই সমস্যাগুলো নিরসনের দায়িত্ব কার? এই অব্যবস্থাপনা জিইয়ে রেখে এক হাজার ট্যাক্সিক্যাব কিংবা সরকারি ও বেসরকারি খাতে একশ' বা দুশ' বাস আমদানি করে কার কতটা উপকার হবে? মাঝখান থেকে কিছু লোকের টু-পাইস কামানোর সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া? প্রতি বছর একবার সাড়ম্বরে ট্রাফিক সপ্তাহ পালন এবং অন্য সময়ও মাঝে-মাঝে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশদের যাকে বলে লোকদেখানো তৎপরতা বাস্তব অবস্থার সামান্যও হেরফের ঘটাতে পারে না। বরং চালক ও যাত্রীসাধারণের কাছে তা অন্য অর্থ বা তাৎপর্য নিয়ে ধরা দেয়। তার উল্লেখ এখানে না-ই করলাম। সবাই বিষয়টা জানেন।

একজন সাধারণ নাগরিক থেকে যোগাযোগমন্ত্রী, সবাই আশা করি উপলব্ধি করেন যে, রাজধানী ও দেশের অন্য বড় শহরগুলোতে মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে দুর্ভোগ ও যানজট নিরসনে একমাত্র না হলেও প্রধান করণীয় হল, গণপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি। রেল ও বাস সার্ভিসের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। উন্নত-উন্নয়নশীল নির্বিশেষে দুনিয়ার সব দেশেই গণপরিবহণের ক্ষেত্রে রেল একটি গুরুত্বর্পূ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আগ-পর্যন্ত এ দেশে রেলযোগাযোগের একটি ভালো অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ-চলাকালে অনেক রেললাইন, ব্রিজ ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সত্যি। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই ভারতের সাহায্য নিয়ে সেগুলোর মেরামত ও সংস্কারের মাধ্যমে সারাদেশে রেলব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের কাজও শুরু হয়েছিল।

কিন্তু পরে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাসংস্থার ভ্রান্ত-পরামর্শ মানতে গিয়ে খানিকটা আর খানিকটা পরিবহণ-খাতে টাকা লগ্নি করা হঠাৎ-ধনীদের স্বার্থে গণপরিবহণের ক্ষেত্রে রেলওয়ের ভূমিকাকে ক্রমে গৌণ করে তোলা হয়। মাঝে দু-চারটি আন্তঃনগর ট্রেন চালু এবং মন্ত্রী বিশেষের মুখে ঢাকা-চট্টগ্রাম ম্যাগনেটিক ট্রেন চালুর মাধ্যমে রেলব্যবস্থার 'যুগান্তকারী' পরিবর্তন ঘটানোর বাগাড়ম্বরপূর্ণ ঘোষণার কথা বাদ দিলে রেল নিয়ে কখনও-ই কোনও সরকার তেমনভাবে ভাবেননি। অথচ শুধুমাত্র, আমাদের পাশের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা শহরের মতো, ঢাকা শহরের সঙ্গে যদি পাশের জেলাগুলোর দ্রুতগামী ও সময়ানুবর্তী রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেত, রাজধানীর ওপর জনসংখ্যার চাপ অনেকটাই কমানো সম্ভব হত। সড়কের ওপর চাপ কমাতে শহরের ভেতরে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনারই বা কী হল? রেলের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটানোর পরিবর্তে, রেলকে সরকারের জন্য একটি লাভজনক সেবাখাত ও জনগণের জন্য একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াত ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলার বদলে, রেলওয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের দলীয় ও ক্রোড়াশ্রিত লোকজনের যথেচ্ছ লুটপাটের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয় এই বিশাল রাষ্ট্রীয় সংস্থাটিকে। সারাদেশে রেলওয়ের জমি এবং অন্যান্য স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির এক বড় অংশ এর মধ্যে অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে।

আগে যদি সেভাবে না-ও জানতেন, রেলমন্ত্রীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকালীন কিছুদিনে আমাদের স্পষ্টভাষী ও কর্মতৎপর যোগাযোগমন্ত্রীর সেটা ভালোভাবেই টের পাওয়ার কথা। ভোগদখলকারী এই চক্রগুলোর ক্ষমতার দাপট ও শক্তির উৎস সম্পর্কেও নিশ্চয়ই তিনি একটি ধারণা লাভ করেছেন। রেলমন্ত্রী থাকাকালে তিনি প্রায়ই রেলের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও রেলওয়ের সম্পত্তি দখলকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি ও তাদের হাত থেকে রেলকে উদ্ধারের কথা বলতেন। আমরা জানি না, যোগাযোগমন্ত্রীকে রেলওয়ের সেই অতিরিক্ত ভার থেকে দ্রুত মুক্ত করার পেছনে তাঁর সে হুমকি-ধমকির পরোক্ষে হলেও কোনও ভূমিকা আছে কিনা।

সম্প্রতি অজস্র বাইক নেমেছে রাজধানীর রাস্তায়। আমাদের গণপরিবহণ-ব্যবস্থার যে-হাল, তাতে সময়মতো কর্মস্থলে উপস্থিতি এবং অন্যান্য সুবিধার কথা ভেবে অনেকেই তুলনামূলক সাশ্রয়ী এই যানটির দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু এর অন্য ফলটা কী দাঁড়িয়েছে? সড়কে জ্যাম, যানবাহনের নট নড়ন-চড়ন অবস্থা, সিগন্যালে লালবাতি জ্বলে আছে, নো প্রবলেম, বাইকের সারি অবলীলায় উঠে যাচ্ছে ফুটপাতে। কারওয়ান বাজারের মতো শহরের অনেকগুলো জায়গায় এখন বাইকের জন্য পথচারীদেরই বরং ফুটপাতে চলা কঠিন বা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। নতুন এক হাজার ট্যাক্সিক্যাব নামার পর সেগুলো কোথায় উঠবে? আইল্যাণ্ড ভেঙে নিজেরাই কি পথ করে নেবে?

যে-অনুষ্ঠানে মন্ত্রী ঢাকা শহরে এক হাজার ট্যাক্সিক্যাব নামানোর ওই ঘোষণাটি দিয়েছেন- সেখানেই তিনি নাকি মজা করে আরও একটি কথা বলেছেন। তিনি যে মাঝেমাঝে রাস্তায় নেমে নিজেই যানবাহন চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করছিলেন, আর আমরা টিভি পর্দায় তা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম, অতঃপর তা দেখার সুযোগ আমরা আর পাব না। অর্থাৎ তিনি ও-কম্মোটি আর করবেন না। তাঁর এতদিনের অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ তিনি নিজমুখেই বয়ান করেছেন, অধিকাংশ চালকের হয় লাইসেন্স নেই কিংবা থাকলেও তা ভুয়া। এভাবে লাইসেন্সবিহীন বা ভুয়া লাইসেন্সের অধিকারী চালক, যারা উপযুক্ত বা একেবারে কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন তাদের হাতে যে প্রতিদিনই শহরের রাস্তায় কিংবা হাইওয়েতে দু-পাঁচজন লোকের মৃত্যু ঘটবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? জীবনে-মৃত্যুই সবচেয়ে বড় সত্য, আর তার দিনক্ষণ বলেও সত্যিসত্যিই কিছু নেই, যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও স্থানে আজরাইল (আ.) আমাদের জান-কবচ করতে পারেন। কথাটা জেনেও আমরা পাপী-তাপী মানুষ তা মনে রাখতে পারি না। আমাদের যানবাহন চালকদের চেয়ে ভালোভাবে আর কে আমাদের কথাটা মনে করিয়ে দিতে পারতেন?

একসময় যন্ত্রদানব বলতে আমরা প্রধানত 'শুয়োরমুখো' ট্রাককেই বুঝতাম। বেপরোয়া যানচালনার ক্ষেত্রে ট্রাকচালকরাই ছিলেন 'রাস্তার রাজা'। আজ বাস, মিনিবাস, কাভার্ডভ্যান, হাফট্রাক, হিউম্যান হলার, প্রাইভেট কার, সিএনজি কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলা যাবে? সবার জন্যই যেন প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত। এ কথা নিশ্চয়ই বলব না যে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকরাই একশ'ভাগ দায়ী। পথচারী ও যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক নিয়ম না মেনে ও অসাবধানে রাস্তা-পারাপার, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ফুট-ওভারব্রিজ ও আণ্ডার-পাস ব্যবহারে অনীহা, স্টপেজ ছাড়া অন্য জায়গায় তাড়াহুড়া করে চলন্ত বাসে ওঠা-নামার প্রবণতা, সে সঙ্গে ইদানীং বিশেষ করে তরুণদের মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বা কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তায় চলাচল ইত্যাদি আরও অনেকগুলো কারণকে এ ব্যাপারে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার প্রযোজন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ট্রাফিক আইনের কড়াকড়ি প্রয়োগের আবশ্যকতা।

কিন্তু শর্ষের ভেতরেই যদি ভূত থাকে, সে ক্ষেত্রে অন্য কারণগুলো গৌণ হয়ে যায়। চালকরা লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে রাস্তায় গাড়ি নামায়? তাদের ভুয়া লাইসেন্সই বা সরবরাহ করেন কারা, কোথা থেকে? যেখানে একই রাস্তায় বাস, মিনিবাস, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি, রিক্সা, স্কুল ভ্যান, ঠেলাগাড়ি পাশাপাশি চলে সেখানে বড় গাড়ির বড় ড্রাইভারদের অতিরিক্ত সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার তো কোনও বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সম্প্রতি যোগাযোগমন্ত্রী কয়েকবারই বলেছেন, 'দুর্ঘটনা নয়, এগুলো হত্যাকাণ্ড'।

হত্যাকাণ্ডই যদি হয়, তার জন্য কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা তো দেশে থাকা দরকার। দরকার সে শাস্তি প্রদানের উপযুক্ত আইন। কিন্তু যে-দেশে মন্ত্রিসভায় যোগাযোগমন্ত্রীরই একজন সহকর্মী, পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের সমাবেশে দাঁড়িয়ে, প্রকাশ্যে এ ধরনের কঠিন আইন ও শাস্তি দাবির বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন, সে-দেশে আইন প্রণয়ন বা তার প্রয়োগ কোনওটাই বোধহয় সম্ভব নয়। এর আগে এরশাদ আমলে একবার সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান রেখে আইন করা হয়েছিল। সেবার সারাদেশে লাগাতার পরিবহণ ধর্মঘট করে সরকারকে তা বাতিল করতে বাধ্য করা হয়।

গণতান্ত্রিক আমলে এর ব্যতিক্রম হবে এমন আশা করার কোনও কারণ নেই। অন্তত সে-দেশে, যেখানে একজন মন্ত্রীর কাছে মন্ত্রিত্বের জাতীয় দায়িত্বের চেয়ে তাঁর পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের কোটারি স্বার্থটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। তিনি জানেন, মন্ত্রী পদটি অস্থায়ী। আজ আছে কাল থাকবে না। কিন্তু পরিবহণ তাঁর পারিবারিক ব্যবসা, অন্যদিকে পরিবহণ শ্রমিকদের নেতা হিসেবে যে-দাপট বা প্রতিপত্তি তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করে আসছেন- তা হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

স্মরণযোগ্য, সরকারি উদ্যোগে দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে বিআরটিসি আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস চালু হলে অল্পদিনেই তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একশ্রেণির বেসরকারি পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক নেতাদের বিরোধিতা এবং স্থানে-স্থানে তাদের দ্বারা সৃষ্ট প্রতিরোধ ও ভাঙচুরের মুখে অনেক জায়গায়ই সে-সার্ভিশ চালু রাখা যায়নি। এই পরিবহণ-মোগলদের বশে আনতে পারবেন কোন যোগাযোগমন্ত্রী?

হাসান শফি : লেখক ও গবেষক।