স্বপ্ন দেখার অপরাধে জুটেছিল যার ‘খলনায়ক’ খেতাব

জুয়েল রাজ
Published : 5 August 2020, 04:44 PM
Updated : 5 August 2020, 04:44 PM

আমরা যারা ১৯৭৫ পরবর্তী প্রজন্ম, আমরা বঙ্গবন্ধুকে পাইনি। যাবতীয় প্রচারমাধ্যমে যখন  নিষিদ্ধ তার নাম। মুজিব নামটির বড় দুঃসময়ে আমাদের বেড়ে উঠা। তবুও তিনি কেমন করে আমাদের প্রজন্মকে আকৃষ্ট করলেন? 

গ্রামের মেলা থেকে দুইটাকা দাম দিয়ে রঙ চকচকে একটা পোস্টার কিনেছিলাম যেখানে লেখা ছিল-  'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও  দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ' তার  নিচে 'শেখ মুজিব'।  দীর্ঘদেহী মানুষটার সাথে সেখানেই প্রথম পরিচয়। কিন্তু তিনি বেঁচে ছিলেন ৭ই মার্চের ভাষণে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে কিংবা ১৫ই অগাস্টে ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি আমার বড় ভাই বাজাতেন। একটা অডিও ক্যাসেট ছিল তার কাছে যদিও টেপ রেকর্ডার ছিল না উনার। দিবসগুলো এলেই শুধু আমরা এই ভাষণটি সারাদিনে বেশ কয়েকবার  শুনতাম।  কৌতূহল থেকেই, জন্মদাতা জনকের কাছে জেনেছিলাম জাতির জনকের কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা। আর  বঙ্গবন্ধু এইভাবেই নতুন প্রজন্মের মাঝে বেঁচে ছিলেন বুকের গভীরে, সঙ্গোপনে। 

সেখানে শেখ কামাল বা শেখ জামাল অথবা শেখ হাসিনা শেখ রেহানার খবর কে জানতো! কে খোঁজ নিত! 

যতটুকু বা শেখ কামাল  সম্পর্কে শুনতাম সবই ছিল নেতিবাচক- 'ব্যাংক ডাকাত, লম্পট'- এক যুবকের  গল্প। আমাদের শিশু মনে রোপণ করা হতো বিষবৃক্ষ। আমরা বুঝে নিতাম শেখ কামালের কারণেই শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছে মেজর ডালিম। গ্রাম থেকে গ্রামে এই গল্পই চালিয়ে দেওয়া হয়েছে বছরের পর বছর। 

অথচ ইতিহাসের পাতায় মানুষের অন্তরে শেখ কামাল এক স্বপ্নের নাম, এক জাগরণের নাম হিসেবে বিরাজমান থাকার কথা ছিল।  মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালকে শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসাবে মূল্যায়ন করে থাকেন। কিন্তু এর বাইরেও ব্যক্তি শেখ কামাল ছিলেন এক নব-জাগরণের নাম। 

মাত্র ২৬ বছর বয়সের এক তরুণ, শিল্পে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, খেলাধুলায়  বদলে দিতে চেয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে। ব্যক্তি কামালের সেই চেতনা বোধ, সেই  স্পৃহা ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। ৬৬ সালের ৬ দফা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের প্রতিটি মাইল ফলকে জড়িয়ে আছে শেখ কামালের নাম। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে কোথাও তার খুব একটা উল্লেখ পাওয়া যায় না। একমাত্র আবাহনী ক্লাবই মনে রেখেছে শেখ কামালকে। 

কাদের সিদ্দিকী তার এক লেখায় শেখ কামালের ছাত্র  রাজনীতি নিয়ে  উল্লেখ করেছিলেন- 

আগরতলা মামলার আগে থেকেই সে ছিল একজন নিবেদিত ছাত্রলীগ কর্মী। এখনকার মতো ছাত্রলীগ কর্মী ভাবলে কামালকে অসম্মান করা হবে। আমরা যেমন নিরলস নিখাদ কর্মী ছিলাম, কামালও ছিল সেই রকম। সে সময় ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জলিল সাহেবের জন্য কেউ মিছিল করতে পারত না। একমাত্র কামালই শিরদাঁড়া সোজা করে প্রিন্সিপালের সামনে দিয়ে মিছিল বের করে আনত। এরপর '৬৯-এর গণআন্দোলনে ঢাকা কলেজের ভূমিকা সে তো সূর্যের কাছাকাছি লটকে রাখার মতো গৌরবের।  

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বেলোনিয়া থেকে  সেনাবাহিনীর প্রথম যে ব্যাচটি প্রথম কমিশন লাভ করে, তাদের মধ্যে শেখ কামালও ছিলেন। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অফিসারদের একজন। সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট শেখ কামাল প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানির এডিসি হিসেবে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে  দায়িত্ব পালন করেন। যদিও বিজয় শেষে তিনি সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসেছিলেন প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।  

স্বাধীনতা আর মুক্তি শুধু  নির্দিষ্ট একটা ভূখণ্ড আর সরকার নয়। যুগে যুগে  বিপ্লব এবং স্বাধীনতার ইতিহাস বলে দেয়, নিজেস্ব রাজনীতি , অর্থনীতি, সংস্কৃতি, কৃষ্টির মুক্তিই স্বাধীনতা।  

মাত্র ২৬ বছর বয়সে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে সেই মুক্তির পথেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন শেখ কামাল। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল কিংবা মঞ্চ নাটক, সেতার, ব্যান্ডের দল, কোথায় ছিলেন না তিনি, তার নেতৃত্বেই মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন। যার স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। 

ঢাকার শাহীন স্কুলে থাকাকালীন ছিলেন স্কুলের প্রতিটি খেলার অপরিহার্য অংশ। দীর্ঘদেহী ফাস্ট বোলার ছিলেন তিনি। নিখুঁত লাইন-লেন্থ আর প্রচণ্ড গতি দিয়ে খুব সহজেই টালমাটাল করে দিতেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে। 

অবিভক্ত পাকিস্তানের অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন, কিন্তু বাঙালি এবং শেখ  মুজিবের পুত্র পরিচয়ের  অপরাধে ক্রিকেটে উপেক্ষিত হয়েছেন নিদারুণভাবে। আজাদ বয়েজ ক্লাব তখন কামালদের মত উঠতি প্রতিভাদের লালনকেন্দ্র। এখানেই শেখ কামাল প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিন। শুধু খেলাধুলাই নয়, পড়াশোনা, সঙ্গীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন শেখ কামাল।  ঢাকার শাহিন স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ভর্তি হয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। 

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি জান্তা সরকার যখন  রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করল ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়ে। সেখানেও প্রতিবাদী ছিলেন শেখ কামাল।  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যেখানে যখনই সুযোগ পেলেন, তখনই বিশ্বকবির গান গেয়ে উঠেছেন। গানে গানে জানিয়েছেন তার প্রতিবাদ। ছায়ানটের সেতারবাদন বিভাগের মেধাবী ছাত্র শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকা  থিয়েটার। সুঅভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যঅঙ্গনে সুপরিচিত ছিলেন তিনি।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ''শেখ কামাল সম্পর্কে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন  ছায়ানটে সেতার শিখেছেন। বাজিয়েছেন গিটার। করেছেন আবৃত্তি। তিনি নাটক করেছেন। সুরও ছিল তার কণ্ঠে। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অগ্রপথিকদের তিনি একজন। সভাপতি ছিলেন 'স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী'র। তার সহযাত্রীদের অনেকেই সংগীতশিল্পী হিসেবে দেশ কাঁপিয়েছেন।''

স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরেই আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা গড়ে ১৯৭২ সালে সংস্থার নামে কেনা হল ইকবাল স্পোর্টিং ফুটবল দল। ক্রিকেট আর হকির দল কেনা হলো ইস্পাহানী স্পোর্টিংয়েরটা। এগুলোর সমন্বয়ে নতুন যাত্রা শুরু হলো আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে একটা ক্লাবের। ক্রিকেটার তানভীর মাজহার তান্না হলেন এই ক্লাবের ফাউন্ডার ভাইস প্রেসিডেন্ট। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি এই খেলাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন কামাল। স্বপ্ন দেখতেন একদিন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে এক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেই লক্ষ্যে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন সবক্ষেত্রেই, উপমহাদেশের মধ্যে প্রথমবারের মত আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে দিয়েছিলেন সব খেলার খোলনলচে। ক্র্যাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধা আবদুল হালিম খান জুয়েলের মত অসাধারণ সব প্রতিভাগুলো যেন আর হারিয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যে ক্রিকেটকে ঢেলে সাজাবার মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন কামাল। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে তৈরি করছিলেন নতুন দিনের জন্য, লক্ষ্য আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ বিশ্বক্রিকেটে  গড়ে নিয়েছে নিজেদের  শক্তিশালী অবস্থান। 

শেখ কামালকে সঠিক মূল্যায়ন করেনি বাংলাদেশ। আজ চারদিকে শেখ কামালের বন্ধুদের ছড়াছড়ি, অনেকেই খুব ভাব নিয়ে পরিচয়ও দেন আমি শেখ কামালের ফ্রেন্ড, এদের অনেকেই পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ে নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হওয়া শেখ কামালের জন্য কিছুই করেননি। একটু প্রতিবাদ করার ইতিহাসও জানা নেই। বরং এখন অনেকেই শুধু বন্ধু পরিচয়ে অনেক কিছুই ভোগ করছেন। পদ-পদবী, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে মন্ত্রী এমপি-ও হয়েছেন অনেকেই। 

একটা প্রজন্মকে এখনো 'ভয়ংকর শেখ কামাল' এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেমন পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে। এখনো তাই হচ্ছে  শুধু প্রচারের ধরন বদলেছে আর  কিছু নয়।  

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের  জন্য, যুদ্ধের সময়ে  জেনারেল ওসমানীর একান্ত সচিব  বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী নূর উদ্দীন কে বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়েছিল। নূর উদ্দীনের  আগে একান্ত  সচিব ছিলেন শেখ কামাল। অথচ শেখ কামাল  যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই তথ্যটুকু পর্যন্ত  স্বীকার করা হয়না। ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতায় বলা হয় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নাই।  

২০২০ সালে এসে ৭১ বছরের শেখ কামালকে  নয়, তারুণ্যের চোখে আমি, ১৯৭৫ সালের  ২৬ বছরের টগবগে শেখ কামালকে দেখি। সময়ের চেয়ে কতোটা এগিয়ে ছিলেন তিনি। কতো দূরদর্শী ছিল তার চিন্তার ক্ষেত্র।শেখ কামাল আমার কাছে এক রূপকথার রাজকুমার।  রূপকথার  সুয়োরাণী আর দুয়োরাণীর মতো  ইতিহাসের পাতায় দুয়োরাণীর ভাগ্য বিড়ম্বিত রাজকুমার শেখ কামাল। অথচ সেই  সময় শেখ কামাল চাইলে, ক্ষমতার  দাপটে ৫৬ হাজার বর্গমাইল এক করে ফেলতে পারতেন। 

সুনীলের সত্যবদ্ধ প্রথম  ও শেষ দুটি লাইন 

"এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ,

আমি কি এই হাতে কোন পাপ করতে পারি?…

…এই ওষ্ঠ  বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি

এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যা কি মানায়।" 

২৬ বছরের স্বপ্নবাজ, প্রেমিক, শিল্প সাহিত্য প্রেমিক একজন তরুণ কোন পাপ করতে পারেনা। তাঁকে কোন পাপ মানায় না।

সময় এসেছে শেখ কামালকে মূল্যায়নের। বিক্ষিপ্তভাবে অনলাইনে শেখ কামালকে নিয়ে মিথ্যাচারের  জবাবে কিছু লেখা পাওয়া যায়, যা যথেষ্ট নয়। খুব বেশি কৌতূহলী না হলে কেউ সে সব খুঁজে বের করবে না। বা অনেকের সেই সুযোগও নেই। ব্যাপকভাবে শেখ কামালের কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনা করার। নতুন প্রজন্মের মাঝে শেখ কামালের যাপিত জীবন তার অবদান সম্পর্কে জানাতে হবে। আজকে ক্রিকেটে বুঁদ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পথচলা কার হাত দিয়ে শুরু? নাটক, কিংবা আধুনিক ব্যান্ড সংগীতের শুরু কার হাত দিয়ে? এ বিষয়গুলো জানাতে হবে।